রুম্মান আহমদ চৌধুরী বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপ সারা বিশ্বে ছড়ালেও উন্মাদনা বেশী আমাদের দেশে। সমর্থিত দলের খেলার দিন বিবেকহীনতা ঘিরে রাখে এদেশীয় পাগলা সমর্থকদের। খেলার আগে/পরে মিছিল, খেলা নিয়ে ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, হামলা এমনকি খুন পর্যন্তও হয়।
সমর্থকরা এক হয়ে মোটর সাইকেল শোডাউন, রাষ্ট্রীয় আইনী বাধাস্বত্তেও নিজের দেশের পতাকা থেকে শত বা হাজারগুণ বড় পতাকা বানিয়ে এলাকা ঘুরা, গাছে,রাস্তায় অথবা বাসায় টাঙানো। নিজের বাসার রঙ প্রিয় দেশের পতাকার রঙে রঙ্গিন করা কি না হয় এ দেশে? এ অন্ধত্ব দিয়ে দেশ, জাতি কিংবা নিজের কোন উপকার হয় না।
বিশেষ করে খেলা চলাকালীন সময়ে যে পরিমাণ উগ্র আচরণ করা হয় তা ছাড়িয়ে যায় অন্য সকল কিছুকে। তর্কাতর্কি করে খুন, হার্ট স্ট্রোক, এমনকি অনেকে আত্মহত্যার মতো নিচ এবং আত্মঘাতী কাজ করে বসে।প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যম যার জ্বলন্ত প্রমাণ।খেলা দেখার জন্য খোলা মাঠে জড়ো হয়ে হৈ-হুল্লোড় করা, রাস্তার পাশে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করে রাস্তা বন্ধ করে খেলা দেখা। গোল হলে এতো উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ করা যা বৃদ্ধ, অসুস্থ ও শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শোরগোলের যন্ত্রণায় সাধারণ মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়া ভুতুজেলা ও খেলা পরবর্তী মিছিল-শোভাযাত্রা তো আছেই।
রাষ্ট্রীয় আইনী বাধাস্বত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের দেশের পতাকা থেকে বড় পতাকা বানাচ্ছে এবং বাসা-বাড়ির ছাদ, গাছ এবং রাস্তায় লাগাচ্ছে। দশ বিশ হাত থেকে শুরু করে হাজার হাত পরিমাণ এমনকি এক কিলোমিটার লম্বা পতাকা বানিয়ে অন্ধত্বের প্রকাশ করছে।
খেলার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আবেগের কারণে সময় ও অর্থ নষ্ট করতে দু'বার ভাবছে না।নিজ দলের সমর্থক বাড়ানো, খেলা নিয়ে তর্ক, হামলা করে জানমালের ক্ষতি করতে দ্বিধা করছে না যা অসুস্থ বিবেকের পরিচায়ক। সারাদেশে ব্রাজিল আর্জেন্টিনাসহ অন্যান্য দলের সমর্থকদের শত শত মোটরসাইকেল শো ডাউন ও মিছিল হয়েছে। এ পর্যন্ত শুধু এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে শতাধিক হামলা, অন্তত দশটা খুন এবং আত্নহত্যার ঘটনা ঘটেছে যা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
আমাদের সাধারণ নাগরিক এবং যুবসমাজকে বুঝাতে প্রয়োজন গণসচেতনতা তৈরি করা। জ্ঞান বিজ্ঞানের পিছিয়ে থাকলেও খেলার অন্ধ আবেগ প্রকাশ করাতে আমরা অনেক এগিয়ে।
আমাদের বিশবিদ্যালয়গুলো পড়ালেখা/গবেষণায় হাজারের ভিতরে যায়গা না পেলেও আলপনা আঁকা আর খেলা দেখার প্রতিযোগিতায় প্রথম সারিতে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। রাজনৈতিক, ধর্মীয়,শিক্ষা ও গণসচেতনতার সমাবেশে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী ও যুবকরা স্বতঃস্ফূর্ত না থাকলেও খেলা দেখার ক্ষেত্রে কোন কৃত্রিমতা নেই। পড়ালেখার জন্য বিশবিদ্যালয়ে আসলেও আড্ডা, বন্ধবী, গ্রুপিং আর খেলা নিয়ে মত্ত বেশীরভাগ শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বিনা দাওয়াতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এক হওয়া জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থার জানান দিচ্ছে। খেলাকে যদিও বলা হয় বিনোদন কিন্তু আমাদের দেশীয় পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা।খেলা এখন শুধুমাত্র বিনোদনের পর্যায়ে নেই। তা আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রন করে, ভাইয়ে ভাইয়ে, স্বামী স্ত্রীয়ের মাঝে দ্বন্ধ বাধায়। দলের অন্ধ সমর্থন দেখাতে গিয়ে তর্ক করে আমরা আমাদের পারস্পরিক হৃদ্যতা নষ্ট করছি।অন্য দলের সমর্থকের কথা শুনার মতো ধৈর্য্য আমাদের নেই। দিনদিন আমরা পরমতসহিষ্ণুতা ত্যাগ করে অসিহষ্ণুতা গ্রহণ করছি ।ভাবা যায়!
পারিবারিক কলহও বাড়ছে খেলার কারণে। অনেকেই খেলা দেখার জন্য অফিস কামাই করছে। অফিস, স্কুল ছূটি দেয়া, কলকারখানা, দোকান বন্ধ রাখা সবকিছুই আমরা করছি। অথচ ইউরোপ, আমেরিকা, মিডিল ইস্ট অথবা যারা বিশ্বকাপ খেলছে সে দেশগুলোতে এমন পাগলামির উদাহরণ, উগ্রতা, অন্ধত্ব, সস্তা আবেগ খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।তারা সবাই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, খেলা-পতাকা টাঙানো, মিছিল এগুলোতে তারা নেই। হামলা খুন করা তো স্বপ্নেও ভাববে না অথচ আমরা কি করছি?
এহেন অবস্থায় গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি উগ্রতা বন্ধে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এগিয়ে আসার পাশাপাশি আইনী সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।লেখকরা লেখার মাধ্যমে, সাংবাদিকরা এ সংক্রান্ত খবরের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে, প্রকাশক-সম্পাদকরা জাতির কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে সুন্দর পদক্ষেপ নিতে পারেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টা জাতিকে মুক্ত করতে পারে এক অহেতুক ক্ষতিকর নেশা থেকে। আশা করি সবাই এগিয়ে আসবেন।
-এটি