আবু তালহা তোফায়েল জালেমরা যা করছে সে সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে উদাসীন ভেবো না, তিনি তাদের ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন ওই দিন পর্যন্ত যেদিন চোখগুলো সব আতঙ্কে বড় বড় হয়ে যাবে।"(সূরা ইবরাহীম-৪৩)
এমনই ছিল তোমার রবের ধরপাকড়, যখন তিনি ধরেছিলেন ওই জালেম বসতিগুলোকে! নিশ্চয়ই তার ধরা অনেক কঠিন যন্ত্রণাময়। (সূরা হুদ-১০২) তোমরা জুলম বা অন্যায় করা থেকে বিরত থাকো। এই জুলম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে। (মুসলিম) আল্লাহ পাক জালিমকে ছাড় দিতে থাকেন- তারপর যখন ধরেন তখন আর তাকে কোনো সুযোগ দেন না। (বুখারী)
জালিম শব্দটি আরবি। ‘আজ-জুল্মু’ মাসদার বা শব্দমূল থেকে উদগত। যার আভিধানিক অর্থ ‘অত্যাচার করা, উৎপীড়ন করা, নিপীড়ন করা, নির্যাতন করা, দুর্ব্যবহার করা।’
পরিভাষায়: যেসব মানুষ কারো প্রতি অত্যাচার, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার করে তাদেরকে জালিম এবং যাদের প্রতি তা করা হয় তাদেরকে মাজলুম বলে। কারো কারো মতে- জুলুম শব্দের অর্থ আল-জাওরু (অত্যাচার করা) বা আদামুল ইনসাফ (অবিচার করা)। পরিভাষায় কোনো বস্তুকে তার উপযুক্ত স্থানে না রেখে বরং অন্য স্থানে রাখাকে জুলুম বলে। আর অত্যাচারীকে জালিম এবং অত্যাচারিতকে মাজলুম বলে।
পৃথিবীর সকল ধর্ম মতেই জুলুম করা অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জালিম অপরাধী, আর মজলুম অনুগ্রহ পাওয়ার অধিকারী। বিচারের আওতাধীন জালিম শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আর এটাই আল্লাহর বিধান। বিচারের মুখোমুখি হলে মাজলুম যদি জালিমের অত্যাচারকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে সে (জালিম) ক্ষমা পেতে পারে, অন্যথায় কারও অধিকার নেই এই জালিমকে ক্ষমা করে দেওয়ার।
সম্প্রতিসময়ে একজন আলেম চেয়ারম্যানের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সাড়া পাচ্ছে, আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে, পক্ষে-বিপক্ষে দলিলাদিও পেশ করা হচ্ছে।
তিনি বলেছেন তার দল যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে শাপলা চত্বরের বিচার করা হবে না, ক্ষমা করে দেওয়া হবে, ইত্যাদি। অনেকে দলিল হিসেবে বলে থাকেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কী জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, সর্বশেষ জন্মভূমি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেছেন। এমন কোনো অত্যাচার বাকি থাকেনি, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামদের উপর প্রয়োগ করা হয়নি। তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান তৈরী করে অষ্টম হিজরিতে মক্কা মুকাররমাহ স্বাধীন করেন, মক্কা বিজয় করেন। এসময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করে কাফির মুশরিকদের ক্ষমা করে দেন।
ইসলাম কখনও আবেগ দিয়ে বুঝা যায় না, কুরআন-হাদীসের মাধ্যমে বুঝতে হয়, এতে আপনার বুঝে আসুক বা নাই আসুক। এটা মেনে নেওয়ার নামই ইসলাম। আল্লাহ যদি কাউকে ক্ষমা করে না দেন, তাহলে পৃথিবীর কারও সাধ্য নেই তাকে ক্ষমা করার।
মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদিও আমভাবে ঘোষণা করে দেন যে, তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। তারপরও রাসুল সা. অল্পকিছু সংখ্যক মুশরিকদের নাম আলাদাভাবে তালিকাভুক্ত করে দেন এবং বলে দেন এদের যে যেখানে পাবে, তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে, এমনকি তারা যদি কাবার গিলাফে ধরে ঝুলেও যায়, তবুও তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।
যেই নবী একদিকে ক্ষমার ঘোষণা করলেন, সেই নবী কিছু মুশরিকদের ব্যাপারে এতো কঠোর কেন? কারণ হচ্ছে ইসলাম সব অপরাধীকে একচোখে দেখে না।
চুর একজন অপরাধী, ধর্ষকও একজন অপরাধী, খুনিও অপরাধী এবং রাজাকারও একজন অপরাধী। রাষ্ট্র সব অপরাধীকে একভাবে দেখে না। কারও ব্যাপারে একেবারে জিরো টলারেন্সে নেমে আসে, তার কোনো আপিলও গ্রহণ করে না। অর্থাৎ তার পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।
ঠিক এভাবেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কিছু মুশরিকদের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। নির্দেশ দিলেন এদেরকে যেখানেই পাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।
এমনই একজনকে উসমান রা. নিয়ে আসলেন রহমাতুললিল আ-লামিনের কাছে। যার নাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালিকাভুক ছিলো।
নবী সা. তাকে দেখে চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসলেন, তিনি ক্ষমা করেছেন কি না, তাও বলছেন না, মাথাও তুলছেন না। কিছুসময় পর তিনি সা. মাথা তুলে তাকে ক্ষমার ঘোষণা দেন এবং সে চলে যাবার পরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি যখন মাথা নিচু করে বসলাম, তখন তোমরা তার গর্দান কেনো উড়িয়ে দিলে না।
সাহাবারা রা. বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ আপনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেই তার গর্দান উড়িয়ে দিতাম। (চোখের ইশারা তো সমাজের থার্ডক্লাশের মানুষের স্বভাব, এটা শেষ নবীর অভ্যাস না।) যদিও নবী সা. তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, কিন্তু হৃদয়ের আকাঙ্খা ছিলো তাকে হত্যা করার এটা ত স্পষ্ট। সব অপরাধ এক না। চাইলেও যে কাউকে যে কেউ ক্ষমা করে দিতে পারে না।
যেমন ইসলামের একটি নির্দেশনা হচ্ছে ‘কিসাস’। মূলতঃ মৃত্যুর বিনিময়ে মৃত্যু, কিংবা কোন ধরণের জখমের বিনিময়ে অনুরুপ জখমের পরিভাষা হলো ‘কিসাস’ বা ‘অনুরুপ প্রতিশোধ’। ইসলামী অপরাধ আইনের গুরুত্বপূর্ণ এই পরিভাষাটি সরাসরি কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়ে, তাবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে তার জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। হে বুদ্ধিমানগণ, কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে জীবন রয়েছে যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।” (সূরা বাকারাহ, ২: ১৭৮-১৭৯)
“আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখম সমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।” (সূরা মায়েদাহ, ৫: ৪৫)
এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কেউ কাউকে মেরে ফেললে বিচারের বেলায় তাকেও হত্যা করা হবে, একজন তোমার চোখ উপড়ে ফেলেছে- ফলে তারও চোখ উপড়ে ফেলা হবে, কেউ তোমার কান-নাক-হাত-পা কেটে দিয়েছে- এর বদলে তাকেও তার কান-নাক-হাত-পা কেটে দেওয়া হবে। আর এটাই হচ্ছে ইসলামের নির্দেশনা।
এখন যদি কারও সন্তানকে হত্যা করা হয়, যে হত্যা করেছে সে হচ্ছে জালিম, এই জালিমের ব্যাপারে ইসলামিক নির্দেশনানুযায়ী ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কারও নেই একমাত্র যার সন্তানকে হত্যা করেছে তার বাবা ছাড়া।
এতে বাবা তার সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে ফিদিয়া তথা প্রাণের মূল্য একশত উটের মূল্যের সমমান সম্পদের বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, অথবা মূল্য ছাড়াও হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কেউ একজন আমার চোখ উপড়ে দিয়েছে, কান কেটে দিয়েছে, হাত-পা কেটে দিয়েছে, তাকে ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র আমার রয়েছে। কারণ সে জালিম আর আমি মজলুম।
আমি ছাড়া অন্য কেউ তাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি চাইলে আমার প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিনিময়ে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে দিতে পারি এবং চাইলে ক্ষমা করে দিতে পারি। যেখানে তোমার কিছুই নেই, সেখানে তুমি ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়াও একধরনের জুলুম। বস্তুত জালিমকে একমাত্র মাজলুমই ক্ষমা করার অধিকার রাখে বা ক্ষমা করে দিতে পারে, আর কেউ না।
লেখক: তরুণ আলেম ও সাংবাদিক।
-এটি