আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: যেহেতু দীর্ঘ সময়ব্যাপী ওয়ায সাধারণ মানুষ মনে রাখতে পারে না। এজন্য রাত ১০/১১টার মধ্যেই আলোচনা করে মাহফিল শেষ করা উচিত।
আজকাল অনেক স্থানে সারা রাত ওয়ায করার নিয়ম চালু হয়ে গেছে। এটা বন্ধ করা উচিত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ততক্ষণ ওয়ায করতে বলেছেন যতক্ষণ লোকদের আগ্রহ থাকে। আর সাধারণত মানুষের কমজোরীর কারণে সারা রাত আগ্রহ থাকে না। উপরন্তু এ দীর্ঘ রাতজাগা ওয়ায প্রত্যুষে অধিকাংশ শ্রোতারই মনে থাকে না! (বুখারি শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭)
দুর-দুরান্ত পর্যন্ত না দিয়ে মাহফিলের মাইক ব্যবস্থা প্যান্ডেলের সীমার মধ্যে রাখা আবশ্যক। যেন আগ্রহীরা ময়দানে চলে আসে এবং ব্যস্ত, অসুস্থ, ইবাদাতে মগ্ন ব্যক্তিদের কাজে, বিশ্রামে কিংবা ইবাদাতে বিঘœ না ঘটে। কেননা, কথা কিংবা কাজে ব্যস্ত লোকাদেরকে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় দ্বীনী নসীহত করতে হাদীসে পাকে নিষেধ করা হয়েছে। যেহেতু এর দ্বারা সে বিরক্ত হবে এবং তার কাজে বিঘœতা সৃষ্টি হবে। (বুখারী, হাদীস নং ৬৩৩৭)
ওয়াজের মাঝে স্থানীয় মসজিদসমূহের সময়সূচী অনুযায়ী ইশার নামায জামা‘আত করে নিতে হবে। কেননা, আগে-পরে ইশার নামায আদায় করলে মাহফিলের মাইকের দ্বারা পার্শ্ববর্তী এলাকার মসজিদের জামা‘আতের সমস্যা হয় এবং মাহফিলে উপস্থিত মুসল্লীগণ ইশার জামা‘আতের ব্যাপারে পেরেশান হয়।
অনেক স্থানে দীর্ঘ রাতব্যাপী ওয়ায হওয়ার পর ইশার নামায মাকরুহ ওয়াক্তে পড়া হয়। যা অবশ্য পরিত্যাজ্য। (সুরায়ে নিসা: ১০৩, বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬২৪৫)
লোকদের ওয়ায মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে তাদের থেকে চাঁদা কালেকশন করবে না। কারণ প্রচারপত্রে ওয়ায শুনানোর ঘোষনা বা ওয়াদা করা হয়। চাঁদার প্রয়োজন হলে জনসাধারণদের ডেকে পরামর্শ সভা করবে। এবং সাহায্যের আবেদন করবে। (সূরায়ে বাকারা: ৪০)
ওয়াজের শেষে আম দাওয়াত ও শিরনী তাবরকের নামে কোন কিছু বিতরণের ব্যবস্থা করবে না। এতে লোকদের তাওয়াজ্জুহ ওয়াজের দিকে না থেকে খানার দিকে থাকে। সেক্ষেত্রে বয়ানের দ্বারা কোন উপকার হয় না। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ২৬৯৭, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৭১৮, রদ্দুল মুহতার: ২/১৪০)
ওয়ায মাহফিল জমানোর জন্য কুরআন তিলাওয়াত করাবে না। কারণ এ কাজের জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। এর পরিবর্তে গজল ইত্যাদি পড়তে পারবে বা ছাত্রদের বিভিন্ন প্রদর্শনী পেশ করতে পারে। নিয়মিত বয়ান- ওয়ায শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে খায়ের ও বরকতের জন্য তিলাওয়াতের দ্বারা শুরু করবে।
তিলাওয়াতের সময় সকলেই কুরআন তিলাওয়াতে মনযোগ দিবে ও তিলাওয়াতের আদবের দিকে লক্ষ্য রেখে শুনবে। (আলমগীরী:৫/৩১৫, রদ্দুল মুহতার: ১/৫১৮)
চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল করবে না । এতে লোকদের কষ্ট দেয়া হয়, যা শরী‘আত বিরোধী কাজ। সুতরাং মসজিদ বা কোন মাঠ-ময়দানের মধ্যে মাহফিলের ব্যবস্থা করবে । (যিকর ও ফিকর: ১৪৩)
মাহফিলের রাস্তার মধ্যে কোন গেইট বা তোরণ বানাবে না। রঙ বেরঙের পতাকা লাগাবে না। নিছক বিলাসিতা ও শৌখিনতার জন্য রঙবেরঙের বাহারি বাতি জ্বালানো বা তোরণ নির্মাণ করার দ্বারা ধর্মীয় গাম্ভীর্যতা এবং আধ্যাত্মিকতা নষ্ট হয়।
এ ধরণের আয়োজন অগ্নীপূজক ও মূর্তিপূজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপরন্তু তা অপচয়ের শামিল। বিজাতীয় অনুকরণ আর অপচয় সম্পূর্ণ হারাম! (সূরায়ে বনী ইসরাইল: ২৭, ইবনে মাজা হাদীস নং ৪২৫, যিকর ও ফিকর: ২৫)
অনেক বক্তা চা পানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষে লোকদেরকে মীলাদ-দুরূদে লাগিয়ে সে সুযোগে চা পান করেন । এটা দৃষ্টিকটু কাজ। দীনী উদ্দেশ্যবিহীন এ ধরণের দরূদ পড়াও নিষেধ। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)
মাহফিলের কোন ছবি এবং কোন প্রকার ভিডিও করবে না। কাউকে করতে দিবে না; বরং সকলকে নিষেধ করবে। এগুলো সব হারাম। এতে দীনী মাহফিলের লক্ষ-উদ্দেশ্য বরবাদ হয়ে যায় এবং বদ দীনী ও গোমরাহী কায়েম হয়। (বুখারী শরীফ: ২/৮৮০, মুসলিম শরীফ: ২/২০০)
মাহফিলের পোস্টার, লিফলেট বা প্রচারপত্রে দিন, তারিখ ও স্থান উল্লেখ করবে। বক্তাদের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। মানুষদেরকে ব্যক্তির আকর্ষণে জমা করবে না। বরং দীনের আকর্ষণে জমা করবে। কারণ ব্যক্তি চিরকাল থাকে না। এমনকি (আল্লাহ না করুক) অনেক ব্যক্তি হকের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়ে যাবে! [আল্লাহ হিফাযত করেন। আমীন!] (মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং ১৯৩)
কোন বক্তার আগমনে না‘রায়ে তাকবীর বা অন্য কোন শ্লোগান দিবে না । এটা সুন্নাতের খেলাফ। বিশেষ করে ওয়াজের মধ্যে কোন বক্তার আগমনে বক্তার বয়ান বন্ধ করে কোন কথার শ্লোগান দিবে না।
কুরআন-সুন্নাহ এর আলোচনা অনেক উচু কাজ। কারো আগমনে তা বন্ধ করার অবকাশ নাই। কোন বক্তার ব্যাপারে “প্রধান আকর্ষণ”, “জলসার মধ্যমনি” ইত্যদি বলে অন্যান্য উলামাদের হেয় করবে না। কারণ সকলেই হক্বানী আলেম এবং সম্মানিত। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬৩৩৭, ফাতহুল বারী: ১১/১৬৭)
সিএনজি অটোরিকশার মতো যানবাহন যেসব রাস্তায় চলে, এর আশপাশে যদি কোনো মাহফিল হয়, তবে কখনো দেখা যায়, ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে এমন প্রতিটি যানবাহনকে মাহফিলের আয়োজকরা আটকিয়ে দিয়ে মাহফিলের জন্যে টাকা আদায় করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাত্রীদের কেউ টাকা না দেয়া পর্যন্ত ওই গাড়িটিকেও ছাড়া হচ্ছে না। অথচ কেউ যদি স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ না করে, তার কাছ থেকে যদি চাপাচাপি করে টাকা আদায় করা হয়, এ টাকা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম হবে! (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস নং ২০৬৯৫)
অনেক মাহফিলে মহিলাদের প্যান্ডেলে প্রজেক্টর স্থাপন করে মহিলা শ্রোতাদের জন্য বক্তাকে সরাসরি দেখার ব্যবস্থা করা খুবই আপত্তিকর একটি ত্রুটি। অথচ মহানবী স. এর প্রিয় স্ত্রী হজরত উম্মে সালামা রা. বর্ণনা করেন, একদা আমি এবং মাইমুনা (রা.) রসূলের (স.) কাছে ছিলাম। তখন সেখানে আগমন করলেন অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)।
রসূল (স.) আমাদের বললেন, “তোমরা তার থেকে আড়ালে চলে যাও।” আমরা নিবেদন করলাম, সে তো অন্ধ। আমাদের দেখবে না, চিনবে না। তাহলে আমরা আড়ালে যাব কেন? তিনি উত্তরে বললেন, “তোমরা তো অন্ধ না। তোমরা তো তাকে দেখবে।” (আবু দাউদ ঃ ৪১১৪)
এ হাদীস প্রমাণ করছে পুরুষদের জন্য যেমন অনুমতি নেই বিনা প্রয়োজনে পরনারী দেখার তেমনি নারীদের জন্যও অনুমতি নেই বিনা প্রয়োজনে পর-পুরুষকে দেখার।
ওয়ায মাহফিলে মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গ
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বীনের জরুরী ইলম শিক্ষা করা নারীদের উপরও ফরয। তবে এর শরীআতসম্মত পদ্ধতি হলো ঘরের পুরুষরা দ্বীন শিখে তাদের নারীদেরকে শেখাবে। নারীরা শিখে ঘরের মেয়েদেরকে অনুরূপভাবে আশপাশের মেয়েদেরকে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ শেখাবে, প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল শেখাবে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের রচিত কিতাব থেকে ওয়ায-নসীহত শুনাবে। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মাহরাম পুরুষের তত্ত্বাবধানে হক্কানী আলেম ও বুযুর্গদের ঘরোয়া পরিবেশে এনে পর্দা-পুশিদার সাথে ওয়ায -নসীহত শুনবে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একবার কিছু সংখ্যক নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মজলিসে পুরুষদের সাথে বসতে পারি না। আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন, যাতে সেদিনটিতে আমরা আপনার থেকে নসীহত শুনতে পারি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন موعدكن بيت فلانة অর্থাৎ নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করলেন। -(সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৪১)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে যদিও নারীরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মত ইমামের পেছনে নামায পড়ার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণে মসজিদে নববীর জামাতে অংশগ্রহণ করত। তথাপি তার জন্য বেশ কিছু শর্ত ছিল। যেমন, ১. পূর্ণ পর্দার সাথে আসতে হবে। ২. সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না।
৩. সাজসজ্জা পরিত্যাগ করতে হবে। ৪. রাতে আসবে, দিনে আসবে না। ৫. মহিলারা সবার পরে আসবে এবং নামায শেষে পুরুষদের আগে বের হয়ে যাবে। ৬. কোনো অবস্থাতেই পুরুষদের সাথে মেলা-মেশার আশঙ্কা না থাকতে হবে। উপরন্তু, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হায়াতেই মহিলাদের মসজিদে নববীতে না এসে নিজের ঘরের অন্দরমহলে নামায পড়ার জন্য তাকীদ করতেন।
একদা হযরত উম্মে হুমাইদ রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে নামায নামায পড়তে ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে নামায পড়তে ভালবাস। কিন্তু তোমার ঘরে নামায তোমার বাইরের হুজরায় নামায অপেক্ষা উত্তম।
আর তোমার হুজরায় নামায তোমার বাড়ীতে নামায অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার বাড়ীতে নামায তোমার মহল্লার মসজিদে নামায অপেক্ষ উত্তম। আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামায আমার মসজিদে নামায অপেক্ষা উত্তাম। অত:পর উক্ত মহিলা নিজ ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামাযের স্থান নির্ধারণ করে নিল এবং আমরণ তাতেই নামায আদায় করল। (মুসনাদে আহমাদ (হাদিস নং ১৭০৯০), সহীহ ইবনে খুযাইমা (হাদিস নং ১৬৮৯) ও সহীহ ইবনে হিব্বান (হাদিস নং ২২১৭)
অতঃপর নবীজীর ইন্তিকালের পর সামাজিক পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনের কারণে সাহাবায়ে কেরাম মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেন এবং মহিলারাও মসজিদে আসা বন্ধ করে দেয়। উম্মাহাতুল মুমিনীন এবং অন্যান্য মহিলা সাহাবীদের তাকওয়া- তহারাত, খোদাভীতি যা প্রবাদতুল্য, এবং পরবর্তীযুগের নারীদের জন্য যারা হলেন আদর্শ তাঁদের ব্যাপারে যদি এমন নিষেধাজ্ঞা হয়, তাহলে এমন ফেতনা-ফাসাদের ব্যাপকতার যুগে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেপর্দার সাথে দুর-দুরান্ত থেকে মহিলাদের উক্ত সম্মেলনে যাতায়াত কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে?
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীনী মাহফিল করার তাওফীক দান করুন এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন॥ ইয়া রাব্বাল আলামীন।
-এটি