যোবায়ের ইবনে ইউসুফ
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। ইসলামের বিধানগুলো প্রণীত হয়েছে মানুষের সুবিধা-অসুবিধা ও সার্বিক কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই। এই জন্য ইসলামের প্রতিটি বিধানেই নিহিত রয়েছে মানবজাতির জন্য সমূহ কল্যাণ।অন্যের দোষচর্চা, গিবত, অপবাদ বা কুৎসা রটনা অত্যন্ত গর্হিত ও জঘন্য কাজ। এই কাজগুলো সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে, বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে।
তাই মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে ইসলাম গিবত কে হারাম করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, সম্ভ্রম ও ধন-সম্পদ অন্য মুসলিমের উপর হারাম।' (বোখারি: ৫১৪৪, মুসলিম: ২৫৬৩, তিরমিজি: ১১৩৪, নাসায়ী: ৩২৩৯, আবূ দাউদ: ৩৪৩৮, ইবনু মাজাহ: ১৮৬৭, আহমাদ: ৭৬৭০)।
আরেক হাদীসে এসেছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একদা আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম, 'আপনার জন্য সাফিয়্যার এই এই হওয়া যথেষ্ট। (কোনো কোনো বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সাফিয়া বেঁটে।) এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমাকে) বললেন, তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সমুদ্রের পানিতে মিশানো হয়, তাহলে তার স্বাদ পরিবর্তন করে দেবে।' (রিয়াজুস সালেহীন: ১৫৩৩)।
গিবত পরিচিত
'গিবত কাকে বলে?' জনৈক সাহাবির এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'তোমার ভাইয়ের অগোচরে এমন কোনো কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।
বলা হলো, আমি যা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে (তাহলেও কি গিবত হবে)? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে, তাহলেই তুমি তার গিবত করলে। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তো তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিলে।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৪)।
গিবত সবচাইতে বড় সুদ
সুদ হারাম এবং অত্যন্ত গর্হিত কাজ। গিবত করাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বড় সুদ বলেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের মান-সম্মানে হস্তক্ষেপ করা ব্যাপকতর সুদের অন্তর্ভুক্ত (মহাপাপ)।' (সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৬)
গিবত ব্যভিচার থেকেও ভয়াবহ
গিবত ব্যভিচার থেকেও ভয়াবহ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিবত সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, 'গিবত জেনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক। কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু গিবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার গিবত করা হয়েছে সে ক্ষমা করে। (আলবানি, যয়িফুল জামি: ২২০৪)
গিবতের শাস্তি
১. মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া
গিবত করা কে আল্লাহ মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'তােমরা কারও গােপন দোষ-ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না। এবং তোমাদের একে অন্যের গীবত করবে না। তােমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গােশত খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তাে তােমরা ঘৃণা করে থাকো। তােমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়াময়। (হুজরাত: ১২)
২. ধ্বংস অনিবার্য
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ।’ (মুসলিম)। আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।...অবশ্যই তারা হুতামাতে (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে, দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।’ (সুরা হুমাজাহ: ১-৯)।
৩. নিজেকে নিজে ক্ষত-বিক্ষত করবে
মেরাজের রাতে রাসুল গিবতকারীদের শাস্তি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যখন আমাকে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, সে সময় এমন ধরণের কিছু মানুষের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিল তামার, তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষকে খামচে ক্ষত-বিক্ষত করছিলো। আমি প্রশ্ন করলাম, এরা কারা হে জিবরাঈল! তিনি বললেন, এরা সেই লোক, যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত ও তাদের সম্ভ্রম লুটে বেড়াত।' (বোখারি: ৬৫৮১, আবূ দাউদ ৪৭৪৮, রিয়াজুস সালেহীন: ১৫৩৪)।
গিবত থেকে বাঁচার জন্য করণীয়
১. চুপ থাকা।
গিবত থেকে বাঁচার সর্বোত্তম পন্থা হলো চুপ থাকা। প্রয়োজনীয় কথা ব্যতীত অন্য কোনো কথা না বলা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে; নচেৎ চুপ থাকে।' (বোখারি: ৬০১৮, মুসলিম: ৪৭, ১৪৬৮, তিরমিজি: ১১৮৮, আহমাদ: ৭৫৭১)।
২. জিহ্বা সংযত রাখা
মানুষের সাথে কথা বলার সময় খেয়াল রাখা, যেন কোনোভাবেই অন্যের গিবত না হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (অঙ্গ জিভ) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (অঙ্গ গুপ্তাঙ্গ) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।' (বোখারি: ৬৪৭৪, তিরমিজি: ২৪০৮, আহমাদ: ২২৩১৬)।
আরেক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'বান্দা আল্লাহ তাআলার সন্তোষজনক এমন কথা অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলে, যার ফলে আল্লাহ তার মর্যাদা উন্নীত করে দেন। আবার কখনো বান্দা অন্যমনস্ক হয়ে আল্লাহর অসন্তোষজনক এমন কথা বলে ফেলে, যার ফলে সে জাহান্নামে গিয়ে পতিত হয়।' (বোখারি: ৬৪৭৭, মুসলিম: ২৯৮৮, তিরমিজি: ২৩১৪, আহমাদ: ৭১৭৪)।
আরেক হাদীসে এসেছে, উক্ববাহ ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কিসে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব?’ তিনি বললেন, 'তুমি নিজ রসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। তোমার ঘর তোমার জন্য প্রশস্ত হোক। (অর্থাৎ অবসর সময়ে নিজ গৃহে অবস্থান কর।) আর নিজ পাপের জন্য ক্রন্দন করো।' (তিরমিজি: ২৪০৬, রিয়াদুস সালেহীন: ১৫২৮) ।
৩. অন্যের দোষ তালাশ না করা
অন্যের দোষ তালাশ না করা। অন্যের দোষ তালাশ করলে কখনোই গিবত থেকে বাঁচা সম্ভব হবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তােমরা কারও গােপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না।' (সুরা হুজুরাত: ১২)।
৪. অনুমান থেকে বেঁচে থাকা
যে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে অনুমাননির্ভর কথা না বলা। অহেতুক অনুমান পাপ। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হইয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়; এদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।' (সুরা বনী ইসরাইল: ৩৬)।
৫. কথা লিপিবদ্ধ হচ্ছে তা স্মরণ রাখা
যেকোনো কথা মুখ দিয়ে বের করার আগে এই স্মরণ রাখা যে, আমার সকল কথা লিপিবদ্ধ হচ্ছে। এই কথার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে, যে ( লেখার জন্য ) সদা প্রস্তুত।' (ক্বাফ: ১৮)।
৬. কম কথা বলা
কম কথা বলা। বেশি কথা বললে গিবত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ কারণে প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'আল্লাহর জিকির ব্যতীত অধিক কথা বলো না। কেননা আল্লাহ তা‘আলার জিকির শূন্য অধিক কথা বার্তা অন্তরকে শক্ত করে ফেলে। আর শক্ত অন্তরের লোক আল্লাহ থেকে সবচাইতে দূরে। (রিয়াজুস সালেহীন: ১৫২৬)।
৭. জিহ্বার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা
সুফয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার আমি নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কথা বাতলে দিন, যা মজবুত-ভাবে ধরে রাখব। তিনি বললেন, 'তুমি বলো, আমার রব আল্লাহ, অতঃপর তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। আমি পুনরায় নিবেদন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য আপনি কোন জিনিসকে সব চাইতে বেশি ভয় করেন?’ তিনি স্বীয় জিহ্বাকে (স্বহস্তে) ধারণ-পূর্বক বললেন, 'এটাকে।' (মুসলিম: ৩৮, তিরমিজি: ২৪১০, ইবনে মাজাহ: ৩৯৭২, আহমাদ: ১৪৯৯০)।
৮. খারাপ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া
গিবত থেকে বাঁচার জন্য সকল অনর্থক এবং বেহুদা বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে। তাহলে গিবত থেকে বাঁচা সম্ভব হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'তারা যখন কোন বেহুদা কথা শােনে, তা এড়িয়ে যায় এবং বলে, আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তােমাদের জন্য তােমাদের কর্ম। তােমাদেরকে সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।' (সুরা কাসাস: ৫৫)
৯. অন্যের দোষ গোপন করা
অন্যের দোষ গোপন করলে গিবত থেকে বাঁচা সম্ভব হয়। অন্যথায় গিবত হয়েই যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন, 'যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের আগুন থেকে তার চেহারাকে রক্ষা করবেন।' (তিরমিজি: ১৯৩১, মুসনাদে আহমাদ: ২৬৯৮৮)।
যে সকল ক্ষেত্রে দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়
মানুষের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ইসলাম যেমন অন্যের দোষ বর্ণনা করা হারাম করেছে, ঠিক তেমনই মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে কিছু ক্ষেত্রে অন্যের দোষ বর্ণনা করা বৈধও রেখেছে।
ইমাম নববী রহ. তার বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ 'রিয়াজুস সালিহীন' এর ২৫৪ পৃষ্ঠায় 'যে সকল কারণে গিবত বৈধ' এই শিরোনামে একটি অধ্যায় কায়েম করেছেন। সেখানে তিনি এরকম ছয়টা বিষয় উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা আলুসি রহ. তার জগত বিখ্যাত কুরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, 'তাফসীরে রুহুল মাআনী'র ১৪ তম খন্ডের ২৪২ পৃষ্ঠায় সূরা হুজরাত এর ১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়ও সেই ছয়টা বিষয় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও এ বিষয়ে প্রমাণ রয়েছে, 'মাওসুয়াহ ফিকহিয়া কুয়েতিয়্যাহ'র ৩১ নম্বর খণ্ডের ৩৩৫ ও ৩৩৬ পৃষ্ঠায়। 'আদদুররুল মুখতার' এর নবম খন্ডের-৫৮৬ ও ৫৮৭ পৃষ্ঠায়।
সেই ছয়টি বিষয় হলো:
এক. অত্যাচার বা নিপীড়নের ব্যাপারে অভিযোগ করা গিবত নয়। নিপীড়িত ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক বা এমন কোনো ব্যক্তির কাছে তার উপর নির্যাতনকারী ব্যক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করে, যে নির্যাতনকারীর উপর কর্তৃত্ব বা শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে, তাহলে এই অভিযোগ গিবত হিসেবে গণ্য হবে না। ইরশাদ হয়েছে, 'আল্লাহ কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে, সে কথা আলাদা।' (সূরা নিসা: ১৪৮)। অর্থাৎ নির্যাতিত ব্যক্তি তার উপর নির্যাতনের কথা অন্যের নিকট বলতে পারবেন।
দুই. মন্দ দূরীকরণ ও পাপীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য তার উপর কর্তৃত্বশীল কাউকে তার মন্দ বিষয়গুলো জানিয়ে সাহায্য চাওয়া গিবত নয়। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক অথবা মাজলুম। তিনি (আনাস রা.) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মাজলুমকে সাহায্য করবো, তা তো বুঝলাম।
কিন্তু জালিমকে কি করে সাহায্য করবো? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে। অর্থাৎ তাকে যুলুম করতে দিবে না।' (বোখারি- ২৪৪৪)। তবে কোন পাপীর পাপ সম্পর্কে কাউকে অবগত করা তখনই কেবল বৈধ হবে, যখন এটা কেবল পাপ থেকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই হবে। অন্যথায় এটাও গিবত এবং হারাম হিসেবে বিবেচ্য হবে।
তিন. ফতোয়া জানার জন্য কারো দোষ কোনো মুফতি বা বিজ্ঞ আলেমের নিকট বর্ণনা করে সমাধান জানতে চাওয়া গিবত নয়। যেমন: কেউ বলল, আমার পিতা, ভাই বা স্বামী আমার সাথে এই এই অন্যায় করেছে। এ ব্যাপারে আমি ইসলামের বিধান জানতে চাই! হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, আবূ সুফয়ানের স্ত্রী হিন্দ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন, 'আবূ সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। আমি তার সম্পদ থেকে [তার অজান্তে] যা কিছু নিই তা ছাড়া সে আমার ও আমার সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খরচ দেয় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তোমার ও তোমার সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ [তার অজান্তে] নিতে পারবে।' (বোখারি- ২২১১)। তবে এক্ষেত্রেও সতর্কতামূলক কারও নাম উল্লেখ না করা উত্তম। কিন্তু নাম উল্লেখ করাও জায়েজ আছে।
চার. মুসলিমদেরকে মন্দ থেকে সতর্ক করা এবং তাদের কল্যাণার্থে কারো দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, 'এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসার অনুমতি চাইলো। তিনি বললেন, তাকে অনুমতি দাও। সে নিজ বংশের অত্যন্ত মন্দ লোক।' (বোখারি: ৬০৩২)। মুসলিমদের মন্দ থেকে সতর্ক করা এবং তাদের কল্যাণ কামনা করার কয়েকটা সুরত হতে পারে:
(ক) দোষযুক্ত হাদীস বর্ণনাকারী ও বিচারকার্যে সাক্ষীর দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা গিবত নয়। সর্বসম্মতিক্রমে এটা শুধু বৈধই নয় বরং ওয়াজিবও। হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, 'একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আমার মনে হয় না যে, অমুক অমুক ব্যক্তি আমাদের দীন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে।' (বোখারি: ৬০৬৮)।
(খ) বৈবাহিক সম্পর্ক গড়া, ব্যবসায় অংশীদারি গ্রহণ, আমানত রাখা এবং প্রতিবেশী বানানো ইত্যাদি উদ্দেশ্যে কারো নিকট পরামর্শ চাওয়া হলে, পরামর্শদাতা যদি প্রকৃত অবস্থা খুলে বলে, তাহলে তা গিবত হবে না। বরং পরামর্শদাতার জন্য এটা আবশ্যক যে, তিনি সকল দোষ গুলোর প্রকাশ করে দেবেন। হাদীসে এসেছে, 'এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি জনৈকা আনসারী নারীকে বিয়ে করার ইচ্ছা করেছি (এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কি?)। তিনি বললেন, (বিয়ের পূর্বে) তাকে দেখে নাও। কেননা, আনসারী নারীদের চক্ষুতে কিছু দোষ থাকে।' (মুসলিম: ১৪২৪)।
(গ) যদি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে -চাই সেটা তার অযোগ্যতা, পাপাচার, উদাসীনতা কিংবা যে কোনো কারণেই হোক না কেন- ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো গিবত নয়। হযরত ওমর রা. তার শাসনামলে দায়িত্বশীলরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা, এ বিষয়ে তদারকির জন্য একটা বাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের খবর নেওয়ার জন্য তিনি সরাসরি জনসাধারণের সাথে কথা বলতেন। তাদের অভিযোগ শুনতেন।
পাঁচ. প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি এবং বেদাতি ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'ফাসিক ও প্রকাশ্যে গুনাহকারী ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করলে, তা গীবত হিসাবে বিবেচিত হবে না।' (জামেউল উসূল: ৮/৪৫০)। এ হাদীসটির অর্থ অনেকে উল্টোভাবে বুঝে। তারা মনে করে, কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি অথবা বেদাতে অভ্যস্ত ব্যক্তির গিবত যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবেই করা যাবে, এতে কোনো গুনাহ হবে না।
আসলে বিষয়টা এমন নয়। বরং যেই অন্যায় সে প্রকাশ্যে করে, শুধুমাত্র সেই অন্যায়ের বর্ণনা করাই বৈধ। তাও এই উদ্দেশ্যে যে, যেন তা অপনোদন সম্ভব হয়। পক্ষান্তরে তার অন্যান্য গোপন দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা বৈধ নয়। তবে যদি অন্য এমন কোনো কারণও থাকে, যার দ্বারা সাধারণ মুসলমান বিভ্রান্ত হয়, তাহলে তাও ব্যক্ত করা বৈধ হবে।
ছয়. প্রসিদ্ধ নাম ধরে পরিচয় দেওয়া গিবত নয়। কোনো ব্যক্তি যখন মন্দ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায় এবং ঐ নাম ছাড়া মানুষ তাকে চিনতে পারে না; তখন সেই প্রসিদ্ধ নাম ধরে তাকে ডাকলে কোনো অসুবিধা নেই। যেমন ঘটেছে প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. এর ক্ষেত্রে। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুর রহমান ইবনে ছখর। অথচ তিনি পরিচিত 'আবু হুরায়রা' নামে। যার অর্থ, বিড়ালের পিতা। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ২/৫৭৯)।
লেখক: মুহাদ্দিস: আল-জামিয়াতু সাকিনাতুল উলুম মহিলা মাদরাসা। কাঠালবাড়ি, শিবচর, মাদারিপুর। খতিব: ফুকুরহাটি মধ্যপাড়া জামে মসজিদ। নুরুল্লাগঞ্জ, ভাঙ্গা, ফরিদপুর।
-এটি