আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: পরিবেশবিষয়ক তথ্য অনুসন্ধান, অ্যাক্সেস ও বিশ্লেষণ করার শক্তিশালী মাধ্যম প্ল্যানেটারি কম্পিউটার। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক অনেক সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়।
বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ গিয়াসউদ্দিন জামশেদ মাসুদ আল-কাশি তাঁর আমলে একটি প্ল্যানেটারি কম্পিউটারের নমুনা তৈরি করেছিলেন। এটি চিত্র অঙ্কন করে চন্দ্র ও সূর্য এবং গ্রহগুলোর দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশের সত্যিকার অবস্থানের পূর্বাভাসসহ জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক বহু সমস্যার সমাধান দিতে পারত।
চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ সম্পর্কেও আভাস দিতে পারত। ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘দ্বিতীয় টলেমি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক সৈয়দ রকিম তাঁকে ‘মাওলানা-ই-আলম’ বা সারা বিশ্বের জ্ঞানী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৩৮০ সালে মধ্য ইরানের কাশানে তাঁর জন্ম। কাশানে জন্ম গ্রহণ করায় তিনি ইতিহাসে কাশি নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থার মধ্য দিয়ে কাশির শৈশব শুরু হয়।
তার জীবদ্দশায় তৈমুর লংয়ের উত্থান ঘটে। তৈমুর ১৩৭০ সালে সমরকন্দে নিজেকে স্বাধীন এবং মঙ্গল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। আধুনিক উজবেকিস্তানের সমরকন্দ তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ১৩৮৩ সালে তিনি বর্তমান আফগানিস্তানের হিরাত দখল করার মধ্য দিয়ে ইরানে তাঁর কর্তৃত্ব সমপ্রসারণ করেন। কাশির জন্মস্থান কাশানেও তৈমুরের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়।
তৈমুর লং একটির পর একটি সামরিক অভিযান চালাতে থাকায় তাঁর সাম্রাজ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য দেখা দেয়। নিজ দেশে ভিনদেশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়ায় ভাগ্যান্বেষণে কাশি এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এ সময় তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে চিকিৎসক হিসেবে তিনি তাঁর দ্বিতীয় পেশাও অব্যাহত রাখেন।
তৈমুর লংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শাহরুখ শাসনভার গ্রহণ করলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তিনি তাঁর রাজ্যে সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন। শাহরুখ ও তার পারসি স্ত্রী রাজকতোরি গৌহরশাদ বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিতে বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়ে যেতে থাকেন। শাহরুখ নিজের পুত্র উলুগ বেগকে সমরকন্দের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন। উলুগ বেগ ছিলেন একজন খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
তিনি সমরকন্দকে সংস্কৃতির একটি কেন্দ্রে পরিণত করার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুলতান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আট বছর পর ১৪২০ সালে উলুগ বেগ ধর্মশাস্ত্র ও বিজ্ঞান অধ্যয়নে সমরকন্দের রাজিস্তান চতুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মধ্যপ্রাচ্য ও তার বাইরের ছাত্ররা এখানে ভিড় করে। এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তিনি সেরা বিজ্ঞানীদের সহায়তা কামনা করেন। তখনকার দিনে রাজা, বাদশাহ ও শাসকদের কাছ থেকে বিজ্ঞানীরা পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাশির জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি ঘটে। উলুগ বেগ কাজী জাদাসহ ৬০ জন বিজ্ঞানীকে সমরকন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। আল-কাশিও ছিলেন তাদের একজন। কাশি সমরকন্দের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
উলুগ বেগের কাছ থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা পেতে থাকেন। তার দরবারে তিনি তার শ্রেষ্ঠ বইগুলো রচনা করেন। উলুগ বেগ ছিলেন তাঁর শিক্ষক। কাশি তাঁর সব কটি বই শাসকদের উৎসর্গ করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান। তিনি তাঁর জীবনের সব ঘটনা লিখে রাখতেন। আল-কাশি সমরকন্দ থেকে কাশানে তাঁর পিতার কাছে চিঠি লিখতেন।
এসব চিঠিতে তিনি সমরকন্দের বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক বর্ণনা উল্লেখ করতেন। কালের সাক্ষী হিসেবে চিঠিগুলো রক্ষা পাওয়ায় ঐতিহাসিকরা তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো নির্ভুলভাবে উল্লেখ করতে পেরেছেন।
কাশির চিঠিগুলোতে উলুগ বেগের গাণিতিক যোগ্যতার প্রশংসা করা হতো। কাজি জাদা ছাড়া সমরকন্দের আর কোনো বিজ্ঞানী তাঁর শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেননি। উলুগ বেগ সমরকন্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডাকতেন। খোলামেলা আলোচনা করা হতো। কাশি ও কাজি জাদা ছাড়া আর কেউ জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারতেন না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল সমস্যা সমাধানে কাশি সফল হতেন। তাতে এ কথা স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে তিনি ছিলেন সমরকন্দের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং উলুগ বেগের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কাশি রাজদরবারের আদব-কায়দা না জানলেও উলুগ বেগ তাকে অসম্ভব সম্মান করতেন। কাশি ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক বাণীতে লিখেছেন, ‘A remarkable scientist, one of the most famous in the world, who had a perfect command of the science of the ancients, who contributed to its development, and who could solve the most difficult problems.’
অর্থাৎ : তিনি ছিলেন একজন স্মরণীয় এবং বিশ্বের অতি খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, প্রাচীন বিজ্ঞানের ওপর যার দখল ছিল পরিপূর্ণ এবং যিনি এ বিজ্ঞানের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন এবং যিনি অত্যন্ত জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারতেন।
১৪১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কাশান নুজহা আল-আদায়েক (The Garden Excursion) শিরোনামে জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক একটি বই লেখা শেষ করেন। বইটিতে তিনি একটি প্ল্যানেটারি কম্পিউটারের বর্ণনা দেন। তিনি এ কম্পিউটারের নাম দিয়েছিলেন ‘প্লেট অব জোন্স’ (Plate of Zones)। যন্ত্রটিকে ‘প্লেট অব হেভেল’ (Plate of Heavens) নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
এ কম্পিউটার চিত্র অঙ্কন করে চন্দ্র ও সূর্য এবং গ্রহগুলোর দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশের সত্যিকার অবস্থানের পূর্বাভাসসহ। জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক বহু সমস্যার সমাধান দিতে পারত। চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ সম্পর্কেও আভাস দিতে পারত। দূরবর্তী বস্তু নিরীক্ষণে ব্যবহৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক যন্ত্র আলহাইডাড (AIhidade) এবং রুলারের সাহায্যে এ কম্পিউটার নির্মাণ করা হয়েছিল। আল-কাশি একটি ডাবল কোয়াড্রান্ট আজিমাথ এলটিচিউড যন্ত্র এবং এলহাইডাড সজ্জিত ক্ষুদ্র একটি আর্মিলারি স্ফিয়ারও উদ্ভাবন করেছিলেন।
তথ্য: স্বর্ণযুগে মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার : পৃষ্ঠা ৪০৭, জার্নাল অব দি আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি, [অ্যান ইসলামিক কম্পিউটার ফর প্ল্যানেটারি ল্যাটিটিউস; ই এস ক্যানেডি], জানুয়ারি-মার্চ : ১৯৫১, পৃষ্ঠা ১৮)
-এটি