শরীফ মুহাম্মাদ।।
বেফাকের একেকটি পরীক্ষাকেন্দ্র তখন অনেক মাদরাসা মিলিয়ে হতো। ১৯৮২/৮৩ সালের কথা। মাদরাসায়ে নুরিয়া আশরাফাবাদ কামরাঙ্গীরচরে বেফাকের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে ছাত্ররা এল বিভিন্ন মাদরাসা থেকে। সে-বারই প্রথম তাঁকে দেখলাম; তারা এসেছিলেন সম্ভবত মালিবাগ মাদরাসা থেকে। মেশকাত কিংবা দাওরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে।
আমরা তখন তাইসির কিংবা মিজান পড়ি। আগত ছাত্রদের থাকার জায়গা ছিল মসজিদের নির্মীয়মান পলেস্তরাহীন-দোতলায়। তখনো সম্ভবত তাঁর মাথায় হালকা বাবড়ি চুল ছিল। আছরের পর মাদরাসার পুকুর ঘাটে-মাঠে, চলাফেরার রাস্তায় দূর থেকে আগত ছোট-বড় ছাত্র ভাইদেরকে দেখতে পেতাম।
যতদূর মনে পড়ে, ওই বছর নুরিয়া মাদরাসায় বেফাক পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রধান নেগরান হয়ে এসেছিলেন আল্লামা সুলতান যওক নদভী (হাফিজাহুল্লাহ)।
মালিবাগ থেকে আগত (বেফাক পরীক্ষা উপলক্ষে) ওই সময়ের ছাত্রদের মধ্যে তিন জনের কথা মনে আছে; মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ, মাওলানা ইয়াহইয়া
মাহমুদ। প্রথম দুজন মেশকাত/ দাওরার একই জামাতের পরীক্ষার্থী ছিলেন আর শেষজন ছিলেন সম্ভবত শহরে বেকায়ার। পুকুরের 'ঘাটলা'য় দুই পাশে পাকা করা যে বেঞ্চি ছিল, অনেক সময় মওলানা হামীদুল্লাহ রহ. সেখানে বসে বিশ্রাম করতেন; আছরের পর, এশার পর। আগত ছাত্রদের কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে মুসাফাহা করতেন, কথা বলতেন।
আমাদের মাদরাসা ছাত্র-জীবনের মাঝামাঝি সময় থেকেই আবুল ফাতাহ সাহেব ও ইসহাক ফরিদী সাহেবরা নবীন শিক্ষক। ঢাকা শহরে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও উপলক্ষে বিভিন্ন সময়েই ইসহাক ফরিদী সাহেবকে দেখতাম।
ছাত্রজীবন, শিক্ষক জীবন কিংবা সাংগঠনিক সংযুক্তি-কোনো কিছুতেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না; বয়সের ব্যবধানসহ সমকালিনত্বের অংশীদার ছিলাম, এবং একটা সময়ের পর কিছুটা পরিচিতও ছিলাম, ব্যস এতোটুকু।
কিন্তু আমাদের সবুজ যৌবনের সময়ে ঢাকার বুকে উদ্যমী যুবক আলেম সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে যারা খুব উজ্জ্বলভাবে বিচরণশীল ছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি চৌধুরীপাড়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। লেখক অনুবাদক ছিলেন; ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও অনেক কাজ করতেন। জীবনের শেষ বেলায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিকভাবেও ব্যস্ত সময় কাটাতেন। এবং অদ্ভুতভাবে এসবগুলোর মধ্যেই সুন্দর সমন্বয় করতে পারতেন। প্রাণচঞ্চল হাসিমুখ কর্মতৎপর একজন তারুণ্যদীপ্ত মেধাবী আলেম ছিলেন।
আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ও মাওলানা ইসহাক ফরিদী-এ দুজনকে অনেক জায়গায় একসঙ্গে দেখেছি। তাদের পরস্পরের আলাপ ও সম্বোধনে অকৃত্রিম আবহ দেখেছি। আবুল ফাতাহ সাহেব তাঁকে বলতেন ‘ইসহাক’। আর ইসহাক ফরিদী সাহেব আবুল ফাতাহ সাহেব কে বলতেন ‘আবুল ফাতাহ ভাই’ অথবা ‘ফাতাহ ভাই’।
৪৮ বছর বয়সে ২০০৫-এর ৬ জুন রাতে (১৭ বছর আগে) কুমিল্লার কাছাকাছি একটি জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শহীদি মৃত্যু লাভ করেন।
সম্ভবত তিনি যাচ্ছিলেন তাঁর শায়েখ নানুপুর পীর সাহেবের কাছে। আলেম মহলে সবার পরিচিত, শীর্ষ আলেমদের স্নেহভাজন কর্মতৎপর মেধাবী যৌবনদীপ্ত এই আলেমেদ্বীনের আকস্মিক ইন্তেকালে সারাদেশে শোক ও সহানুভূতির এক কোমল বাতাস ছড়িয়ে পড়েছিল তখন। খুব আক্ষেপ বেদনা ও মমতার সঙ্গে তার কথা আলোচনা হতো অনেক দিন পর্যন্ত।
তাঁর কথা মনে হলেই দুটো স্মৃতির কথা খুব উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ে। চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় হাফেজ্জী হুজুর রহ, স্মারকগ্রন্থের জন্য লেখা চাইতে গেলে মেহমানদারি করেন, গল্প করেন, তাঁর স্নেহভাজন দু-একজন ছাত্রকে ডেকে আনেন এবং তাঁদের সামনে নবীন 'আলেম লেখক' হিসেবে আমাকে পরিচিত করেন। মজলিসের এই পর্বটিতে তাঁর আন্দাজ ও আয়োজন ছিল অত্যন্ত স্নেহশীল ও সম্মাননামূলক।
আরেকবার রাত ৯/১০টার দিকে প্রচন্ড যানজটের কারণে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে রাস্তার পাশ দিয়ে কুতুবখালির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ভিড় এবং আওয়াজ চারপাশে। হঠাৎ শুনি আমাকে কেউ ডাকছে, একটু পর এক মাদরাসার ছাত্র এসে আমাকে বললো, এই যে গাড়ির ভেতরে হুজুর বসে আছেন।
আমি ঘুরে তাকালাম, ঢাকার দিকে মুখ করা গাড়িতে মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ বসে আছেন। যানজটে সব রিকশা-গাড়ি থেমে আছে তখন। এগিয়ে গেলাম এবং অল্প কিছু কথা হলো।
তিনি তাঁর এলাকায় গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরছেন। আমাকে যেহেতু রাস্তার পাশে দেখেছেন এজন্যই একটু কথা বলা, সাধারণ খোঁজখবর নেওয়া।
আপন করে নেওয়ার এই সৌজন্য ও আলাপবোধ তাঁর মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণে ছিল বলেই মনে হয়। আল্লাহ তাআলা এই মেধাবী উদ্যমী আখলাকি কর্মতৎপর মনীষী আলেমকে জান্নাতের উঁচু মকাম দান করুন।
-এটি