শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আলোর বাতিঘর আল্লামা আহমদ শফী রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক।।

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। যুগে যুগে হকের মশাল হাতে নিয়ে কিছু মানুষের আগমন ঘটেছে এই ধরণীতে। তারা হলেন নবী-রাসূল অতঃপর তাদের প্রিয় উম্মত। আল্লামা আহমদ শফী রহ.ও ছিলেন হকের ঝান্ডাবাহী। যিনি ইসলাম, দেশ ও মানবতার অতন্দ্রপ্রহরী ও দরদী ছিলেন। নীতি আদর্শে ছিলেন অটল-অবিচল। কখনো ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের লোভে জলাঞ্জলি দেননি নিজের স্বকীয়তাকে। ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে ছিলেন অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদ।

২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার তিনি ইন্তিকাল করেন। এই মনীষীর মৃত্যুতে আলেমরা হারিয়েছেন তাদের সবচেয়ে প্রিয় অভিভাবক। আর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা খুইয়েছেন প্রিয় মুখ। ইন্তেকালের পরের দিন শনিবার বাদ জোহর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর জানাজায় শরীক হয় এবং দোয়া করেন। জানাজা শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণের কবরস্থানে চির শায়িত হন।

দেশের বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা চট্রগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত আল জামেয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী ১৯১৫ সালে চট্রগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম বরকত আলী এবং মা মরহুমা মেহেরুন্নেছা বেগম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। আল্লামা আহমদ শফী রহ. স্থানীয় মৌলভী আজিজুর রহমানের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। এরপর সরফভাটা মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন। আল-জামিয়াতুল আরাবিয়া ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করার পর ভর্তি হন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায়। পরে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে চলে যান ভারতের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দরুল উলুম দেওবন্দে। ওখানে চার বছরে দাওরায়ে হাদিস ও তাফসির কোর্স সম্পন্ন করেন। দেওবন্দে থাকাকালীন সময়ে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উস্তাদ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হযরত মাওঃ সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর হাতে ইসলাহেরজন্য মুরিদ হন, এবং অল্প সময়েই তাঁর খেলাফত লাভ করেন।

তিনি দেওবন্দ থেকে লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন প্রিয় প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদ্রাসায়। ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তিনি শীর্ষ আলেম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সত্য উচ্চারণে তিনি ছিলেন নির্ভিক আলেমদের অহংকার, বাতিলের আতংক, নাস্তিক মুরতাদের বিরুদ্ধে আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন খড়গহস্ত। বিজ্ঞ আলেমদের মৃত্যুতে ইলম উঠে যাওয়ার ভয় হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, শেষ জামানায় আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম টেনে বের করে নিবেন না বরং হক্বানী আলেমদের মৃত্যুর মাধ্যমেই ইলম উঠিয়ে নিবেন। অবশেষে যখন তিনি দুনিয়ায় কোন আলেমকেই বাকি রাখবেন না, তখন লোকেরা অজ্ঞ-মূর্খদের নেতারূপে গ্রহণ করবে, এবং তাদের নিকট মাসআলা জিজ্ঞাসা করবে আর তারা বিনা ইলেমেই ফাতওয়া দিবে ফলে নিজেরাও গোমরাহ হবে এবং অপরকেও গোমরাহ করবে। (মিশকাত)

আল্লামা আহমদ শফী রহ. নিজেই একটি ইতিহাস। বিজ্ঞ,বিদ্বগ্ধ এই আলেমে দ্বীন প্রকৃত ও সত্যিকারের ওয়ারিস ছিলেন নবীদের। রাসূলুল্লাহ সা. যে বলেছেন,“নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরী”। বস্তুত: আল্লামা শফী রহ. ছিলেন এই হাদিসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বিখ্যাত এই বুজুর্গের নিয়মিত ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বিভিন্ন খতমে বুখারীতে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনেছি, আকুতি-মিনতিপূর্ণ দোয়ায় শরীক হয়েছি। কিন্তু ২০১৪ সালের এক ঘটনায় আমি এখানো শিহরিত হই।

তখন হজ্ব মৌসুমে তাওয়াফ শেষে মাতাফ থেকে বের হয়েই আমার এক পরিচিত জনের সাথে দেখা। তিনি বললেন, হেফাজতের আমির হজ্বে এসেছেন। আমি তার থেকে হুজুরের ঠিকানা নিলাম। পরদিন আসর নামাজ পড়েই ছুটলাম মিসফালার সেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। মক্কায় যেহেতু আওয়াল ওয়াক্তে নামাজ হয় তাই আসর থেকে মাগরিব বেশ লম্বা সময়। গিয়ে হুজুরকে সালাম দিলাম, মুসাফাহা করলাম। হুজুর খাটের উপর বসা। আমি নিচে বসলাম। আপনার নাম কি? আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি লেখা-পড়া কোথায় করেছেন? তাঁর ‘আপনি’ ‘আপনি’ শব্দে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম। হযরতের এমন বিনয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম। এরপর তিনি নিজ হাতে আমাকে হাদিয়া আসা পাপড় ও খেজুর খাওয়ালেন। সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে। মাগরিব পর্যন্ত এই দ্বীনের রাহবারের সোহবতে ছিলাম। বিভিন্ন লোকজন এসে হুজুরের সাথে দেখা করলেন। তিনি তাদের সাথেও খোশগল্প করলেন। আমি শুধু সময়টা উপভোগ করলাম। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুক।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ