মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম আল খলীল।।
২০১৪ সালের এক বিকেল। হঠাৎ ছাত্র ভাইদের কাছে শুনলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. আসছেন। ঢাকার খিলগাঁও মাখযানুল উলূম মাদরাসায়। খতমে বুখারীর মাহফিলে। বুখারী শরীফের সর্বশেষ হাদিসের দরস তিনি দিবেন। তার আসার সংবাদটা শোনার পর থেকে আমার মাঝে অন্যরকম একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। মনের ভিতরে একটা সশ্রদ্ধ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। ছুটির বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হয়নি। আল্লামা শফী রহ. কথা শুনে হুজুর আর না করলেন না।
তাকে নিয়ে অনেক কিছুই ভাবছিলাম। তিনি কি সত্যিই আসবেন? তার সামনা-সামনি গিয়ে বসতে পারবো তো? কাছ থেকে তাকে দেখতে পাবো তো! এত বড় মাপের একজন ব্যক্তির কাছে যেতে পারা তো অবশ্যই সৌভাগ্যের বিষয়। মনকে আর বেশিক্ষণ মানিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার প্রিয় মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্য রওনা হলাম। গন্তব্য খিলগাঁও মাখযানুল উলুম মাদরাসা। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম। পুরো মাদরাসায় অন্যরকম একটা আয়োজনের আমেজ চোখে পরলো। মাদরাসার মসজিদ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। চারদিক থেকে দলে দলে মানুষ আসছে। হযরতের সোহবতে ধন্য হতে।
আমি মসজিদের একপাশে বসে পড়লাম আর তার আসার অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম। আচ্ছা তিনি কখন আসবেন? কোন দিক দিয়ে আসবেন? এই ভাবনার রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি এসে পড়লেন। অপেক্ষার আকাশে উদিত হল নতুন সূর্য। শ্রদ্ধা আর উত্তেজনাবোধ নিয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন কি যে ভালো লাগছিল আমার, তা শুধু অনুভবের বিষয়। বলে ব্যক্ত করা যাবে না। সে সময় তাঁর প্রতি অন্যরকম একটা মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি বিগলিত তনুমন নিয়ে তাঁর সামনে বসে ছিলাম। খুব জড়োসড়ো এবং ইতস্তত ভঙ্গিতে।
তিনি বুখারী শরীফের সর্বশেষ হাদিসের তাকরির শুরু করলেন। কোন দায় সাড়া ভাব নয়। বরং খুব আন্তরিকতার সাথে আলোচনা করছেন। আহ! কি মনকাড়া, হৃদয় জুড়ানো হাদিসের তাকরির। শুধু শুনতেই মন চায়। মুগ্ধতার আবেশে সময়টা কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। তার সেই খতমে বুখারী ও দরসে হাদিসের স্মৃতিগুলো এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। একটুও ভুলে যাইনি। তিনি এখন পরজগতের বাসিন্দা। তবু কল্পনার ডানায় ভর করে তাঁর কাছে নিজেকে ভাবতে বড়ো ভালো লাগে। তার বিনয়সুলভ মুগ্ধকারী তাকরিরগুলো আজও আমার কানে বাজে। সেই স্বর্ণালী সান্নিধ্যের ছোঁয়া আজো লেগে আছে অন্তরে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ.। শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসা মেশানো এক নাম। যে নাম শুনে চমকে উঠতো সবাই। মনের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো নাস্তিক্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ঈমান জাগানিয়া হুংকার "আমি শহীদ বা গাজী হওয়ার নিয়তেই বের হয়েছি" টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সবখানেই সরব ছিল এই নাম। নাস্তিক-মুরতাদরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তার আন্দোলনের মুখে। আল্লামা শাহ আহমদ শফী নামক সূর্যটি অস্তমিত হয়ে গেছে। ইহজগতে আর উদিত হবে না। যেই সূর্যটি আলো ছড়াতো সারা বাংলায়। যাকে দেখে আমরা বুকে সাহস যোগাতাম। আশার সঞ্চার হতো অন্তরে। এই বুঝি "নাস্তিকের হানা" ভেবে থরথরে কাঁপতো না বুক। কারণ সবাই ভাবতো আমাদের একজন অভিভাবক আছে। যে কারো রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করে না। ভয় পায় না তাদের তথাকথিত হুংকার আর চাপাবাজী। জানতাম তিনি চলে যাবেন। কারণ দুনিয়াতে কেউ চিরস্থায়ী হয় না। কিন্তু তাকে হারানোর বিচ্ছেদ, ব্যাথা আর শোক এত গভীর হবে তা কখনও ভাবিনি।
আমি ধন্য, চির গর্বিত যে, আমি তার যুগের মানুষ। এমন একজন ওয়ারীসে নবীকে আমি পেয়েছি এবং কাছ থেকে দেখেছি। তার ইন্তিকালে সারা দেশের মানুষ আজ শোকাহত হয়ে পড়েছে। শুধু দেশ নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাহিরেও। তিনি ছিলেন চেতনাধারী একজন আলেম এবং অভিভাবক। যার জ্ঞান-গরিমা, পাণ্ডিত্য এবং বুকটান করা সাহস জনশ্রুত। এক নামে যাকে চিনতো সবাই। হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালকের পরিচয় পর্যন্ত তিনি আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। দিক দিগন্তে তার খ্যাতি আর প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। হেফাজতে ইসলাম, বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশ, আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়াসহ অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তার তত্ত্বাবধান ও নেগরানীতে চলতো। হ্যাঁ, সত্যিই তার মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশেটা যেন আজ এতিম। অভিভাবক শুন্য। আহ! তার মতো স্বচ্ছ, নিষ্ঠাবান আর যোগ্য অভিভাবক কি আর পাবো?
ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন অমায়িক। বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রায় সবই ছিল তার মাঝে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। উচ্চতার সাথে মানানসই স্বাস্থ্য। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং। চোখের দৃষ্টিতে বলিষ্ঠ বিশ্বাস ও আস্থা। মার্জিত পোশাক-পরিচ্ছদ। কথাবার্তায় প্রজ্ঞা ও সরলতা। সোজাসাপ্টা কথা বলায় পারদর্শিতা। গরুগম্ভীর ভাব পরিহারকারী। সবমিলিয়ে জ্যোতির্ময় এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব। জীবনের ১০৪ বছরের সিংহভাগই ছিল হাটহাজারী মাদ্রাসার এরিয়ায় সীমাবদ্ধ। যার শুরু ও শেষটাও হয়েছে সাদা কালো কওমি শিবিরে। নিজের বর্ণাট্য জীবনে দুহাত ভরে এনে দিয়েছেন সাফল্যের মালা। দিয়েছেন নেতৃত্ব। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তার ইন্তেকালের সংবাদ শুনি। সংবাদটা শোনামাত্র আমার ভিতরটা যেন চুরমার হয়ে গেল। এক এক করে বড়রা সবাই চলে যাচ্ছেন। আমাদের মাথার উপরে ছায়াগুলো দিন দিন সংকীর্ণ হতে চলেছে।
ইন্তেকালের খবর শোনার পর থেকে মনে বড় একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। ভাবনা আর কল্পনার জগতে বাসছিলাম, তার জানাজায় শরিক হতে পারব তো? শেষ বিদায় কি তাকে কাছ থেকে জানাতে পারবো? এটা আমার জন্য কল্পনাই বলতে হয়। কারণ হাটহাজারী যেতে পারবো তা কল্পনায়ও কখনো ভাবিনি। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা কি না করতে পারেন, তিনি তো সবকিছুই পারেন। তার অশেষ রহমতে অল্প সময়ের মধ্যেই হাটহাজারী যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। দেরি না করে রাতেই রওনা হয়ে গেলাম। সারা রাতের দীর্ঘ সফর শেষে হাটহাজারী পৌঁছে দেখি পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। জানাজা হবে বাদ জোহর কিন্তু মানুষের সমাগম রাত থেকেই শুরু হয়ে গেছে।
মানুষের ভিড় ঠেলে আমরা প্রবেশ করলাম তার চিরচেনা, সুখে-দুখের সঙ্গী প্রিয় প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদ্রাসায়। চারদিকেই শুধু মানুষ। তার দীর্ঘদিনের ভক্ত-সমর্থক আলেম-ওলামা ও তাওহিদী জনতা এসেছে তাকে শেষ বিদায় জানাতে। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা পোনে দুইটা। হাটহাজারী এলাকা আজ লোকে লোকারণ্য। স্মৃতির ভেলায় চেপে চট্টগ্রামের হাটহাজারী তখন ফিরে গেল যেন সেই ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল লংমার্চ এবং ৫ই মের ঢাকা অবরোধে। ঢাকার অলিতে গলিতে ঘুরে ফিরছে হেফাজত সমর্থক কর্মীদের চেনা মুখগুলো। তবে মলিন। নেই আগের সেই হাক-ডাক। নেই উচ্ছ্বাস। যেমনটা দেখা যেতো মিছিলে স্লোগানে। অজস্র চোখ গড়িয়ে পড়ছিল তার শোকের পানি। তার শোকের ছায়া পড়েছিল সবার গায়ে। বুকফাটা কান্নায় ভাসছিল তার ভক্তরা। আহ! স্বর্ণালী সান্নিধ্যের সেই মানুষটি আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
আজ দু বছর হয়ে গেল তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। অভিভাবক শূন্য জাতি এক ক্লান্তি লগ্ন পার করছে। এই সময়টাতে তার অভিভাবকত্বের অনেক প্রয়োজন ছিল। নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু। আমীন।
শিক্ষক: মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজকুনিপাড়া, তেজগাঁও ঢাকা
-এএ