মুহাম্মাদ ইশতিয়াক সিদ্দিকী: বহু ত্যাগ, আন্দোলন ও প্রতীক্ষার পর অবশেষে কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদের স্বীকৃতির বিল গেজেট আকারে প্রকাশ পেলো। দাওরায়ে হাদীসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী সাহিত্যে মাস্টার্স / এম এ'র মান প্রদান করা হলো। কওমী ঘরণার ছাত্র-শিক্ষকদের শঙ্কা, দূরাশা দূর হলো।
পর্যবেক্ষক ও ইসলামী ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, এ স্বীকৃতি খুব সহজে অর্জন হয়নি। এজন্য অনেক আলোচনা-আন্দোলন ও আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদল আর রাজনৈতিক কূটকৌশলে দাবী আদায়ে ব্যর্থ হতে হয়েছে বারবার।
সেই ১৯৮৫ সালের দিকে খতীবে আজম সিদ্দিক আহমদ রহ. এর মাধ্যমে কওমী অঙ্গনে সর্বপ্রথম কওমী মাদরাসা স্বীকৃতির আলোচনা উঠে। এরপর থেমে-থেমে আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারের পালা বদল, কওমী অঙ্গনে সনদের স্বীকৃতি নিয়ে অনাগ্রহ, শঙ্কা, অজ্ঞতা সর্বোপুরি বিষয়টি ঘোলাটে অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে।
২০০৬ সালে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রহ. এর আন্দোলনের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায়ে নতুন জোয়ার আসে। তবে ব্যাপক আলোচনা ও আন্দোলনের চাপে পড়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেই হাতে গুটিয়ে নেয় তৎকালীন জোট সরকার।
২০১২ সাল। সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ স্বীকৃতির ইস্যুতে চেষ্টা-তদবীর শুরু করেন। আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর সাথে সমন্বয় এবং বেফাক চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন।
যে সিঁড়িগুলো স্বীকৃতি এনে দিলো: দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতি অক্ষুণ্ণ রেখে এবং কওমী মাদরাসার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে সনদের স্বীকৃতি আদায়ে আগ্রহী হন বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক এর চেয়ারম্যান, হেফাজত আমীর আল্লামা আহমদ শফী।
এরই ধারবাহিতকায় ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এরপর হেফাজত আন্দোলন ও শাপলা ট্রাজেটির কারণে কওমী মাদরাসা ও আল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের সাথে দূরত্ব বাড়ে। ফলে আবারো থমকে যায় স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা ও কার্যক্রম।
এরপর স্বীকৃতি আদায়ে আবারো চেষ্টা তদবির শুরু হয়। আঞ্চলিক বোর্ডগুলোর দূরত্ব কমানো হয়। আল্লামা আহমদ শফীর দেয়া শর্তে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা : ২০১৭ সালের ১১এপ্রিল গণভবনে আল্লামা আহমদ শফী ও আঞ্চলিক বোর্ডপ্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামদের এক অনুষ্ঠানে কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার বক্তব্যে কওমী মাদরাসার গৌরবময় ঐতিহ্য ও ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন।
২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল। কওমী মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতির ভিত্তিতে কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীসকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়।
হাইয়াতুল উলয়া গঠন : ১৬ এপ্রিল ২০১৮ ইংরেজি। কওমী মাদরাসার সনদের মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে) প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারির পর শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসায় উক্ত কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে পরীক্ষা ও সনদের জন্য 'আলহাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' নামে একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এ বোর্ডের মাধ্যমে দাওরার পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদ ইস্যুতে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী সমীপে আল্লামা আহমদ শফীর বিশেষ চিঠি
১১জুন ২০১৮ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলেমদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে আমীরে হেফাজত আল্লামা আহমদ শফীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়।
চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আল্লামা আহমদ শফী বলেন, "কওমী মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ও দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি) এর সমমান প্রদান করা হলো ' আপনার এ যুগান্তকারী ঘোষণা দ্বারা একটি শুভ ইতিহাস ও সদকায়ে জারিয়া সূচিত হলো।"
চিঠিতে তিনি আরো বলেন, "আমি আমার বয়সের শেষপ্রান্তে উপনীত। আর কতদিন বেঁচে থাকবো একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন। কওমী মাদরাসার সনদের মানের আইনগত ভিত্তি রচিত হোক, এটাই আমার জীবনের সর্বশেষ কামনা। আপনার কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ, কালবিলম্ব না করে সনদের মান আপনার মন্ত্রীসভায় পাশ করতঃ আগামী সংসদ অধিবেশনে তা পাশ করিয়ে নেবেন।"
অবশেষে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন : আল্লামা আহমদ শফীর ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানিয়ে এবং কওমী শিক্ষার্থিদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতঃ ১৩ আগস্ট ২০১৮তে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে কওমী সনদের আইনের খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। দেশের শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দফায় দফায় বৈঠক করে 'কওমী মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদীসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান আইন ২০১৮' নামক আইনের খসড়া প্রণয়ন করে।
সংসদে বিল পাস: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ 'কওমী মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদীসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান আইন ২০১৮' পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিলটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, দীর্ঘ নয় বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদরাসার বোর্ডগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আসছেন। এখন আর নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আসে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কওমী ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে এ স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আল্লামা আহমদ শফীর বিবৃতি
দেশি-বিদেশি অনেক চাপ উপেক্ষা করে অভিনব পন্থায় কওমী সনদের স্বীকৃতির বিল জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ, সরকারী কর্মকর্তা ও সংশিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী।
বিবৃতিতে আহমদ শফী বলেন, কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (স্নাতকোত্তর ডিগ্রি) সমমর্যাদা দেয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে দুই বিষয়ের মাস্টার্সের মর্যাদা পাবে দাওরায়ে হাদিস। ফলে কওমি শিক্ষার্থীদের খেদমতের পরিধি বৃদ্ধি পেল। আমাদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে সমাজে-দেশে দুর্নীতি, অনিয়ম, সুদ-ঘুষের প্রচলন হ্রাস পাবে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী আরো বলেন, সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, আমাদের সব শর্ত মেনে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি অনুসারে দেশের ওলামায়ে কেরাম ও আমরা দায়িত্বশীলগণ যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই স্বীকৃতি পেয়েছি। আমরা মনে করি, এতে কওমী মাদরাসার স্বকিয়তা, ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তিতে কোন আঘাত আসবে না।
আল্লামা আহমদ শফীই স্বীকৃতি আদায়ের সফল কারিগর : দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন চলে এলেও তা বিভিন্ন কারণে আলোর মুখ দেখেনি। ইতোপূর্বে স্বীকৃতির জন্য মিছিল-মিটিং, রাজপথে গণঅবস্থানসহ অনেক আন্দোলনও হয়েছে। তবুও সরকার মহল থেকে তা আদায় করা সম্ভব হয়নি। এর বিপরীতে কোন আন্দোলন-মিছিল ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে সনদের স্বীকৃতি আদায় করা আল্লামা আহমদ শফীর একক কৃতিত্ব বলা চলে। তাঁর ব্যক্তিত্বই এর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে মন্তব্য বিশ্লেষকদের। সে হিসেবে তিনিই সনদের স্বীকৃতি আদায়ের সফল কারিগর!
এদিকে আল্লামা আহমদ শফী খোদ এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে।
গত ১অক্টোবর দারুল উলূম হাটহাজারীর ছাত্র মিলনায়তনে বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশ ও আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের ২০১৮ সালের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় মুমতাজ (জিপিএ ৫) প্রাপ্ত চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ এবং কওমী মাদরাসার ঐতিহ্য ও অবদান শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, শেখ হাসিনা কোন সন্দেহ ছাড়া আমি যেভাবে লিখেছি তার মধ্যে কোন রকমের ভেজাল করে নাই। যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবেই সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন যা কওমী মাদরাসার জন্য বড় নেয়ামত। অথচ এটার জন্য আমাদের কওমী মাদ্রাসার মুরব্বিরা বহু আগে থেকে চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। এমনকি কোন সরকারও দেয়নি। এখন আল্লার রহমতে শেখ হাসিনা একমাত্র আমাকে ডেকে এই সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন।”
আল্লামা আহমদ শফী জীবনের এমন বার্ধক্যে পৌঁছেও দীন-জাতি ও কওমী অঙ্গনের নিরলস খেদমত করে যাচ্ছেন। কখনো রাজপথে নেমে, কখনো কৌশলী আলোচনার মাধ্যমে। আর কওমী সনদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে আন্দোলনে না গিয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানীর বন্দীজীবন পরিবর্তি পন্থা অবলম্বন করছেন স্বীকৃতি আদায়ের সফল কারিগর আল্লামা আহমদ শফী- এমন ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
লেখক- পরিচালক: বাংলাবাড়ি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। সহসাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় লেখক পরিষদ|
কেএল/