এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ:
ইসলামী শরীয়তে আত্মহত্যা মহাপাপ। বিধি-বিধানের আলোকে একটি বড় অপরাধ। আমজনতার কাছেও একটি ঘৃণিত কাজ। আত্মহত্যাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। না পেল সে দুনিয়াতে শান্তি, না আখেরাতে! অশান্তি আর হতাশা থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তার পরিণাম কোথায়!
জাহান্নাম ছাড়া কিছুই না। তাই দল মত ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এটিকে জানে “নিকৃষ্টতম কাজ”। “আত্মহত্যা” শব্দটা যেমন কঠিন কাজটা ঠিক তার থেকেও মারাত্মক জঘন্য। আত্মহত্যা মহাপাপ ও তার পরিণাম কঠিন।
মানুষ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। যাকে বলা হয়েছে “আশরাফুল মাখলুকাত”।প্রত্যেকটা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, তিনিই মৃত্যু দান করবেন। সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এ কথা চিরসত্য “প্রত্যেকটা মানুষ মরণশীল” । মানুষকে আল্লাহ যেমন জন্ম দান করেন, তেমন তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যাকারী পাপী বান্দা আল্লাহর দেওয়া স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নিজের হাতে তুলে নেই ভয়ঙ্কর মৃত্যু । এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ।
মানুষ তার জীবনের মালিক নয়; এর প্রকৃত মালিক হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। অতএব, আল্লাহর মালিকানাধীন জীবনের ওপর বান্দার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। মহান আল্লাহ এমন কাজকে মোটেও পছন্দ করেন না। আর আমাদের নবী রাসুলুল্লাহ সা. নিজে কখনো আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়াননি। সাহাবিদের দ্বারা তা পড়িয়েছেন।এখানে নবিজি সা. এর আত্মহত্যাকারীর জানাজা নামাজ আদায় না করা থেকেই অনুমান করা যায় যে, আত্মহত্যা কত বড় পাপ। আত্মহত্যা ইহকাল-পরকাল উভয়ই ধ্বংস করে দেয়।
চারিদিকে আত্মহত্যার কাহিনী। ঘরে ঘরে আত্মহত্যার কলঙ্ক। দিন দিন বেড়েই চলেছে এই মহাপাপের প্রবণতা। পত্রিকার পাতা খুললে হরহামেশা আত্মহত্যার সংবাদ। আঞ্চলিক পত্রিকা থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র পর্যন্ত। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু সেখানে-এভাবেই একের পর এক প্রচার হচ্ছে আত্মহত্যার বিশ্রী খবরগুলো।
এভাবে আর কত কাল! মানুষ কি বুঝবে না আত্মার মর্যাদা। জানবেনা তার গৌরব। গড়বে না তার কৃতিত্ব। মানবে না তার স্রষ্টার কথা। তার প্রভূ তো তাকে জানিয়েছে- ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)
আরো স্পষ্টভাবে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘তোমরা স্বহস্তে নিজকে নিজে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না। (সুরা বাকারা: ১৯৫)
আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়। হতাশা থেকে মুক্তির পথ নয়। যারা পরকাল বিশ্বাসী তারা কখনও আত্মহত্যা করে না। পরকালে আত্মহত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি হবে। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, যে যেভাবে আত্মহত্যা করবে, তার শাস্তি সব সময় সেভাবে হতে থাকবে। আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করে তাকে দোজখের মধ্যে এভাবেই লোহার মাধ্যমে অনবরত নিজেকে হত্যা করার শাস্তি প্রদান করা হবে।
যে বিষ পান করে তাকে অনবরত বিষ পান এবং যে পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করে তাকে এভাবেই দোজখে অনবরত শাস্তি প্রদান করা হবে। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং-৫৭৭৮)
আসুন আমরা আত্মহত্যার বিষয়ে অবজার্বেশন করি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যনুযায়ী সারাবিশ্বে আত্মহত্যায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রতিবছর বাংলাদেশে পনেরো হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথকে বেছে নেয়। টেনে আনে মৃত্যুর হাতকড়া। মৃত্যুতে লাগে কলঙ্কের দাগ। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয় পাপ কাজে। পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। আর যদি এখানে শ্রেণীবিন্যাস করি তাহলে বলতে হবে, অন্যান্য দেশে যেখানে পুরুষের আত্মহত্যার পরিমাণ নারীদের তুলনায় দুই গুণ বেশি। সেখানে বাংলাদেশে সম্পূর্ন উল্টো চিত্র। পুরুষের তুলনায় নারীদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। যাদের বেশিরভাগই নারী। নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ যারা টগবগে যুবক-যুবতী। যারা সমাজের কান্ডারী। পরিবারের নক্ষত্র। দেশের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার ব্রিজ। তারাই আজ এটার ভুক্তভোগী।
আসুন এবার আত্মহত্যার কারণ নিয়ে এনালাইসিস করি, বাংলাদেশে আত্মহত্যা নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুঃখ-যাতনা, রাগ-অভিমান, হতাশা-নিরাশা, অকৃতকার্য-লোকসানের সময়ে মানুষ অতি উত্তেজিত হয়ে নিজ জীবনের কথা ভুলে গিয়ে লিপ্ত হয় আত্মহত্যা কাজে। কেউ পরিবার বা প্রেমের যাতনা নিয়ে এ পথে পা বাড়ায়।
কেউ বা আবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায়। ভালোবাসার ফলশ্রুতি আত্মহত্যা। দুঃখ-যাতনা রাগ-অভিমানের ফলাফল আত্মহত্যা। তারা জীবনযাপনের কঠিন মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণের জন্যই অথবা আবেগের বশবর্তী হয়ে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। তখন তার মধ্যে না থাকে বিবেক-বুদ্ধি আত্মবোধ, না থাকে মনুষত্ব বলতে কিছুই । সে তখন তার মাঝে লালন করে আত্মঘাতীপূর্ণ চিন্তা-চেতনা। ভুলে যায় নিজেকে, বুঝতে পারে না তার কর্ম ; ফলে আত্মহত্যা নামক জঘন্য কাজটি সম্পাদন করা তার জন্য একেবারেই সহজ হয়ে দাঁড়ায়। একটুও ভ্রুক্ষেপ করে না যে, কি করছে! কেন করছে? কি লাভ হবে জীবনকে নিঃশেষ করে ?
সর্বোপরি বোঝা গেল, আত্মহত্যা মহাপাপ ও তার পরিণাম ভীষণ কঠিন। আল্লাহ আমাদেরকে আত্মহত্যার মতো অমার্জনীয় জঘন্যতম কাজ থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন।আমিন।
লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
-এটি