মোহাম্মাদ হাসিব উল্লাহ: কর্জে হাসানা, বর্তমান বিশ্বে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার। কেননা, কর্জে হাসানায় সুদের কোন অস্তিত্ব থাকে না। এছাড়াও ইসলামী অর্থনীতি মানুষকে দিকনির্দেশনা প্রদান করে, সুদ এড়িয়ে চলতে ও সুদী লেনদেন পরিহার করতে। কারণ, ইসলাম ধর্মে সুদকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন ’أَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَیۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰا۟‘
অর্থ: আল্লাহ্ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা: ২৭৫)
তাই, আধুনিক এই সমাজে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা গঠন করতে ইসলাম ধর্মের নির্দেশনা হচ্ছে কর্জে হাসানার প্রচার ও প্রসার ঘটানো। কারণ, কর্জে হাসানা’র মাধ্যমে একটি সমাজকে কিভাবে সুদমুক্ত করা যায়; কিভাবে ইসলামী অর্থনীতির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে, ইসলাম তা যুগে যুগে দেখিয়ে দিয়েছে। কুরআন ও হাদীসের একাধিক জায়গায় এই কর্জে হাসানা সম্পর্কে আয়াত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
কর্জে হাসানা আরবী শব্দ। এর অর্থ: উত্তম ঋণ। শরীয়তের দৃষ্টিতে, ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে অতিরিক্ত কোন কিছু লাভের উদ্দেশ্য ও শর্ত ব্যতীত কাউকে ঋণ প্রদান করাই হচ্ছে কর্জে হাসানা’।
সাধারণত বিভিন্ন ব্যাংক কিংবা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প কর্মসূচির আওতাধীন কোন প্রতিষ্ঠান হতে কেউ নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ গ্রহণ করলে, তাকে এই ঋণের উপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ প্রদান করতে হয়। প্রায় দেখা যায়, সমাজের অসহায় ও দরিদ্র মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করে পরে সময়মত সুদসহ পরিশোধ করতে পারে না। এক্ষেত্রে অনেক সময়, দরিদ্র পরিবারগুলো নিজেদের অবশিষ্ট সম্পদ হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে, কর্জে হাসানায় ভিন্ন চিত্র প্রতিফলিত হয়। কর্জ বা ঋণ গ্রহণকারীকে কোন সুদ প্রদান করতে হয় না। এখানে দাতাকে সময়মত মূল অর্থ ফিরিয়ে দেওয়াই মুখ্য। কেননা, হাদীসে নববীর ভাষ্যমতে সুদের শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। যেমন নবীজি সা. বলেছেন:
”رَأَيْتُ اللَّيْلَةَ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِي، فَأَخْرَجَانِي إِلَى أَرْضٍ مُقَدَّسَةٍ، فَانْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ مِنْ دَمٍ فِيهِ رَجُلٌ قَائِمٌ، وَعَلَى وَسَطِ النَّهْرِ رَجُلٌ بَيْنَ يَدَيْهِ حِجَارَةٌ، فَأَقْبَلَ الرَّجُلُ الَّذِي فِي النَّهَرِ فَإِذَا أَرَادَ الرَّجُلُ أَنْ يَخْرُجَ رَمَى الرَّجُلُ بِحَجَرٍ فِي فِيهِ فَرَدَّهُ حَيْثُ كَانَ، فَجَعَلَ كُلَّمَا جَاءَ لِيَخْرُجَ رَمَى فِي فِيهِ بِحَجَرٍ، فَيَرْجِعُ كَمَا كَانَ، فَقُلْتُ مَا هَذَا فَقَالَ الَّذِي رَأَيْتَهُ فِي النَّهَرِ آكِلُ الرِّبَا“
অর্থাৎ, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে।
নদীর মাঝখানে লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায়, তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায়, ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হল সুদখোর। (সহিহ বুখারী: ২০৮৫)
এজন্য সমাজে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কর্জে হাসানার গুরুত্ব অত্যাধিক। তাই ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর বাস্তবায়ন জরুরি। বৃহৎ পরিসরে কর্জে হাসানা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে, সুদের বিরুদ্ধে অবস্থান করতে হবে। এতে দারিদ্র্যরা যেমন এর সুফল ভোগ করতে পারবে, অনুরূপ ইসলামী অর্থনীতিরও প্রসার ঘটবে। এছাড়া ইসলাম ধর্মমতে, ইহা আর্থিক ইবাদতেরও অন্তর্ভুক্ত। এহেন কার্যে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ’اِنَّ الۡمُصَّدِّقِیۡنَ وَالۡمُصَّدِّقٰتِ وَاَقۡرَضُوا اللّٰه قَرۡضًا حَسَنًا یُّضٰعَفُ لَهمۡ وَلَهمۡ اَجۡرٌ کَرِیۡمٌ‘
অর্থ: দানশীল পুরুষ ও দানশীলা নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদেরকে দেয়া হবে বহুগুণ বেশি এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। (সূরা হাদীদ: ১৮)
উল্লেখ্য, তাফসীরকারদের মতে: বিপদগ্রস্ত ও অসহায়কে কর্জ (ঋণ) প্রদান করার মাধ্যমেই মূলত আল্লাহকে কর্জে হাসানা প্রদান করা হবে। তাই আল্লাহ তা’য়ালাকে ঋণ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে গরিব-দুঃখী ও অভাবী যারা, তাদের প্রয়োজনানুসারে ঋণ প্রদান ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, কোনো একজন মুসলিম অন্য মুসলিমকে দু’বার ঋণ দিলে, এ ঋণদান আল্লাহর পথে সে পরিমাণ সম্পদ একবার সদকা করার সমতুল্য। (ইবনে মাজাহ: ২৪৩০)
কর্জে হাসানার কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন- ১. কর্জগ্রহীতার উপর আলাদা করে ঋণের অতিরিক্ত প্রদানের শর্ত প্রদান করা যাবে না। সময়মত সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। ২. যে ব্যক্তি কর্জে হাসানা গ্রহণ করবে, তিনি সকল ঝুঁকি বহন করবেন।
৩. কর্জে হাসানা গ্রহীতা যেভাবে ইচ্ছে কর্জের অর্থ বা সম্পদ ব্যয় করতে পারবেন প্রভৃতি। ৪. কর্জগ্রহীতা কর্জ (ঋণ) ফেরতে অপারগ হলে, কর্জদাতা সেই কর্জ ক্ষমা করে দিতে পারেন কিংবা কর্জ প্রদানে অতিরিক্ত সময়ও প্রদান করতে পারবেন। তবে এই অতিরিক্ত সময়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা ইসলামে বৈধ নয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
”مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ لَهُ أَظَلَّهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَحْتَ ظِلِّ عَرْشِهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ“
অর্থাৎ, যে লোক অভাবী ঋনগ্রস্থকে সুযোগ প্রদান করে অথবা ঋণ মাফ করে দেয়, কিয়ামাতের দিবসে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে নিজের আরশের ছায়ায় আশ্রয় প্রদান করবেন, যেদিন তাঁর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না।
(জামে আত-তিরমিজি: ১৩০৬)
এছাড়াও, সামাজিকভাবে কর্জে হাসানার তাৎপর্য অত্যধিক। কর্জে হাসানার মধ্যে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ইহা হতে পারে দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। কেননা, কর্জে হাসানায় শিক্ষাঋণের মাধ্যমে অসহায় পরিবারের সন্তানেরা বেশি উপকৃত হবে। কৃষক কিংবা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ব্যক্তি এই ঋণের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মেটাতে ও সুদ থেকে মুক্ত থাকতে সক্ষম হবে। এর অন্যতম তাৎপর্য হচ্ছে, যারা এই কার্যক্রম যুক্ত থাকে, তারা মূলত পরোপকারী মানসিকতা নিয়ে কাজ করে থাকেন।
এতে দুনিয়াবি স্বার্থ জড়িত না থাকায় ধনী ও ক্ষমতাশীল কর্তৃক দারিদ্রের উপর অর্থনৈতিক শোষণের কোন সম্ভবনা নেই, যেমনটি প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। কেননা, কর্জে হাসানা হচ্ছে উত্তম ঋণ। এতে আর্থিকভাবে একজন দুর্বল ব্যবসায়ী যেমন ব্যবসায় সক্ষমতা লাভ করবে, অনুরূপ সুদ থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পারবে। এমনকি কর্জে হাসানা প্রদানের ফলে প্রচুর নেকিও অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখল, জান্নাতের দরজায় লেখা রয়েছে- ‘দানের নেকি ১০গুণ ও ঋণের (কর্জে হাসানা) নেকি ১৮ গুণ’।
তবে মনে রাখতে হবে, ঋণ গ্রহণ করলে অবশ্যই উহা পরিশোধে চেষ্টা করতে হবে। কেননা, ইহা হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। যা বান্দা ক্ষমা না করলে, আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ
অর্থ: মু’মিন ব্যক্তির রূহ্ ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত, তার ঋণের সাথে বন্ধক থাকে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৪১৩)
অতএব পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান সমাজকে সুদমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে কর্জে হাসানার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সবার উচিত, ইসলামী শরীয়াহ’র আলোকে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্জে হাসানাকে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কর্জে হাসানাকে স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
সুদ হারাম, কর্জে হাসানা সমাধান” স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এককথায়, সুদী অর্থব্যবস্থা বিমোচনে কর্জে হাসানা’র গুরুত্ব অপরিসীম।।
লেখক: তরুণ গবেষক ও লেখক
-এটি