মুফতি সাদেকুর রহমান
সংসার সুখী হয় স্বামী- স্ত্রী দুজনের আদর্শে। ভালবাসা,ধৈর্য, সহনশীলতাই সুখী সংসারের মূলমন্ত্র। সংসার মানে হাসি- কান্না, সংসার মানে সুখ-দুঃখ। সংসারকে সেভাবে উপভোগ করতে প্রয়োজন দুজনের সমান্তরালের চেষ্টা ও আন্তরিকতা। চাই নিজ নিজ দায়িত্ব সচেতনতা ও স্বচ্ছতা। পরিহার করা উচিত একে অপরকে দোষারোপ ও সন্দেহের প্রবণতা।
দরকার আত্মিক ও মানসিক প্রশস্ততা, ছাড় ও উদারতার। প্রয়োজন মানিয়ে নেয়ার ও মানিয়ে চলার মনমানসিকতা। বাহিরের ঝামেলা বাহিরেই রাখা, ঘরে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করা। কিন্তু অনেক সময় আমরা বাহিরের ঝামেলা-জঞ্জাল বাসায় নিয়ে হাজির হই।
প্রিয়জনের সাথে শুরু করি দুর্ব্যবহার। অথচ তারা রান্নাবান্না করে ঘর গুছিয়ে আমাদের আসার অপেক্ষায় থাকে।প্রত্যাশা করে একরাশ মুচকি হাসি ও হাস্যোজ্জ্বলতা। কামনা করে একটু আদর-সোহাগ, মমতা ও ভালোবাসা। আর স্ত্রীরাও বউ-শাশুড়ির ঝগড়া, ভাবি- ননদের দ্বন্দ্বের বাহানায় স্বামীকে অহেতুক বিরক্ত করে,ক্ষেপিয়ে তুলে ।তখন আমরা পুরুষিত পদক্ষেপ গ্রহণ করি না।
বিচক্ষণতা-বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেই না। উল্টো আমরাও ক্ষেপে যাই। লিপ্ত হই স্ত্রীর সাথে বাক- বিতন্ডায়। স্ত্রীরাও নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ধৈর্য ও সহনশীল হয়না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। স্বামী রাগের মাথায় হুট করেই দিয়ে বসে তালাক।
তাও একটি নয়, তিনটি। বরং হাজার টি। ফলে নিমিষেই পরিসমাপ্তি ঘটে দীর্ঘদিনের সুখের দাম্পত্য জীবনের। জ্বলে উঠে জীবন সংসারে এক অনির্বাণ অগ্নির, ভস্ম করে দেয় নিজেদের ও সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। হাওয়ায় উড়ে যায় গোটা পরিবারের সুখ -শান্তি। তারপর সৃষ্টি হয় আক্ষেপ ও অনুশোচনা। শুরু হয় দৌড়ঝাপ।
কিন্তু ততক্ষণে আর করার কিছুই থাকেনা। আমরা যাতে এরূপ বিড়ম্বনা ও কঠিন পরিস্থিতির শিকার না হই, সেজন্য ইসলাম আমাদের কে তালাক প্রদানের বিষয়ে দিয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। কিন্তু শত আক্ষেপ ও পরিতাপ আমাদের প্রতি, আমরা সে নীতিমালা জানিনা। জানার চেষ্টাও করি না। জানলে ফলো করার প্রয়োজন বোধ করি না ।এখনো যদি আমরা সেই নীতিমালা অনুসরণ করি, আমাদের সাংসারিক জীবনে বাস্তবায়ন করি,তাহলে আমাদের সংসার হবে সুখময় ও শান্তিময়। অকারণে ভাঙবে না আর কোন সংসার। বন্ধ হবে তালাকের দুর্বিষহ যন্ত্রণা।
তালাক প্রদানের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা:
ইসলাম তালাককে নিরুৎসাহিত করেছে। তালাক ইসলামে বৈধ তবে তা ঘৃণিত কাজ। তা সত্ত্বেও কেউ যদি তালাক দিতে চায় তবে ইসলাম তাকে প্রথমে চারটি কাজ করতে নির্দেশ করেছে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন: আর যে সকল স্ত্রীর ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশঙ্কা কর (প্রথমে) তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর, এবং ( সংশোধন না হলে )তাদেরকে প্রহার কর।যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ খুঁজো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও মহান।
তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা কর, তবে (তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য) পুরুষের পরিবার হতে একজন সালিস ও নারীর পরিবার হতে একজন সালিস নিযুক্ত কর,তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সর্ববিষয়ে অবহিত। সূরা নিসা-৩৪-৪৫
আয়াত দুটোতে আল্লাহ তায়ালা স্বামীকে তার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য তাফসির গ্রন্থের আলোকে সেগুলো তুলে ধরছি
প্রথম পদক্ষেপ: নম্র ও কোমল ভাষায় স্ত্রীকে বুঝানো। বাগদাদের প্রধান মুফতি সৈয়দ মাহমুদ আলুসী রহ.বলেন, তোমরা স্ত্রীদের উপদেশ দাও এবং তাদেরকে বল, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা যে অবাধ্যতায় লিপ্ত আছো তা থেকে ফিরে আসো। রুহুল মা'আনী ৩/২৫(মাকতাবায়ে এমদাদিয়া পাকিস্তান)
অর্থাৎ স্বামীর আনুগত্য করলে স্ত্রী দুনিয়া ও আখরাতে কী প্রতিদান পাবে? অবাধ্যতা করলে তার জন্য কী ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে? সংসার গঠন, সন্তানদের লালন-পালন ও তাদেরকে সুসন্তান হিসেবে গড়তে পারলে কি বিনিময় পাবে?মহীয়সী নারীগণ কিভাবে তাদের স্বামীদের মনোরঞ্জন করেছে? তাদের সংসার গুছিয়েছে? কেমন ছিল তাদের জীবন যাপন? এসব বিষয় গুলো স্বামী স্ত্রীর সামনে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরবে , কোমল ও নম্র ভাষায় বুঝাবে। তার দিলের ওপর মেহনত করে আনুগত্যের যোগ্যতা তৈরি করবে এবং তার অন্তরে আল্লাহ ও আখেরাতের ভয় সৃষ্টি করবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা রা.মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি যদি একজন আরেকজনকে সিজদা করার আদেশ দিতাম তাহলে স্ত্রীকে তার স্বামীর সিজদা করার আদেশ দিতাম।সেই স্ত্রী আল্লাহর হক পূর্ণরূপে আদায় করতে পারেনা যে তার স্বামীর হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে না। স্ত্রী উটের পিঠে হাওদায় থাকা অবস্থায়ও স্বামী যদি তাকে কাছে পেতে চায় তাহলে সে তার কাছে যাবে।-সুনানে ইবনে মাজাহ- হাদিস হাদিস নং ১৮৫৩, মুসনাদে আহমদ- হাদিস নং১৯৪০৩
কোন স্ত্রী তার স্বামীর বিছানা থেকে আলাদা রাত যাপন করলে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা তার ওপর অভিসম্পাত করতে থাকে। মুসলিম শরীফ-হাদিস নং১৪৩৬
দ্বিতীয় পদক্ষেপ.বিছানা আলাদা করে দেওয়া একজন স্বামী সোহাগী ও স্বামী প্রেয়সী নারীর জন্য সবচেয়ে আনন্দ ও সুখের বিষয় হলো, স্বামী তার পাশে থাকা ।একেই বিছানায় রাত যাপন করা।
লোকে বলে,দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই। তাই স্বামী যে কত বড় নেয়ামত এবং একই বিছানায় থাকা কত যে সুখ ও আনন্দের সেটা তখনই বুঝে আসবে যখন এই নেয়ামত হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই এই নেয়ামত স্ত্রীর উপলব্ধিতে আনার জন্য স্বামী কিছুদিন তার বিছানাকে আলাদা করে দেবে। একই বিছানায় রাত যাপন করবে না। প্রয়োজনে স্ত্রীর সাথে কথা ও বন্ধ করে দেবে। কেউ কেউ বলেন সহবাস ও বন্ধ করে দেবে। -তাফসীরে রুহুল মাআনী-৩/২৫ ,তাফসীরে ইবনে কাসীর-২/৩২৬
এতে যদি স্ত্রীর বুঝ এসে যায় ,সংশোধন হয়ে যায় ,তাহলে স্বামী সহনশীল হবে। অতীতের তিক্ততাপূর্ণ কথা বলে স্ত্রীকে খোঁটা দেবে না এবং তার উপর স্বামী হওয়ার অহংকার ফলাবে না। মনে রাখতে হবে, স্বামী যত বড়ই হোক না কেন সেও তো আল্লাহর বান্দা। আল্লাহই মহান, সকল গৌরব -গরিমা তার জন্যই শোভনীয়। তিনি সর্বশক্তিমান এবং তিনি অসহায় ও মজলুমে আশ্রয়স্থল।
এই ভদ্রতাজনিত ব্যবস্থায় কাজ না হলে স্বামী তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
তৃতীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু শাসন করা স্বামী যদি মনে করে যে, স্ত্রীকে কিছুটা প্রহার করলে সে সংশোধন হয়ে যাবে তাহলে প্রয়োজন অনুপাতে হালকা শাসন করবে ।তবে এক্ষেত্রে চেহারায় আঘাত করা যাবে না।এমনভাবে প্রহার করা যাবে না যার মাধ্যমে হাড় ভেঙ্গে যায় অথবা চামড়ায় দাগ পড়ে যায়। রুহুল মাআনী-৩/২৫
তাফসীরে ইবনে কাসীর-২/৩২৭
ইসলাম কোন ক্ষেত্রেই সীমালংঘন অনুমোদন করে না। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম এর নিকট অভিযোগ করলেন , ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাদের স্ত্রীরা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে। আমাদেরকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন তোমরা তাদেরকে কিছুটা প্রহার কর।
পরদিন সকালে অনেক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লামের দরবারে গেল এবং তাদের স্বামীদের ব্যাপারে মারপিটের অভিযোগ অভিযোগ করল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম পুরুষদের বললেন, তোমাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদের প্রহার করে তারা ভালো মানুষ নয়। সুনানে আবু দাউদ-হাদিস নং২১৪৬
অন্য বর্ণনা এসেছে তোমাদের মধ্যে সেই সেরা, যে তার পরিবারের কাছে সেরা। আর আমি আমার পরিবারের কাছে সবচেয়ে সেরা। সুনানে তিরমিজি-হাদিস নং ৩৮৯৫
আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী রহ. বলেন, স্ত্রীদের প্রহার করার চেয়ে তাদের রুঢ় আচরণ, অত্যাচার ও মানসিক টর্চারের প্রতি ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। তবে আল্লার প্রকাশ্য অবাধ্যতা প্রকাশ পেলে ভিন্ন কথা। তাফসীরে রুহুল মাআনী-৩/২৫ ইসলাম সকল ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি এই দুই প্রান্তিকতা পরিহার করে ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা গ্রহণের আদেশ করেছে।
চতুর্থ পদক্ষেপ. উভয় পক্ষের সালিস ডাকা
স্বামী-স্ত্রী নিজেরা সাংসারিক সমস্যা মিটাতে অক্ষম হলে অভিভাবকদের সহযোগিতা নিবে। উভয় পক্ষের অভিভাবকরা একত্র বসবেন। এবং তারা ঠান্ডা মাথায় স্বামী- স্ত্রী উভয়ের বক্তব্য ও অভিযোগগুলো শুনবেন। অতঃপর ন্যায় সঙ্গত পদক্ষেপ নিয়ে পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদকে দূর করার চেষ্টা করবেন। বাস্তবে যদি অভিভাবকরা নিঃস্বার্থভাবে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে , তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাদেরকে সংশোধন করে দেবেন।
পুনরায় তাদের মধ্যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা দান করবেন এবং তাদেরকে সুখময় দাম্পত্য জীবন উপহার দিবেন। এসব চেষ্টাও যদি ব্যর্থ হয় এবং তার সাথে সংসার করা কোনভাবেই সম্ভব না হয় তাহলে স্বামীর জন্য তালাক তথা বিবাহ বিচ্ছেদের পন্থা অবলম্বন করতে আর কোন বাঁধা নেই। তবে এক্ষেত্রে ও ভেবে -চিন্তে, সুস্থীর হয়ে শরিয়ত নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করবে। তাফসীরে রুহুল মাাআনী-৩/২৭, তাফসীরে ইবনে কাসীর-২/৩২৯ আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক:
মুফতি ও মুহাদ্দিস
শেখ জনুরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদরাসা
-এটি