|| কাউসার লাবীব ||
বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার এক মুগ্ধতার নাম মাদরাসা। এখানে একজন মানুষ হয় প্রকৃত মানুষ। পায় দ্বীন, ধর্ম আর নৈতিক শিক্ষার অনন্য আলো; যা তার পুরো জীবনের পাথেয় হিসেবে কাজ করে।
মাদরাসা শিক্ষার সুনিপুন শিক্ষাক্রম ও সুবিন্যস্ত পাঠ পদ্ধতি মুগ্ধ করেছে অনেককেই। এসব মুগ্ধতা থেকে নানা সময়ে আমরা নানা ঘটনা জেনে থাকি। এমনই এক ঘটনার জন্ম দিয়েছে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত।
নয়া দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ হাইওয়ে ধরে এগুলেই গাজিয়াবাদ। গাজিয়াবাদ শহরটি ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ’র উজির গাজী-উদ-দীন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার নাম অনুসারে এর নামকরণ করেছিলেন ‘গাজীউদ্দিননগর’। ১৮৬৪ সালে রেলপথ খোলার সঙ্গে সঙ্গে ‘গাজীউদ্দীননগর’ নামটি বর্তমান ‘গাজিয়াবাদ’ রূপে সংক্ষিপ্ত করা হয়। নয়া দিল্লির পাশে অবস্থিত এবং উত্তর প্রদেশের প্রধান রুট হবার কারণে মাঝেমাঝে এটিকে উত্তর প্রদেশের প্রবেশদ্বারও বলা হয়। এই গাজিয়াবাদের ব্যস্ততম শিল্প শহর লোনি। এখানে অবস্থিত ভিন্নধর্মী মাদরাসা ‘জামিয়া রশিদিয়া।’
অনেকটা অবিশ্বাস্য হলো, জামিয়া রশিদিয়া গত ১৫ বছর ধরে একজন হিন্দু ব্যক্তি পরিচালনা করছেন। ওই ব্যক্তির নাম ‘রাম খিলাদি।’ তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। শিক্ষক হিসেবে উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি হিন্দি পড়ান।
মাদরাসা জামিয়া রশিদিয়া ১৯৯৯ সালে ৫৯ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছিল আর্থিকভাবে দরিদ্র মুসলিম পরিবারের। কিন্তু বর্তমানে জামিয়া রশিদিয়ায় প্রায় ৮০০ ছাত্র ও ২২ জন শিক্ষক রয়েছে।
মাদরাসার প্রধান ইমাম ‘নবাব আলী’ জানান, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শুরু লগ্নে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এই মাদ্রাসায় পাঠাতে নারাজ ছিল। এখন আমাদের ক্লাস পূর্ণ। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য জায়গা তৈরি করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রাম খিলাদি বলেন, এখানে আসার আগে আমি দশ বছর ধরে অনেক স্কুলে পড়িয়েছি। কিন্তু এখানে আসার পর পাঠদানের একটি অনুকূল পরিবেশ পাই। দীর্ঘ সময়ে এই মাদরাসার সঙ্গে আমার একটি ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হলে বা বাজারে গেলে সব মুসলিমরা আমাকে বিনম্র শ্রদ্ধা করে। ‘পন্ডিত প্রিন্সিপাল আসছেন’ বলে পথ ছেড়ে দেয়। নতুন চাকরির জন্য এই মাদরাসা ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও ভাবতেই পারি না।
রাম খিলাদি জানান, আমি মাদরাসার ছাত্র ও আমার সহকর্মীদের সঙ্গে চলফেরা এবং আচার-আচরণের সময় ধর্মকে কখনো বাধা হিসেবে দেখিনি। আমাদের মেয়ে বাচ্চারা নেকাব পরে মাদরাসায় আসে। সময় মতো নামাজ-কালেমা পড়ে। এগুলো আমার কাছে ভালো লাগে। তবে অবশ্যই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদেরও কিছু নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
তিনি বলছেন, অনেকেই মাদরাসা নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। এটি কখনোই কাম্য নয়। আমরা যা শুনি তা মিথ্যা হতে পারে, যা দেখি তা মিথ্যা হতে পারে। অতএব, সঠিক উপায় হল সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা। এখন মাদরাসাগুলোতে কুরআনের পাশাপাশি হিন্দি, ইংরেজি ও বিজ্ঞানও শেখানো হয়। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক চালু করা ‘মাদরাসা আধুনিকীকরণ প্রকল্প’র অধীনে আমরা মাদরাসা পরিচালনা করছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছে। অনেকেই ডাক্তার হয়েছে। একজন ছাত্র স্থানীয় হাসপাতালের ব্যবস্থাপক। দরিদ্র পটভূমির মুসলিম শিশুদের জন্য বেসরকারি স্কুলে পড়া প্রায় অসম্ভব। মাদরাসাই তাদের শিক্ষার একমাত্র উৎস। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এখানের ছাত্রছাত্রীদেরও স্বপ্ন আছে। তাদের অনেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করতে চায়।
তার মতে, বিশ্বব্যাপী ভারতীয়দের ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা আমাদের সঠিক এবং ভুলের মধ্যে পার্থক্য শেখায়।
যারা মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন তাদের কাছে রাম খিলাদি প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনারা কি মাদরাসায় গিয়ে ছাত্রদের সাথে সময় কাটিয়েছেন? আপনাদের ধারনা ব্যাক আপ করার জন্য কোন গবেষণা আছে? আপনার ধারনাগুলি কি শুধুই শোনার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি? ‘মাদরাসা পড়ালেখায় দোষ নেই’ এর একটি প্রামাণ্য উদাহরণ আমি নিজে। আমার শিক্ষার্থীদের প্রতিভায় আমি মুগ্ধ। তাদের ভালোবাসায় সিক্ত আমি। তথ্যসূত্র : দ্য ভয়েজ