নুরুদ্দীন তাসলিম।।
বর্তমান সময়ের বহুল প্রচলিত শব্দ সাইবার বুলিং। পরিসংখ্যান মতে নেট মাধ্যমে ভিন্নমত দমনে বেপরোয়া আচরণ বা সাইবার বুলিং এর শিকার প্রায় ৪৯ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তবে মাত্র ২৬ শতাংশ অনলাইনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করে অভিযোগ দায়ের করেন।
বর্তমানে সাইবার বুলিং এর এই বিষয়টি শুধুমাত্র ভিন্নমত দমাতে ও তাদের উত্যক্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অনেক সময় নিজের পক্ষীও মানুষজনের কোন ব্যাপার পছন্দ না হলে তাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতেও দেখা যায়।
দিন দিন বেড়েই চলেছে এই প্রবণতা। এক সময় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে প্রায় সব ধরনের নেটিজেনদের মাঝেই এ বিষয়টি বিদ্যমান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কওমি তরুণরাও এ জাতীয় কাজে জড়িয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন অনেকে। নিজ ঘরানার কোন ব্যক্তির মতের সাথে একমত হতে না পারা, ভিন্নমত ও জগতের লোকজনের প্রোফাইলে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও সমালোচনায় ভরিয়ে দেওয়া এখন যেন নৈমত্তিক ব্যাপার।
সাইবার বুলিং-এর থেকেও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে সাইবার প্রতারণা বা কারো নামে হুবহু ফেক আইডি তৈরি করা ও ফেক আইডি থেকে বিভিন্ন পোস্ট করে ব্যক্তি বিশেষকে বিতর্কিত করার চেষ্টা। সাম্প্রতিক সময়ে এমনি সাইবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন, লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ।
তার নামের বানান হুবহু নকল করে একটি আইডি থেকে সমসাময়িক বিতর্কিত নানান ইস্যুতে পোস্ট করা হচ্ছে, অনেকে মূল বিষয় বুঝতে না পেরে কমেন্টে বিরূপ মন্তব্যও করে চলেছেন নিয়মিত। সাইবার প্রতারণার এই বিষয়টি সাইবার বুলিং-এর থেকেও ভয়ঙ্কর বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ।
[caption id="" align="alignnone" width="348"] লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ।[/caption]
তিনি আওয়ার ইসলামকে জানিয়েছেন, বর্তমানে সাইবার প্রতারণার নামে যা চলছে তা অল্প কথায় বলার মতো না, ফেসবুকে অনেক বিষয়ে প্রতিবাদ হয়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রতিবাদের নামে সাইবার বুলিং- এটা ভয়ঙ্কর।
তার ভাষায়, সাইবার বুলিং এর বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যেমন কমেন্ট, পোস্ট করে কাউকে হয়রানি করা। আবার অনেকে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদকে সাইবার বুলিং বলে চালিয়ে দিতে চান যা কোনভাবে কাম্য নয়।
তরুণ প্রজন্ম, অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়ে কিছুটা ধারণা আছে এমন ছেলেরাও এ জাতীয় বিষয়গুলোতে ঝুঁকছে ও বেপরোয়া আচরণ প্রকাশ করছে।
তিনি বলছেন, বর্তমানে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছ; কোন ব্যক্তিকে বিতর্কিত করতে হুবহু তার নামের সাথে মিল রেখে ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন ইস্যুতে পোস্ট করা। এতে অনেকেই না বুঝে ভূয়া আইডিকে আসল মনে করে গালাগালি ও সমালোচনা শুরু করে দিচ্ছেন, এটা সাইবার বুলিং’র থেকেও ভয়ঙ্কর।
তার ভাষায়, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে গালমন্দ করা, তার সমালোচনা করা এক বিষয়; কিন্তু সে ব্যক্তিকে অন্য অনেকের সামনে খারাপ ভাবে উপস্থাপন করা একটা ভয়ঙ্কর দিক।
তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘বর্তমানে প্রযুক্তির সয়লাবের এই সময়ে বিষয়টি নিয়ে অভিভাবক এবং ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। সবকিছু সরকার ও আইনের ওপরে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা এর থেকে উত্তরণের কোন পন্থা নয়’।
‘সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে তরুণদের সচেতন করে তোলা অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব’।
তিনি বলছেন, এখনো আমাদের দেশে সভ্য পরিবারের ছেলেরা তাদের বাবা-মায়ের সামনে সিগারেট ও নেশা জাতীয় দ্রব্য অবাধে ব্যবহার করতে পারে না, এই ব্যাপারগুলোতে পরিবার এখনো যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে তেমনিভাবে অনলাইন মাধ্যমগুলোকেও যাচ্ছেতাই মনে না করা উচিত, এখানেও ধরাবাঁধা, খবরদারির বিষয়ে পরিবারের সজাগ থাকা উচিত। যেন আমাদের অজান্তেই সন্তানেরা চরিত্র বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে-বলছিলেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ।
নেটিজেন বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে এই সময়ে এসে ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়- এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে বলছেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা হারুন ইসলামাবাদীর ছেলে ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রফেসর শাহেদ হারুন।
তিনি আওয়ার ইসলামকে বলছেন, একজন সন্তানের তারবিয়তের সূতিকাগার বাবা-মা ও শিক্ষকদের এ বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের শুরু থেকেই সচেতনভাবে গড়ে তোলা অপরিহার্য।
ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ছে এ ক্ষেত্রে তার বক্তব্য হল, সমালোচনার পূর্বে অবশ্যই ভেবে নিতে হবে যার সমালোচনা করছি তার যোগ্যতার কাছাকাছি আমি কতটুকু পৌঁছতে পেরেছি। তিনি কিছুটা আফসোস করে বলছেন, আমাদের তরুণদের মাঝে এক ধরণের অস্বস্তিকর সভ্যতা গড়ে উঠছে যা দুঃখজনক।
তিনি আরো যোগ করেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম জীবিত বিভিন্ন গুণীজনকে ছাড় দেওয়া তো দূরের কথা, তারা পূর্ববর্তী অনেক আকাবিরের সমালোচনা করতেও পিছপা হন না। এটা ভিন্নমত দমন ও সমালোচনার কোন সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। ভিন্নমত ও মত পার্থক্য এটাই আমাদের সমাজ ও পৃথিবীর সৌন্দর্য। তাই কোরআন হাদিসের আলোকে যৌক্তিকভাবে অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা করাটাই যুক্তিযুক্ত- অন্তত কওমি তরুণদের জন্য’।
এক্ষেত্রে ইমাম শাফি রহ.-এর জীবনের একটি খণ্ড চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, কেউ একজন ইমাম শাফি রহ. -এর কাছে কারো ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন। কিন্তু সে ব্যক্তির ভাষায় শালীনতা ছিল না। তাৎক্ষণিক ইমাম শাফি রহ. তাকে ভাষা শালীন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া ভিন্ন মত ও জগতের লোকজনের পোফাইলে গিয়ে বিরূপ মন্তব্য নববী আচরণের বহির্ভূত। তাই আকাবিরদের পথ অনুসরণ ও শিক্ষকদের সঠিক তত্ত্বাবধায়ন এক্ষেত্রে যোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মতামত দিয়েছেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা হারুন ইসলামাবাদীর ছেলে ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রফেসর শাহেদ হারুন।
প্রসঙ্গত, অনলাইনে সহিংসতা ও সাইবার হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার, হ্যালো সিটি অ্যাপ, রিপোর্ট টু র্যাব অ্যাপ, ৯৯৯ নাম্বারেও অভিযোগ জানানো যায়। শিশুদের সহায়তায় ১০৯৮ নম্বরে, নারী ও শিশুদের সহায়তায় ১০৯ হটলাইনে ফোন করেও সেবা নেওয়া যায়।
কেএল/