|| আবু সাঈদ ||
ওয়াকফকৃত গ্রন্থাগারগুলো সাধারণত অন্যান্য গ্রন্থালয়ের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হতো। এর কারণও ছিল। একজন আলেমের যখন মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসতো, তখন তার সবচে বেশি পেরেশানি থাকতো এসব কিতাব নিয়ে। হতে পারে এসব এমন ব্যক্তির হাতে পড়বে, যে কদর বুঝবে না। যথাযথ হক আদায় করবে না। তাই অনেকে মৃত্যুর আগেই কিতাবগুলো কোথাও ওয়াকফ করে দিতেন। কেউ আবার মৃত্যুর পূর্বে তা ওয়াকফের জন্য ওসিয়ত করে যেতেন। জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে এর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এর দ্বারা বুঝা যায়, ওয়াকফ করা তখন আলেমদের সাধারণ আচারে পরিণত হয়েছিল। এভাবে বিভিন্ন আলেমের জীবনভর সংগ্রহ যদি কোন গ্রন্থাগারে একত্রিত হয়, তবে তার সমৃদ্ধির সাথে অন্যান্য গ্রন্থাগার কুলিয়ে পারে? নিম্নে জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলী থেকে বিভিন্ন আলেমের ওয়াকফের ঘটনা তুলে ধরা হলো।
১. হামাবি মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান বাস্তি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে এক লোককে ওসিয়ত করে যান, মৃত্যুর পর সে যেন তার কিতাবগুলো দারুল কুতুবে পৌঁছে দেয়। যারা এগুলো থেকে অনুলিপি করতে চায়, তাদের জন্য যেন সুযোগ রাখা হয়।
২. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে জাযলাহ আত-তীব রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে তার কিতাবাদি ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহির মাজার সংলগ্ন মাকতাবায় ওয়াকফ করে দেন।
৩. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস খতিবে বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর সময় তার কিতাবাদি ওয়াকফ করে দেওয়ার ওসিয়ত করে যান।
৪. মুহাম্মদ ইবনুল বান্ধী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ পরিমাণ কিতাব সংগ্রহ করেছিলেন, সমসাময়িক অন্য কেউ সে পরিমাণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হননি। তিনি তার সকল কিতাব দামেস্কের সামিসাথী খানকার গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
৫. ইমাম আবুল মাআলি আর রাশিদি তার কিতাবাদি আল জামিউল মানিঈর গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
৬. আল্লামা হামাবী মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, রশিদ উদ্দিন ওয়াতওয়াত এক কিতাবে লিখেছেন,আমি আমার হালাল উপার্জনে হাজারখানেক বই ক্রয় করি। এবং তার সবকয়টি মুসলমানদের উপকারার্থে ওয়াকফ করি।
৭.ইমাম ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলেন, খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে মুস্তানসিরিয়ার গ্রন্থাগারে খলিফা এ পরিমাণ কিতাব ওয়াকফ করেছিলেন যে, পৃথিবীতে এর জুড়ি মেলা ভার।
কোন কোন আলেম মৃত্যুর পূর্বে কিতাবাদি বিক্রিও করে দিতেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি আদ্দুরারুল কামিনা গ্রন্থে বলেন, ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহমতুল্লাহি আলাইহি কিতাব সংগ্রহের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত ছিলেন। ফলে তার মাকতাবায় এ পরিমাণ কিতাব জমা হয়েছিল যে, তার ছেলেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় কিতাবাদি রাখার পর যেসব কিতাব ছিল, দীর্ঘ কাল পর্যন্ত তা বিক্রি করেছিল।
আবার কেউ কেউ দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কিতাব বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। তবে তখন তারা এতোটাই কষ্ট পেতেন, যেন প্রিয়জন হারানোর ব্যথাকেও তা হার মানাবে। কেউ আবার যুহুদ অবলম্বনের মানসে কিতাবাদি জ্বালিয়ে দিতেন। ইমাম জাহেয রহমতুল্লাহি আলাইহি আল-বয়ান ওয়াত-তিবইয়ান গ্রন্থে প্রখ্যাত ভাষাবিদ আবু আমর ইবনুল আলা আল-বাসরীর জীবনীতে উল্লেখ করেন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তিনি এ পরিমাণ কিতাবাদি রচনা করেন যে, কিতাবের স্তুপ তার মাকতাবার ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। অতঃপর তিনি যখন যুহুদ অবলম্বনের ইচ্ছা করলেন, এসব পুড়িয়ে দেন। সমাজের যথাযথ মূল্যায়নের অভাবেও অনেকে কিতাবাদি পুড়ে ফেলেছিলেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শাফেয়ী ফকিহ আবু হাইয়ান আত-তাওহিদী রহমতুল্লাহি আলাইহি কী বেদনা বিধুর বচনে তার কিতাব পুড়ানোর কথা ব্যক্ত করেছেন! তিনি বলেন, ‘শোনো, আমি আমার কিতাবাদি পুড়িয়ে ফেলবো না কেনো বলো। রাতদিন একাকার করে কষ্ট ক্লান্তির অবশেষে ইলমের কত অজানা দিগন্ত তাতে উন্মোচন করেছি। আমি এসব কার জন্য লিখেছি বলো! মানুষ কি এর যথাযথ মূল্যায়ন করেছে! বয়স তো আর কম হয়নি। নব্বইয দশক পরও কি আর অপেক্ষা করা যায়! তবে এসব কিতাব আর কার জন্য রেখে যাব! মূল্যায়নের অভাবে আমার পূর্বের অনেকেও তো তাদের কিতাব জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তারা তো অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাদের অনুসরণই তবে শ্রেয়। এজন্য আমিও আমার কিতাব পুড়িয়ে ফেলেছি।’
কারো কারো কিতাব অনিচ্ছায় দুর্ঘটনায় পুড়ে যেতো। হাফেজ যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাজকিরাতুল হুফফাজ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৬৭ হিজরীতে মিশরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহির কিতাব এক দুর্ঘটনায় পুড়ে যায়। তিনি কিতাব থেকেই হাদিস বর্ণনা করতেন। এই ঘটনার পর তিনি যখন স্মৃতি থেকে হাদিস বর্ণনা শুরু করেন, স্মৃতিবিভ্রাটজনিত বিভিন্ন ভুলের শিকার হন।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম খিরাকি হাম্বলী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদে গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল গ্রন্থাগার। বাগদাদে যখন খারেজীদের উৎপাত শুরু হল, বিভিন্নজন সাহাবায়ে কেরামের শানে গুস্তাখি শুরু করলো, তিনি বাগদাদ থেকে বেরিয়ে যান। আর তার কিতাবাদি রেখে যান এক মাকতাবায়। এসময় এক অগ্নিঘটনায় সে গ্রন্থাগার উড়ে যায়। ফলে খিরাকির কিতাবগুলোও নিঃশেষ হয়ে যায়।
ইয়াকুত হামাবি মু’জামুল উদাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, উসমান ইবনে জিন্নী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, শায়খ আবু আলী আল-ফারসি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একবার বাগদাদে বিরাট এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে বাগদাদবাসীর কিতাবাদি সব পুড়ে যায়।… আমি তখন শায়খকে বললাম, তবে কী বলে আপনি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলেন? শায়খ অত্যন্ত বেদনাতুর কন্ঠে আমাকে বললেন, আরে, আমি তো শোকে পাথর হয়ে দীর্ঘ দুই মাস পর্যন্ত কারো সাথে কথাই বলতে পারিনি।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাকরিযী আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতেবার গ্রন্থে বলেন, একবার কায়রো পাহাড়ের এক কেল্লার মাকতাবায় আগুন ধরে যায়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির এক বিশাল সম্ভার ছিল। সেখানকার ক্রীতদাসরা পুড়ে যাওয়া কিতাবাদির পাতাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে শহরে বিক্রি করেছিল। মানুষ পোড়া পাতাগুলো থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি লাভ করেছিলো।
অনেকের কিতাব পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। ইমাম ইবনুল জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ৫৫৪ সালে একবার ভয়াবহ বন্যা হয়। তখন আমার সব কিতাব ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। একটিমাত্র কিতাব বেঁচে যায়। তাতে ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির স্বহস্তে লিখিত দুটি পৃষ্ঠা ছিল।
ইবনে আবী উসাইবিয়া এ বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমির আবুল ওয়াফা মুবাশ্বির ইবনে ফাতেক ইলম অন্বেষণে ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী। বিভিন্ন স্থান থেকে কিতাব সংগ্রহ করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক বইয়ের রাজ্য। অধিকাংশ সময় কিতাব নিয়েই পড়ে থাকতেন। যখন সফরে বের হতেন, সঙ্গে বই-খাতা নিতেন। কোথাও যাত্রাবিরতি হলে কিছু লিখতেন। কিংবা পড়তেন। তিনি লেখাপড়াকেই নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিবেচনা করতেন। তার স্ত্রী ছিলেন খানদানি ঘরের মেয়ে। তবে কিতাবাদি পড়ার অভ্যাস ছিল না। আবার স্বামীর এ অভ্যাসকে তার উপর অবিচার মনে করতো। এজন্য আমির যখন মারা যান, এ মহিলা কিতাবাদির উপর তার ক্ষেদ মেটালো। তাদের বাড়ির মাঝে ছিল এক বিশাল জলাশয়। মহিলা তার দাসী সহ আমিরের সকল কিতাব জলাশয়ে ছুড়ে মারল। সংবাদ পেয়ে মানুষজন ছুটে গেলে কিছু কিতাব হেফাজত করা সম্ভব হয়। তবে অনেক কিতাবই ডুবে নষ্ট হয়ে যায়।
রাজনৈতিক জিঘাংসার ফলেও অনেক মাকতাবা ধ্বংস হয়ে যায়। বহিরাগত শত্রুরাও কম ক্ষতি করেনি মাকতাবা শিল্পের। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সরকারের রোষানলেও হারাতে হয়েছে অনেক মাকতাবা। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালকাসান্দি ইসলামী সভ্যতার সর্ববৃহৎ তিন মাকতাবার পরিণতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, যতদিন ফাতেমীয় খিলাফত ছিল, তাদের মাকতাবা টিকে ছিল। যখন ফাতেমী সালতানাতের সূর্য ডুবে গেল, তাদের মাকতাবাও ধ্বংস হয়ে গেল। উমাইয়াদের মাকতাবাও তাদের খেলাফতের পতনে ভেঙ্গে পড়ল। আব্বাসীদের মাকতাবা তাতারীরা গুঁড়িয়ে দিল।
ইমাম ইবনুল আসীর রহমতুল্লাহি আলাইহির আল কামেল নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ৫৫৫হিজরীর যুদ্ধে যখন কাজী ইবনুল মুখাররাম বন্দী হন, তার কিতাবাদি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেসবে দর্শনশাস্ত্রের অনেক কিতাব ছিল। সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাওয়া নগরীর মাকতাবা সম্পর্কে ইয়াকুত হামাবী বলেন, তাতারীরা যখন সাওয়া নগরী দখল করে, তারা সে শহরের মাকতাবা ধ্বংস করে দেয়। মাকতাবাটি এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, তার মতো দ্বিতীয় আরেকটি কোথাও ছিল না।
কেএল/