উর্দু ভাষিক শাসনের অবসান ঘটলে এ দেশে উর্দু শিক্ষার প্রচলন কমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিভু নিভু অবস্থায় উর্দু বিভাগ থাকলেও উর্দু নিয়ে তেমন আয়োজন চোখে পড়ে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে উর্দু কোন সাময়িকীও প্রকাশ পেতে দেখা যায় না। আগের মতো অনুকুল ও উপযোগী পরিবেশও এখন আর নেই। কওমি মাদরাসায় এখনো উর্দুর পাঠদান রয়েছে তবে পূর্বের মতো জৌলুস আর নেই। দেশে উর্দু সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক আবু সাঈদ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে কওমি মাদরাসায় এখনো উর্দুর পাঠদান রয়েছে। তবে পূর্বের মতো জৌলুস সেখানেও পরিলক্ষিত হয় না। মাদরাসাগুলোতেও পাঠদানের ক্ষেত্রে উর্দুর স্থান দখল করে নিয়েছে মাতৃভাষা বাংলা। কোথাও ব্যতিক্রম হিসেবে কুরআন-সুন্নাহর ভাষা আরবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সর্বত্র যেন উর্দু বিয়োজনেরই আয়োজন চলছে। দিনদিন উর্দুর এই যে বিয়োজন ঘটছে, উর্দু সাহিত্যের মণি-মাণিক্য বাংলা সাহিত্য ধরে রাখছে তো? আমাদের লেখকগণ নিজেদের সাহিত্যে তা কতটুকু ধারণ করতে পারছেন?
এর তত্ত্ব অনুসন্ধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রধান মাওলানা গোলাম রব্বানীর সাথে কথা হয়। তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, বর্তমানের সময়টা গ্লোবাইজেশনের যুগ। তাই উর্দুর মতো একটি অভিজাত ও সমৃদ্ধ সাহিত্য থেকে বর্তমানের কবি-সাহিত্যিকগণ উপকৃত হন না, বলা যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমে উর্দু সাহিত্যের শব্দাবলী ও সাহিত্য সৌকুমার্য অবশ্যই তাদের কাছে পৌঁছে।
এজন্য এখনো দেখা যায়, কবিগণ ছন্দ মিলের জন্য অনেক সময় উর্দু শব্দও কবিতায় ব্যবহার করেন। তাই অন্যান্য বিদেশি সাহিত্যের মতো উর্দু সাহিত্যের সৌকুমার্যও বাংলা সাহিত্যে আছে বলা যায়।
স্বাধীনতা উত্তর পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করা উর্দু্ বিয়োজনের পেছনে কোন প্রভাব ফেলেছে কিনা জানতে চাইলে ঢাবির উর্দু বিভাগের প্রধান প্রতিবেদককে বলেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলাকে উপেক্ষা করায় আমাদের মাঝে একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো।
তখন আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করি। তার জন্য আমাদের অনেক প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে আমাদের সফলতা, এর মাধ্যমে আমরা মাতৃভাষার মান রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছি। ৫৬তে যখন বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দেওয়া হয়, তখন সে দূরত্বটুকু কেটে যায়। গুণীদের মাঝে তার রেশ আর বাকী নেই। তবে এখনো কেউ কেউ নিজেদের সংকীর্ণতা বশত সে দূরত্ব জিইয়ে রেখেছে। সেটা উর্দু বিয়োজনে কোন প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না।
বর্তমানে উর্দু ভাষার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায় কওমি মাদরাসাগুলোতে। মাদরাসাগুলোতে উর্দু ভাষার স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। বিভিন্ন জামাতের পাঠ্যতালিকায়ও রয়েছে উর্দু ভাষার অনেক কিতাব।
কওমি ঘরানার রয়েছে মননশীল ও সৃজনশীল আলাদা লেখক বলয়। তারা উর্দু সাহিত্য থেকে কতটুকু উপকৃত হচ্ছেন, এ ব্যাপারে কথা হয় কওমি ঘরনার প্রতিথযশা লেখক ও দৈনিক ইনকিলাবের সাবেক সহকারী সম্পাদক মাওলানা উবায়দুর রহমান নদভীর সাথে। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, গত দুই তিন দশক আগের কওমি ঘরানার যে সকল লেখক সাহিত্যিক আছেন, তারা উর্দু সাহিত্য থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন। তবে বর্তমানের লেখকগণ কতটুকু উপকৃত হয়েছেন, সে ব্যাপারে আমার জানা নাই।
সময়ের এ প্রতিথযশা সাহিত্যিক নিজে উর্দু থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমি উর্দু সাহিত্য থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। তার সাহিত্য রস নিজের লেখায় ধারণের চেষ্টা করেছি। আমার বিভিন্ন লেখায় তার প্রভাবও লক্ষ্য করতে পারবেন।
ধর্মীয় শিক্ষার জন্য উর্দু সাহিত্যের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে দৈনিক ইনকিলাবের সাবেক এ সহ-সম্পাদক বলেন, গত ১০০ বছর ধরে উপমহাদেশে ধর্মীয় মহলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দ।
এদেশের ধর্মীয় মহল তাই তাদের দ্বারা বিপুল পরিমাণে প্রভাবিত। তারা ধর্মীয় জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন নানা অমূল্য রচনা সম্ভারে। আমরা যেহেতু তাদের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছি। সেজন্য তাদের জ্ঞানভান্ডার থেকে আমাদের উপকৃত হতে হয়। তাদের ভাষা হলো উর্দু। তাদের রচনাবলী উর্দু সাহিত্যের অমূল্য সংযোজন। সেজন্য ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার জন্য উর্দু সাহিত্যের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না।
স্বাধীনতা উত্তর সময়ের বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় প্রচুর পরিমাণে উর্দু-ফার্সী শব্দ দেখা যায়। বর্তমানের কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় সে প্রবণতা দেখা যায় না। এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় ওমরগণি এমইএস কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও জামিয়া ইসলামিয়া জিরির সিনিয়র মুহাদ্দিস শায়খ আ ফ ম খালেদ হোসেনকে।
তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এ দেশে উর্দুর একটি দাপট ছিলো। যে কারণে অনেক কবি-সাহিত্যিক ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের রচনায় উর্দু শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উর্দুর সে প্রভাব অবশিষ্ট ছিলো না। সেজন্য স্বাধীনতা পরবর্তী কবি-সাহিত্যিকগণ নিজেদের লেখায় উর্দু শব্দের ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করেননি।’
কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য উর্দু চর্চা গুরুত্বপূর্ণ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি ভাষার সাথে সে ভাষার মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সম্প্রীতির গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তাতে প্রবন্ধিত হয় সে জাতির জ্ঞানগর্ভ অমূল্য সম্ভার। উর্দু সাহিত্যের রয়েছে ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল রচনা সম্ভার। সে সম্ভার থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য কওমি শিক্ষার্থীদের জন্য আমি উর্দু ভাষা ও সাহিত্য চর্চা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
নবীন কওমি লেখকরা উর্দু সাহিত্য থেকে উপকৃত হন কিনা জানতে চাইলে জামিয়া জিরির সিনিয়র মুহাদ্দিস বলেন, নবীন লেখকরা উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত। উর্দু সাহিত্যের নানা রচনা সম্ভারের সমৃদ্ধ অনুবাদ তার স্পষ্ট প্রমাণ। সেজন্য বলা যায়, বর্তমানের তরুণ লেখকরা উর্দু সাহিত্য থেকে উপকৃত হন।
আসলে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে উর্দুর সাথে রয়েছে বাংলার বিশেষ সখ্যতা। এ ভাষায় লিখেছেন মির্জা গালিব, মুহাম্মদ ইকবাল, মীর তাকি মীর, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আমির খসরু, শাহাদাত হাসান মান্টু এবং আলতাফ হোসেন হালী-সহ অনেক গুণী কবি-লেখক। উর্দু সাহিত্যকে তারা বিশ্বের দরবারে গর্বিত অবস্থানে উন্নীত করেছেন।
সমগোত্রীয় ও সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে উর্দু থেকে স্বাধীনতা উত্তর বাঙালী কবি-সাহিত্যিকগণ অনেক উপকৃত হয়েছেন। এখন উর্দুর প্রবণতা না থাকলেও বিশ্বসাহিত্যের অনিবার্য এ অংশ থেকে সাহিত্য রস যেন আমরা নিতে পিছিয়ে না থাকি।
-এটি