মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী।।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান মিলে এক সময়ের অখণ্ড ভারতে মুসলমানরা সুদীর্ঘ আটশত বছর শাসন করে। ষোড়শ শতাব্দীতে এদেশে ইংরেজ বেনিয়ারা আগমন করে। পরবর্তী সময়ে মুসলমান শাসকদের দুর্বলতা এবং ব্রিটিশ বেনিয়াদের চক্রান্তে এক সময় ভারতের শাসনক্ষমতা মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়। ভারতের স্বাধীনতা চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। এদেশের হিন্দু-মুসলিম সকলেই পরাধীন হয়ে যায়।
ব্রিটিশের হাতে ভারতের শাসনক্ষমতা যাওয়ার পরে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। মুসলমানদের হাত থেকে শুধু যে শাসনক্ষমতা চলে গিয়েছিল তা-ই নয়, মুসলমানদের ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং সমাজব্যবস্থার ওপর আসে প্রচণ্ড আঘাত। ব্রিটিশরা ভারতের শাসনক্ষমতা নিয়ে-ই তুষ্ট ছিল না, তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতবাসীর নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস-চিন্তাচেতনা ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে খ্রিস্টধর্মের প্রচার-প্রসার এবং পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনা ও সমাজব্যবস্থাকে চাপিয়ে দেয়া। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল, এক কথায় তা ছিল এক মহাপ্রলয়।
মুসলমানদের ঈমান ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশরা চারটি মৌলিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তা নিম্নরূপ: ১. মুসলমানদেরকে সরাসরি খ্রিস্টধর্মের দাওয়াত দেওয়া এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশে হাজার হাজার পাদ্রি নিয়োগ দেয়া হয়। পাদ্রিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাটে-বাজারে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ইসলাম, কুরআন ও মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বিভিন্ন কুৎসা রটনা করত। অকল্পনীয় ও ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে ইসলামধর্মের ব্যাপারে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিত। তাদের কিছু উদ্ধৃতি শুনলে আমাদের সামনে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
তৎকালীন ইন্ডিয়ান সুপ্রীম কাউন্সিলের সদস্য স্যার চার্লস ট্রিলিউন পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন ‘এটা আমার বিশ্বাস, এটা আমার আশাÑ আমাদের পূর্বপুরুষগণ যেভাবে একসঙ্গে খ্রিস্টান হয়েছিলেন, এভাবে এখানে হিন্দুস্তানের সকলে একসঙ্গে খ্রিস্টান হবে।’ আরেকজন আইনপ্রণেতা বলেছিলেন ‘ইসলাম এখন হিন্দুস্তানে কয়েকদিনের অতিথি মাত্র।’
২. কৌশলে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করা
যেসব মুসলমানদের ঈমান কিছুটা মজবুত ছিল তাদের ঈমান হরণের জন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। যারা সরাসরি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে না তাদেরকে ঈমানহারা করার জন্য গুরুদাসপুরের কাদিয়ান গ্রাম থেকে মির্জা গোলাম আহমাদকে নবী হিসেবে দাঁড় করাল। এটা ছিল এমন এক ফেৎনা যার ফাঁদে মুসলমানরা নিজের অজান্তেই ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছিল।
৩. নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা
ব্রিটিশরা আরিয়া সমাজ নামে সম্পূর্ণ নতুন এক ফেৎনা দাঁড় করিয়েছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। তারাও মুসলমানদেরকে মুরতাদ বানানোর জন্য বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করেছিল। এই ফেৎনা অনেকটা আকবরের দীনে ইলাহীর মতো ছিল।
৪. শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস
ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী যে আক্রমণটা করেছিল এবং যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, তা হলো মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া। ভারতবর্ষে মুসলমানদের হাজার হাজার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের ছিল নিজস্ব ওয়াকফিয়া ভূসম্পত্তি। যার আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হত। ব্রিটিশ সরকার কলমের এক খোঁচায় এসব ওয়াকফিয়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। যার ফলে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ব্রিটিশ সরকার পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষকে ব্রিটিশের গোলাম বানানো। আমাদের জাতীয় চেতনাকে নিস্তেজ করে দেওয়া। জাতীয়তাবোধ বিলুপ্ত করে ব্রিটিশের কেরানি তৈরি করা। আত্মমর্যাদা বিস্মৃত ও ধর্মহীন একটি জাতি তৈরি করা। এই শিক্ষাব্যবস্থা জারি করার সময়ে এর প্রণেতা লর্ড মেকলি যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছিলেন তা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন ‘আমাদের ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো এমন যুবক তৈরি করা যারা বংশে ও বর্ণে হবে হিন্দুস্তানি এবং চিন্তাচেতনায় হবে খাঁটি ইংরেজ।’
মুসলিম সমাজ রক্ষায় কাসেম নানুতবি রহ.-এর নানামুখী কর্মতৎপরতা
মুসলমানদের এহেন দুর্দিনে ওলামায়ে কেরাম ভারতবাসীর, বিশেষত মুসলিম জাতির ভবিষ্যত-চিন্তায় অস্থির ছিলেন। ফলে তাঁরা আগ্রাসী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে একদিকে সশস্ত্র জেহাদে নেতৃত্ব দেন, অন্য দিকে মুসলিম জনমানসে সন্দেহ-অবিশ্বাসের যে বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার সফল মোকাবেলা করেন। এই কাফেলারই অগ্রসেনানী ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.। মুসলিম সমাজকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিলীন ও ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য যিনি নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন। সর্বগ্রাসী প্লাবনে ডুবন্ত মুসলিম সমাজকে উদ্ধারের লক্ষ্যে তিনি ত্রিমুখী কর্মতৎপরতা শুরু করেন। মোহাবাসা, গ্রন্থ রচনা ও শিক্ষাবিপ্লব। এই তিন পন্থায় তিনি হয়ে উঠেন মুসলিম সমাজ ও ভারতবাসীর ত্রাণকর্তা।
১. মোবাহাসা বা বিতর্কসভা
মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ. ব্রিটিশের ইসলামবিরোধী যাবতীয় ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দেন। পাদ্রিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখী বিতর্কসভা করেন। মোবাহাসা করেন। পুস্তক রচনা করেন। তার মোবাহাসাসমূহের মধ্যে মোবাহাসায়ে শাহজাহানপুর একটি ঐতিহাসিক বিতর্কসভা।
এই মোবাহাসা অনুষ্ঠিত হয় ১২৯৫ হিজরি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে। ইসলাম বনাম অন্যান্য ধর্মের এই বিতর্কসভায় খ্রিস্টধর্মের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন পাদ্রি নুলস্, পাদ্রি ইস্কাট, পণ্ডিত দয়ানন্দ সরস্বতী, মুনশী আন্দরমন প্রমুখ। পাদ্রি নুলস্ তার বক্তব্যে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন।
হযরত কাসেম নানুতবি রহ. যুক্তি ও কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলাম ধর্মের সত্যতা এমনভাবে প্রমাণিত করেন যে, পাদ্রিরা পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। হিন্দুধর্মের পণ্ডিত মুনশি পেয়ারে লাল এই বিতর্কসভার পরে কাসেম নানুতবি রহ.-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেনÑ ‘ মৌলবি কাসেমের কথা কি বলব! মনে হয় তার অন্তরে জ্ঞানের সরস্বতী দেবী বসে সব বলে দিচ্ছিল।’
তৎকালে মুসলমানরা ছিল দিশেহারা। তাদের সামনে ছিল না কোনো দিক-নির্দেশনা। একদিকে রাজত্ব হারানোর বেদনা, অন্য দিকে মুরতাদ বানানোর অশুভ তৎপরতা। সব মিলিয়ে এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মুসলমানদের দিনাতিপাত করতে হচ্ছিল। এমন সময়ে এসব মুনাজারা ও বিতর্ক মুসলমানদের মধ্যে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা পথের সন্ধান পায়, আশ্রয় খুঁজে পায়।
শারীরিক নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও আরিয়া সমাজের ফেৎনা মোকাবেলা করার জন্য তিনি ছুটে যান রুড়কিতে। আরিয়া সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ইসলামের বিরুদ্ধে নানান বিষোদগার করে যাচ্ছিল। স্থানীয় আলেম-ওলামাগণ তাকে বিতর্ক সভায় বসার জন্য আহ্বান করল। কিন্তু তার দাবি ছিলÑ ‘শুধু মাওলানা কাসেমের সাথেই আমি বিতর্ক করব’।
কাসেম নানুতবি রহ. তখন গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ কোনো কথা শোনতে রাজি নয়। অবশেষে অসুস্থ শরীর নিয়ে রুড়কিতে হাজির হন। কিন্তু স্বামী দয়ানন্দ নানা তালবাহানায় বিতর্কে রাজি হলো না।
বাধ্য হয়ে কাসেম নানুতবি রহ. সঙ্গীদের নিয়ে রুড়কিতে একটি জনসভা করেন। সেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে দয়ানন্দের মিথ্যা অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব দেন। সাধারণ মুসলমানদের কলিজায় তখন পানি আসে। ফলে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান কুফরির হাত থেকে রক্ষা পায়। এভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে যে মহাপ্রলয়ের আবির্ভাব হয়েছিল তা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
২. সমাজ বদলে গ্রন্থ রচনা
কাসেম নানুতবি রহ. শুধু বিতর্কই করেননি, লিখে গেছেন অসংখ্য রচনা। তাঁর এক অমরকীর্তি হলো বুখারী শরীফের টীকা রচনা করা। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আহমাদ আলী সাহারানপুরি রহ. বুখারী শরীফের টীকাগ্রন্থের কাজ আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে শেষ পাঁচ-ছয় পারার কাজ করতে পারছিলেন না। সাহারানপুুরি রহ. সে কাজ অর্পণ করেন মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.-কে। তিনি তখন যুবক। যুবক বয়সেই সম্পন্ন করেন এই অমর কীর্তি।
ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান মিশনারিদের মিথ্যা অভিযোগের জবাবেও অনেকগুলো কিতাব রচনা করেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো এই হুজ্জাতুল ইসলাম: হযরত নানুতবি রহ.-এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কিতাব হলো হুজ্জাতুল ইসলাম। এই কিতাবে অন্যান্য ধর্মের ওপর ইসলামের সত্যতা প্রমাণিত করা হয়েছে। সাথে সাথে অপরাপর ধর্মের বিভিন্ন অসারতা এবং বিবেকবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
ইন্তেসারুল ইসলাম: আরিয়া সমাজের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ১১ টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। তার মধ্যে ১০ টি প্রশ্নের উত্তরে নানুতবি রহ. একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার নাম ‘ইন্তেসারুল ইসলাম’।
কেবলানুমা: আরিয়া সমাজের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এগার নম্বর অভিযোগের উত্তরে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। আরিয়া সমাজের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে শিরকের অভিযোগ করে বলা হয়েছিলÑ মুসলমানরা কাবাঘরের পূজা করে। এই বইয়ে অভিযোগটির অসারতা প্রমাণ করা হয়।
তাকরীরে দিল-ফেজির: দাওয়াতমূলক একটি কিতাব। হৃদয়ের দরদ ও ভালোবাসার মিশ্রণে সারাবিশ্বের সকল মানুষের সামনে ইসলামের সত্যতা তুলে ধরা হয়েছে এই কিতাবে।
আবে হায়াত: হযরত নানুতবি রহ.-এর আরেকটি বিখ্যাত কিতাব হলো আবে হায়াত। এই কিতাবের বিষয়বস্তু হায়াতুন্নবী তথা কবর জগতে রাসূলের জীবিত থাকা বিষয়ে। ফদকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিয়ারা হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাযি. যে জঘন্য ভাষায় গালাগালি করে, এই কিতাবে তারও সমোচিত জবাব দেওয়া হয়।
মুবাহাসায়ে শাহজাহানপুর: খ্রিস্টান পাদ্রিদের সাথে শাহজাহানপুরে নানুতবি রহ. যে মুনাজারা ও বিতর্ক করেছিলেন এই কিতাবে তার বিস্তারিত আলোচনা ও বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বিতর্কসভায় কাসেম নানুতবি রহ. যে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছিলেন, প্রায় হুবহু শব্দে এই কিতাবে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া তাঁর লিখিত আরো অনেক কিতাব রয়েছে। যেমন: জামালে কাসেমি, মাকতুবাতে কাসেমিয়া, ফুয়ুজে কাসেমিয়া, লাতায়েফে কাসেমি, তাসফিয়াতুল আকায়েদ, তুহফায়ে লাহমিয়া, আসরারে কুরআনি, আল হক্কুস সরীহ, তাওছীকুল কালাম, জওয়াবে তুর্কি বা-তুর্কি, হাদিয়াতুশ শিয়া, তাহজিরুন্নাস, মাসাবিহুত তারাবিহ ইত্যাদি।
হযরত নানুতবি রহ.-এর এসব রচনা অধঃপতিত মুসলিম সমাজের আত্মরক্ষা এবং দিগদর্শনে অনেক বড় অবদান রেখেছিল। একটি পতনোন্মুখ জাতিকে দিয়েছিল পথের দিশা। ব্রিটিশ বেনিয়াদের কূটকৌশলের ফলে যে মুসলমানরা হয়েছিল দিকভ্রান্ত, তারা খুঁজে পেয়েছিল আশ্রয়ের ঠিকানা।
৩. শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। ব্রিটিশ আগ্রাসীরা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে মুসলমানদের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়ার পলিসি গ্রহণ করেছিল। ১৮৫৭ সনে স্বাধীনতা-আন্দোলনে সিপাহি-জনতার বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা এমন করুণ হয়ে গিয়েছিল যে, আলেমগণ নিরাপদ থাকতে পারলেন না।
আলেমদের ওপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর শাস্তির খরগ। সারা দেশ তখন হতাশার কালো চাদরে ঢাকা। আলেমগণ অনেকেই রণাঙ্গনের লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন। অনেকে ফাঁসির কাষ্ঠে জীবন দিয়েছেন। অনেকে হেজাজে হিজরত করেছেন। রণাঙ্গনে লড়াই করার মতো অবস্থা তখন নাই। নেতৃত্ব দেওয়ারও কেউ নেই। ভারতবর্ষ তখন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঘোরতর পরিস্থিতির মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যত তখন চরম সঙ্কটে নিপতিত। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও ছিলেন পরম শঙ্কিত।
গুটিকয় আলেম যারা তখনো বেঁচে ছিলেন তাদের চিন্তাচেতনায় ছিল শুধুই জাতি ও ধর্মের ভবিষ্যত। এই চিন্তার ফসল হিসেবে ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী মোতাবেক ৩০ মে ১৮৬৭ ঈসাব্দে সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছাত্তা মসজিদের বারান্দায় ডালিম গাছের নিচে চালু হয় এক ঐতিহাসিক শিক্ষাকেন্দ্র; যাকে শিক্ষাবিপ্লব বা দেওবন্দ আন্দোলন নামে অবিহিত করা হয়।
এই শিক্ষাকেন্দ্র পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার মোকাবেলায় মুসলমানদের ঈমান, আমল, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ, স্বাধীনতা, আত্মগৌরব ও ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার এক দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য যার চিন্তাচেতনা ও কর্মকৌশল সবার আগে আগে ছিল তিনি হলেন মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.।
কাসেম নানুতবি রহ. ছিলেন দারুল উলূমের প্রাণপুরুষ। তিনি দারুল উলূমকে পরিণত করেন বাতিলের মোকাবেলায় এক অতন্দ্র প্রহরীরূপে। ফলে দারুল উলূম একদিকে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত হয় অপরদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইসলামবিরোধী কাজ মূলেৎপাটনে কালজয়ী ভূমিকা পালন করে।
কুরআন ও হাদীস হলো মুসলিম সমাজের জীবনসঞ্জীবনী। মুসলমানদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও আত্মগৌরবের রক্ষাকবচ। এই চিন্তাচেতনাকে সামনে রেখে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কুরআন হাদীসকেই মৌলিক সিলেবাস হিসেবে গ্রহণ করে।
হযরত কাসেম নানুতবি রহ.-এর সিদ্ধান্ত কতটা নির্ভুল ছিল ইতিহাস-ই তার সাক্ষী। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে দারুল উলূম দেওবন্দ যে অবদান রেখেছে তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। দারুল উলূম দেওবন্দে থেকে তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা-আন্দোলনের বীর-সেনানী শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ও হুসাইন আহমাদ মাদানীর মতো বহু ব্যক্তিত্ব। ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনে তাঁদের অবদান কোনো দুশমনও অস্বীকার করতে পারবে না। শায়খুল হিন্দ রহ.-এর রেশমি রুমাল আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।
কাসেম নানুতবি রহ. প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, ছিল একটি বিপ্লব। মুসলমানদের আত্মমর্যাদা জাগরণের বাতিঘর। ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের শিক্ষা ও সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ. হলেন এক প্রাণপুরুষ। তাঁর শিক্ষাবিপ্লবের ফলে আজ শুধু ভারত নয়, ইসলামের সঠিক শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়।
ফলে বিশ্বব্যাপী সহিহ ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তাচেতনার ধারক-বাহক হলেন ওলামায়ে দেওবন্দ। ইসলামের ইতিহাসে তাই হুজ্জাতুল ইসলামের নাম থাকবে স্বর্ণোজ্জ্বল, চির স্মরণীয়।
মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ. একটি বিপ্লব, একটি চেতনা; একটি প্রত্যয়, একটি ঠিকানা; একটি আবেগ, একটি মোহনা; একটি আন্দোলন, একটি প্রেরণা। নিখিল ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের মহানায়ক; সমাজ সংস্কারক; শিক্ষাবিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা।
-এটি