মুফতি নাজমুল হাসান: সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মসজিদের একটি কাঁঠাল বিক্রি হয়েছে ২৬ হাজার টাকায়, যার বাজার মূল্য স্থানীয়দের মতে সর্বোচ্চ একশত টাকা৷ আমাদের দেশে প্রায় সময় মসজিদের গাছের ফল নিলামে চড়া দামে বিক্রি করা হয়৷ ক্রেতারাও তা স্বাচ্ছন্দে ক্রয় করে থাকেন৷ কিন্তু জনমনে প্রশ্ন জাগে— শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন ক্রয় বিক্রয়ের হুকুম কি?
আল্লাহ তা‘আলা হালাল পন্থায় ব্যবসা করার মাধ্যমে একে অপরের সম্পদ ভোগ করাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু লাভ করার কোন পরিমান নির্ধারণ করে দেন নি৷ বরং পরস্পর সন্তুষ্ট চিত্তে যেকোনো পরিমান লাভ করার সুযোগ প্রদান করেছেন৷ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ ۚ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না৷ তবে পরস্পর সন্তুষ্টি চিত্তে ব্যবসার মাধ্যমে ভোগ করতে পারো৷’ (সুরা নিসা: আয়াত ২৯)
শরীয়ত যেহেতু লাভের পরিমান নির্ধারনের ক্ষেত্রে কোন দখলদারিত্ব করে না, তাই বিক্রেতা নিজের পণ্যে যত ইচ্ছে ততো লাভ নিয়ে বিক্রি করতে পারে৷ হাদীসে রয়েছে,
أنَّ النَّبيَّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ أعْطَاهُ دِينَارًا يَشْتَرِي له به شَاةً، فَاشْتَرَى له به شَاتَيْنِ، فَبَاعَ إحْدَاهُما بدِينَارٍ، وجَاءَهُ بدِينَارٍ وشَاةٍ، فَدَعَا له بالبَرَكَةِ في بَيْعِهِ، وكانَ لَوِ اشْتَرَى التُّرَابَ لَرَبِحَ فِيهِ.
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উরওয়া রা. কে এক দিনার দিলেন একটি বকরি ক্রয় করতে৷ অতঃপর তিনি এক দিনার দিয়ে দুটি বকরি ক্রয় করলেন৷ এরপর সেখান থেকে একটি বকরি বিক্রি করলেন এক দিনারে৷ তারপর এক দিনার এবং একটি বকরি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন৷ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (খুশি হয়ে) তার জন্য ব্যবসায় বরকতের দুঅা করলেন৷ (বুখারী: হাদীস নং ৩৬৪২)
দুটি বকরি এক দিনারে ক্রয় করা আবার তারমধ্য হতে একটি আবার পূর্ণ এক দিনারে বিক্রি করা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক বাজারদর হিসেবে ছিলো না।
অপরদিকে ইসলামী শরীয়তে পণ্য নিলামে বিক্রি করার সুযোগ রয়েছে৷ আর নিলামের বিক্রিতে বাজার দরের প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ বরং যে বেশি দাম দিবে সেই পণ্য নিতে পারবে৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে নিলাম করেছেন৷ আনাস (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জিনপোশ এবং একটি পাত্র বিক্রি করেছেন৷ তিনি বললেন,
من اشترى هذا الحلس والقدح؟ فقال رجل: أخذتهما بدرهم، فقال: من يزيد على درهم؟ فأعطاه رجل درهمين، فباعهما منه.
‘এই জিনপোশ এবং পাত্র কে কিনবে? এক ব্যক্তি বললো আমি এক দিরহাম দিবো৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, এক দিরহামের বেশি দিতে কেউ প্রস্তুত? অতঃপর এক ব্যক্তি দুই দিরহাম দিলো৷ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যক্তির কাছে তা বিক্রি করে দিলেন৷’ (তিরমিজি: হাদীস নং ১২১৮)
তবে সমাজে প্রচলিত এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় যায়েজ হলেও এ ব্যাপারে কিছু বিষয় বেশ লক্ষণীয়, সেগুলো হচ্ছে— ১. এমন চড়া দামে ক্রয়-বিক্রয় করা অমানবিক ও উত্তম আদর্শ বিরোধী৷ এ সম্পর্কে দারুল উলুম দেওবন্দের একটি ফাতওয়া হল,
عاقدین اگر جھوٹ ودھوکہ دہی سے بچتے ہوئے باہمی رضامندی سے کسی بھی قیمت پر معاملہ کرلیں تو اس کی گنجائش ہوگی خواہ اس میں کتنا ہی نفع ہو ؛البتہ اس قدر نفع لینے کو فقہاء نے نامناسب اور خلافِ مروت کہا ہے جو غبنِ فاحش کے دائرے میں آتا ہو
‘ক্রেতা-বিক্রেতা মিথ্যা এবং প্রতারণা না করে পরস্পর সন্তুষ্টি চিত্তে যে মূল্য নির্ধারণ পূর্বক লেনদেন করবে তা বৈধ রয়েছে৷ চাই তাতে লাভের পরিমান যত বেশি হোক না কেন৷ কিন্তু 'গবনে ফাহেশ' (অর্থাৎ এমন মূল্যে লেনদেন করা যে মূল্য কোন বাজার নীতিনির্ধারকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়) এ লেনদেন করাকে অনুচিত এবং মানবিকতার বিরোধী মনে করেন৷’ (ফতোয়া দারুল উলূম দেওবন্দ, ফতোয়া নং ১৬৯৯৪৩)
২. মসজিদের গাছের ফল চড়া দামে কিনলেও তাতে কোন সাওয়াব অর্জিত হবে না৷ বরং সবগুলো টাকা ফলের বিনিময় হিসাবেই ধরা হবে৷ যদিও এই টাকা দিয়ে মসজিদের উন্নয়ন, আসবাব বা যা কিছুই ক্রয় করা হোক না কেন৷
৩. মসজিদের গাছের ফলের কোন বিশেষত্ব নেই৷ এটি খেলে রোগ ভালো হবে বা সংসারে আয়-উন্নতি হবে, এমন চিন্তা-ধারা পোষণ করে রাখলে তা মারাত্মক গুনাহের কারণ হবে৷
লেখক ও শিক্ষক