।। মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ।।
بسم الله الرحمن الرحيم.
نحمده ونصلي على رسوله الكريم. أما بعد :
فقد قال الله تعالى : هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ. وقال النبي صلى الله عليه وسلم : إنما بعثت معلما.
তরীকে তালীম বা শিক্ষাদান পদ্ধতি বলতে শুধু দরসে কীভাবে পাঠদান করা হবে সেটিই বুঝায় না। বরং দরসের আগে এবং দরসের পরেও এমন কিছু করণীয় রয়েছে যেগুলো শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত। সেমতে তরীকে তালীম বা শিক্ষাদান পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনাকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করে পেশ করব। (1) দরসে যাওয়ার আগে মুতালাআ ও দরসের মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যা যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দশটি উসূল। (2) দরসে গিয়ে দরস দানের ক্ষেত্রে যা যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশটি উসূল।(3) দরসের বাইরে ছাত্র গড়ার জন্য যা যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দশটি উসূল। এই মোট চল্লিশটি উসূলকে আমি তিন ভাবে বিভক্ত করে তিন পর্বে পেশ করব ইনশা আল্লাহ। এই চল্লিশটি উসূলই সর্বসাকুল্য শিক্ষাদান পদ্ধতি।
প্রথম পর্ব:-
দরসে যাওয়ার আগে মুতালাআ ও দরসের মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যা যা করতে হবে
1. কোন সবক পরিষ্কার না বুঝে দরসে না যাওয়া। পরিষ্কার করে বুঝার জন্য লফজে লফজে হরফে হরফে ফিকির করে বুঝতে হবে। মুতালাআ হওয়া চাই ফিকিরের সাথে। লফজে লফজে হরফে হরফে ফিকির করে মুতালাআ হওয়া চাই। যেমন بسم الله الرحمن الرحيم-এর ب কোন অর্থে, অর্থ করার সময় সেটা উঠছে কি না। الرحمن ও الرحيم -এর মধ্যে কী পার্থক্য? তরজমায় সেটা উঠছে কি না। ইত্যাদি।
লফজে লফজে হরফে হরফে ফিকির করে পরিষ্কার করে বুঝলে অনেক কিছু واضح হয়। যেমন আমরা মুদাররিস। আমরা মুদাররিসী করি। মুদাররিস কাকে বলে, মুদাররিস কথাটির অর্থ কি তা যদি আমরা ফিকির করে পরিষ্কার করে বুঝি তাহলে অনেক কিছু واضح হবে। যেমন আমরা তালিবে ইলমদের বুঝাই তালিবে ইলম কাকে বলে যার মধ্যে ইলম-এর তলব আছে। অতএব তলব না থাকলে ইলম আসবে না। আবার ইলম অর্থ নিশ্চিত জানা। علم الشيئ إذا تيقن به অতএব অস্পষ্টভাবে কোন কথা শিখলে চলবে না, কারণ সেটা ইলম নয়। এভাবে তালিবে ইলম শব্দের ব্যাখ্যা করে আমরা তালিবে ইলমদের জন্য কী কী করণীয় এমন অনেক কিছু বের করি। তদ্রূপ মুদাররিস শব্দটির ব্যাখ্যা করলেও মুদাররিসদের কি কি করণীয় তার অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। সেমতে আমরা ভেবে দেখতে পারি মুদাররিস শব্দটি এসেছে تدريس থেকে। এখন আমরা দেখি تدريس -এর কী অর্থ?সেখান থেকে বের করা হবে মুদাররিস-এর কি কি করণীয়।
التدريس بمعنى إعطاء الدرس والدراسة. وفيه خاصية إعطاء المأخذ.
আর এর অর্থ:
معنى الدرس :
শিক্ষা, আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা, মুছে ফেলা।
অতএব দরসের মধ্যে 10টি জিনিস থাকতে হবে। শিক্ষা, আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা, ভুল জ্ঞান মুছে দেয়া, সঠিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করা, সঠিকভাবে জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভাল করে বুঝানো, ভাল করে বুঝানোর জন্য নিজে ভাল করে বুঝা, সাজিয়ে গুছিয়ে বলা ও সংক্ষেপে বলা।
পরিষ্কার করে বুঝার জন্য প্রয়োজনে মাতাহতী উস্তাদের স্মরণাপন্ন হতেও লজ্জা না করা চাই। হযরত ইয়া'কূব নানুতবী রহ. তার অধীনস্থ উস্তাদের কাছেও মুরাজাআত করতেন।
2. মুতালাআ হওয়া চাই ফন্নী। শুধু নির্দিষ্ট কিতাবটি নয় বরং সংশ্লিষ্ট পুরো ফন হল করা চাই। তাহলে তার দ্বারা ছাত্র ভাল গড়ে উঠবে। বস্তুত মাহেরে ফন উস্তাদের এক দরস মাহের নয়- এমন উস্তাদের বহু দরসের চেয়ে উত্তম। উস্তাদ মাহেরে ফন হলে তার ছাত্ররাও মাহেরে ফন হয়ে ওঠে।
3. অন্তত যে কোন এক ফনে মাহের হওয়া। এক ফনে মাহের হলে অন্য অনেক ফনের আলোচনায় তার প্রভাব পড়ে।
4. কাদীম পরিভাষার পাশাপাশি জাদীদ পরিভাষা উদ্ধার করা। যেমন শরহে আকায়েদ কিতাবে حواس باطنه কথাটির টীকায় মস্তিষ্ককে তথা স্মৃতিভাণ্ডারকে তিন ভাগে ভাগ করে তিনটার নামে উল্লেখ করা করা হয়েছে- التجويف المقدم একে বলে সংবেদী স্মৃতি ভাণ্ডার (Sensory memory), التجويف الأوسط একে বলে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি ভাণ্ডার (Sort term memory), التجويف المؤخر একে বলে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি ভাণ্ডার (Long term memory)। এমনিভাবে শরহে আকায়েদ-এর حواس ظاهره বা বহিঃইন্দ্রীয় সম্পর্কিত কয়েকটি ইবারত লক্ষ্য করা যাক-
السمع وهي قوة مودعة في العصب المفروش في مقعر الصماخ.
এখানে العصب المروش হচ্ছে অডিটরি স্নায়ু।
والبصر وهي قوة مودعة في العصبتين المجوفتين اللتين تتلاقيان ثم تفترقان فتؤديان إلى العينين.
এখানে العصبتين المجوفتين হচ্ছে অপটিক স্নায়ু।
والذوق وهي قوة منبثة في العصب المفروش على جرم اللسان.
এখানে العصب المفروش غلى جرم اللسان হচ্ছে স্বাদ গ্রহণ কোষ। ইংরেজিতে বলে টেস্ট বাড।
5, কাদীম মাসআলার পাশাপাশি জাদীদ মাসআলা উদ্ধার করা। এর জন্য آلات جديده كي شرعي احكام ,فقهى مقالات , اسلام اور جديد معيشت وتجارت , تكملة فتح الملهم ইত্যাদি মুতালাআ করা যেতে পারে।
6. কোন চিন্তাধারা ও মতবাদ বিষয়ক আলোচনা সামনে এলে তার সাথে সংশ্লিষ্ট আধুনিক চিন্তাধারা ও মতবাদ সম্বন্ধেও মুতালাআ করে নেয়া। কদীম জাদীদ বিভিন্ন চিন্তাধারা ও মতবাদ সম্বন্ধে জানার জন্য কী কী গ্রন্থের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে তার একটি তালিকা তরীকে তালীম পুস্তকে প্রদান করা হয়েছে। আমার রচিত ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ- এই একটি গ্রন্থেই কদীম জাদীদ অনেক ভ্রান্ত মতবাদ ও ভ্রান্ত ফিরকা সম্বন্ধে আলোচনা রয়েছে।
7. মূল কিতাব হল করার জন্য শরাহ শুরুহাতের উপর নির্ভরতার চেয়ে কিতাবের মূল ইবারত নিয়ে বেশি ফিকর করা চাই। সংক্ষেপে শরাহ মুতালাআ করতে চাইলে কোন একটি নির্দিষ্ট শরাহ মুতালাআ করার চেয়ে হাশিয়া মুতালাআকে প্রাধান্য দেয়া চাই। সাধারণত হাশিয়া جامع الشروح হয়ে থাকে। কারণ হাশিয়াতে অনেক শরাহ থেকেই তথ্যাবলি আনা হয়ে থাকে। হ্যাঁ সময় থাকলে আলাদা আলাদা শরাহ মুতালাআ করা যেতে পারে।
কোন কিতাবের জন্য কোন কোন শরাহ মুতালাআ করা যায় এটা একটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। আবার নিত্য নতুন শরাহ শুরূহও প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে। আবার এক একজনের কাছে একেক শরাহ ভাল লাগে। এ ব্যাপারে উত্তম হল কারও জিম্মায় কোন কিতাব এলে সেই কিতাব আগে যেসব যোগ্য উস্তাদগণ পড়িয়েছেন তাদের কারও থেকে সেই কিতাবের শরাহ শুরূহের ব্যাপারে জেনে নেয়া।
8. মুতালাআর পর দরসে উপস্থাপনের জন্য চিন্তা করা ও রিহার্সেল দেয়া। যে উস্তাদ মুতালাআ করার পর উপস্থাপনের ব্যাপারে যত বেশি চিন্তা করে নিবেন এবং মনে মনে রিহার্সেল দিয়ে নিবেন তিনি তত আকর্ষণীয় করে পাঠদান করতে সক্ষম হবেন। চিন্তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এ বিষয়টা থাকবে যে, কীভাবে আলোচ্য বিষয়টি সহজে, বোধগম্য করে ও সংক্ষেপে পেশ করা যায়। যেমন আমরা বলতে পারি دلَّ অর্থ দালালত করে, এরপর دلالت -এর ব্যাখ্যা দিলাম- এভাবে না বলে বলতে হবে دلَّ অর্থ বুঝায়। حلول سريانى অর্থ দ্রবণ। حلول طريانى অর্থ মিশ্রণ ইত্যাদি- এভাবে সহজে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।
9. প্রত্যেকটা কিতাবের সবক কী ধারায় পড়াবে, আলোচনা কয়টা পর্যায়ে হবে তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। তরীকে তা'লীম পুস্তকে প্রত্যেকটা ফনের কিতাব কী ধারায় পড়াতে হবে, কোন ফনে আলোচনার কয়টা পর্যায় থাকবে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় তরজমায়ে কুরআনের সবকে আলোচনাকে ছয়টি পর্যায়ে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। (1) পূর্বের সঙ্গে আয়াতের সঙ্গে ربط থাকলে তা বয়ান করা। (2) শানে নুযূল বা সংশ্লিষ্ট ঘটনা থাকলে তা বর্ণনা করা। (3) তরজমা বলা। (4) বিশিষ্ট শব্দাবলির তাহকীক ও তাশরীহ বলা। (5) وجوه البلاغة বয়ান করা। (5) ما يستفاد من الآيات বয়ান করা।
10. প্রত্যেকটা কিতাব শুরু করার আগে সেই কিতাবের মুসান্নিফ ও সেই কিতাব সম্বন্ধে এবং কিতাবটি যে ফনের সেই ফনের পরিচয় সম্বন্ধে বিস্তারিত মুতালাআ করে নিতে হবে। এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের সামনে এ বিষয়গুলো এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যেন তারা কিতাব, কিতাবের মুসান্নিফ ও সংশ্লিষ্ট ফন সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। সংশ্লিষ্ট ফনের মাবাদিয়াত নিয়েও মুতালাআ ও ছাত্রদের সামনে তার বর্ণনা আসা চাই। প্রত্যেকটা ফনের মাবাদিয়াত কি কি সে সম্বন্ধে তরীকে তালীম পুস্তকে বর্ণনা রয়েছে।
চলবে..।
-কেএল