সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মনে আছে কিশোরগঞ্জের সেই কিশোর শহিদের কথা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদুল্লাহ আহনাফ

সময়টা ছিল ১৯৯৪ সালের ৩০শে জুন। গোটা দেশ তখন জনসাধারণে উত্তাল-উৎকট। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর, পাড়া-মহল্লার তরুণ-যুবকরা সবাই রাস্তায়। দাবি তাদের একটাই! গোস্তাখেরাসূল তসলিমা নাসরিনের বিচার চাই।

তসলিমা নাসরিন তার কথায় আল্লাহর রাসূল সা. ও কুরআনের কিছু আয়াত নিয়ে কটুক্তি ও মন্দবাক্য উচ্চারণ করে। যা মেনে নিতে পারেনি ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আশিকে রাসূলগণ। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভ ও ক্রোধে ফেটে পড়ে। শুরু হয় প্রতিবাদ। তীব্র প্রতিবাদ।

নবী প্রেমে উজ্জীবিত ধর্মপ্রাণ মানুষের এহেন কঠোর প্রতিবাদে বোরকা পরেই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তসলিমা নাসরিন—যে বোরকাই ছিল তসলিমা এবং তার মতো নষ্টাদের চুলকানি।

নবী প্রেমের এই প্রতিবাদে—আমাদের কিশোরগঞ্জের নবিপ্রেমীকরাও রাস্তায় নেমেছিলেন। আন্দোলন করেছিলেন জানপ্রাণ দিয়ে। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের আইডল—আইকন রাসূল সা. এর সম্মান আমাদের জীবনের চেয়েও অধিক বেশি।

রবির কিরণ পুবাকাশে মাথাচাড়া দিয় উঁকি দেবার পূর্বেই শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলন চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সেই আন্দোলনে শরীক হয় কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাই। তাদের মধ্যে ছিল কিশোর শহীদ আরমান রহ.।

শহীদ আরমান সেদিন প্রকৃত নবিপ্রেমের স্বাক্ষর রাখে। বয়স তখন তার চৌদ্দ। নবযৌবনপ্রাপ্ত এক নির্ভীক যুবক। শহীদ আরমানের বসতবাড়ি বর্তমান কিশোরগঞ্জের শহিদি মসজিদের পাশেই ছিল। তার পড়াশোনা স্কুল ছিল আজিমউদ্দিন সরকারি হাইস্কুল। আজিমউদ্দিন সরকারি হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিল সে।

বাল্যকাল থেকেই সে শহিদি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তো। তখনকার সময়ে স্কুলে নামাজের জায়গা ছিল না, তাই কয়েকজন সহপাঠীকে সাথে করে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানের ব্যবস্থা করিয়ে নেয়। যা আজও বক্ষমান। মজার বিষয় হলো, আরমান স্কুলে পড়লেও তার বন্ধুদের অধিকাংশ-ই ছিল জামিয়া ইমদাদিয়ার ছাত্র।

হঠাৎ একদিন শুনে তসলিমা নাসরিন নামি এক নষ্টা-ভ্রষ্টা নাস্তিক লেখিকা প্রিয় নবী সা. ও পবিত্র কালামুল্লাহ নিয়ে কটুক্তি করে। গোস্তাখি করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে। ভুল ধরে কুরআনের।

সে এও বলে কুরআনে নাকি নারীদের অমূল্যায়ন করে আয়াত নাযিল করা হয়েছে। যা কিনা সংশোধন করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের কলিজা হযরত নবীয়ে আকরাম সা.–কে সে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ভাষায় কটুক্তি করেছিল। যা সহ্য হয়নি কাররই। প্রিয় নবীর অবমাননা মেনে নিতে পারেনি কেউ। সারা দেশের আলিম উলামারা প্রতিবাদে জ্বলে উঠেন, ব্যতিক্রম ছিল না কিশোর আরমানও। সেউ যোগ দেয় প্রতিবাদ মিছিলে।

তসলিমা নাসরীনের বিচার দাবিতে ৩০ জুন সারা দেশের মতো কিশোরগঞ্জেও হরতাল-অবরোধ ছিল। সেদিন আরমান ফজরের আযান শুনে সবাইকে ডেকে তুলে। নামায পড়ে বাসায় এসে মা'কে বলল, মা, মিছিলে যাব, কিছু খেতে দাও। মা ভয় পেয়ে বললেন, 'বাবা মিছিলে যাসনে। মিছিলে মারামারি হতে পারে। তুই ছোট! তোর যাওয়া লাগবে না।’

নবীর প্রেমে উজ্জীবিত আরমান জবাবে বলে, 'মা আমি যাবই। আমার যেতেই হবে। গতকাল মাওলানা সালাহউদ্দিন (তখনকার জামিয়া ইমদাদিয়ার মুহাদ্দিস) হুযূরের কাছে জেনেছি, কুরআনের সম্মান রক্ষার জন্য যারা মারা যায়, তারা শহিদ। জান্নাত হবে তাদের ঠিকানা।'

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় আরমান। চলে যায় তসলিমার বিচার চেয়ে মিছিলে, এবং সে মিছিলেই ছিল তার জীবনের শেষ মিছিল। সে মিছিলেই পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় আরমান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইলাইহি রাজিউন।

জামিয়া ইমদাদিয়া মাদরাসার ইলেকট্রিশিয়ান গাজী আশরাফ ভাই। আরমান শহিদ হওয়ার সময় তারা দু-জন একসঙ্গে ছিলেন। দুজনই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আরমান শহিদ হয়, আর তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। এজন্যই গাজী উপাধি পাওয়া তার।

তার কাছ থেকেই আরমানের ঘটনা শোনা হয়। বেশ সময় নিয়ে সব বললেন তিনি। তার পাঁজরের হাড্ডিতে একটি গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়া স্থানটা আমাদের দেখান তিনি। ক্ষতস্থানটা দেখে আমরা শিউরে উঠতাম। ইশ! একটুর জন্য বেঁচে গেলেন। আরেকটু গভীরে ঢুকলে তাকেও আরমানের সঙ্গী হতে হতো।

তিনি বললেন, ‘সেদিন আমরা মিছিল করে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ গৌরাঙ্গবাজারের দিকে পুলিশের লাঠিচার্জের কথা শুনতে পেলাম। আমি আর আরমান প্রায় সমবয়সী। আরমান বলল, ইসমাঈল হুযূরকে পুলিশ মারধর করছে । চল, দেইখা আসি।

আমরা যখন ব্যাপারটা দেখতে জামিয়া ইমদাদিয়া পেরিয়ে জনতা ব্যাংকের সামনে এলাম, ঠিক তখনই গোলাগুলি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরমান গুলিবিদ্ধ হল, আমিও পড়ে গেলাম মাটিতে। তারপর আর কিছুই জানি না। সুস্থ হওয়ার পর জানতে পারি আরমান আর নেই। না ফেরার দেশে চলে গেছে সে। আল্লাহর দয়ায় আমি এখনো বেঁচে আছি।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'সকালে সুস্থ মানুষ মিছিলে গেল, দুপুরে ফিরে আসল লাশ হয়ে।'

পরদিন তথা ১ জুলাই পুরো কিশোরগঞ্জ জুড়ে মিছিল হয় তার লাশ নিয়ে। মিছিল শেষে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়৷ পুরো মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। পুরো দেশের মানুষ এসেছিল তার জানাযায়।

জানাযায় ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার অনেক নেতাকর্মীরা এসেছিলেন। এসেছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ., মুফতী আমিনী রহ., কটিয়াদীর মেজর আখতারুজ্জামান রঞ্জনসহ অনেক গণমান্য রাজনৈতিক নেতা। তারা জানাযাপূর্বক আলোচনায় আরমান হত্যাকারীর ফাঁসির দাবি করেন। কিন্তু আরমানের উপর গুলিবর্ষণকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে শুধু চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। আর কিছু হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
সরকার এ বিষয়ে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি এবং সেই পুলিশের আর কোনো শাস্তি হয়েছিলো কি-না তাও জানা যায়নি আজ পর্যন্ত।

জানাজার নামাজ পড়িয়েছিলেন জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল আল্লামা আজহার আলি আনোয়ার শাহ রহ.

শহিদ আরমানের লাশ রক্ত মাখা শরীরে-ই দাফন করা হয়েছিল, লাশ গোসল দেয়া হয়নি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা নবীর প্রেমে জীবন উৎসর্গ করা শহিদ আরমানকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করে নিন। আমীন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ