আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: প্রশ্ন: সম্মানিত মুফতি সাহেব! ইদানিং আমাদের দেশে যোগ ব্যায়াম নামে শরীর চর্চার একটি পদ্ধতিকে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
হিন্দুদের উপাসনার মত আসন গ্রহণ করত: মেন্টালিটি মোডিভেশনের মাধ্যমে এ যোগ ব্যায়াম করা হয়। অনেকে বলেন, এটা হিন্দুদের বিশেষ ধর্মাচার তাই এ ব্যায়াম করা মুসলমানদের জন্য হারাম। তাদের এ কথা কি সঠিক? যদি সঠিক হয় তাহলে দলিলসহ বিস্তারিত জানতে চাই। কোন মুসলমান কেবল শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে এ ব্যায়াম করতে পারবে কি-না? দয়া করে জানাবেন।
উত্তর: ‘যোগ’ সংস্কৃত শব্দ। উর্দূতে বলা হয় يوگا (ইওগা) আর ইংরেজিতে ণঙএঅ। বাংলায় ‘যোগ’ আর এ যোগ থেকেই যোগ ব্যায়াম। উর্দূ-বাংলা অভিধান ফরহাঙ্গে কাসেমিতে আছে-يوگ‘ সঃ নাঃ পুঃ; ধর্মাচার, ধর্মকর্ম’। (ফরহাঙ্গে কাসেমী, পৃ. ৯৯১)। বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে ‘যোগ হিন্দু দর্শন মতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন; তপস্যা; ধ্যান; মায়া বি হিন্দু শাস্ত্রোক্ত দুর্গা দেবী, মহামায়া; ভগবানের লীলা বিস্তারিনী শক্তি; আদ্যাশক্তি।
সাধন সাধনা বি হিন্দু শাস্ত্রোক্ত যোগাভ্যাস; যম, নিয়ম, প্রাণায়ামাদি অভ্যাস। যোগাসন বি যোগ সাধনায় উপবেশন বা উপবেশনের পদ্ধতি।’ (ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ১০১৩)।
আরেকটু পরিস্কার করে বললে, যোগ হচ্ছে বেদ ভিত্তিক ভারতীয় ছয়টি দর্শনের একটি। যোগ দর্শনের প্রবর্তক পতঞ্জলি (খ্রি. পূ. ২য় শতক) এ জন্য এর অপর নাম ‘পাতঞ্জল দর্শন’।
পতঞ্জলির যোগ শাস্ত্রের চারটি পাদ। প্রথম পাদে আলোচিত হয়েছে যোগের লক্ষণ ও সমাধি। দ্বিতীয় পাদে সমাধি লাভের পূর্বে অনুসরণীয় ব্যবহারিক যোগ এবং যম, নিয়ম আসন ইত্যাদি যোগাঙ্গের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় পাদে ধারনা, ধ্যান, সমাধি এসবের ফল এবং বিভ‚তি বা ঐশ্বর্য আলাচিত হয়েছে। চতুর্থ পাদে পাঁচ প্রকার সিদ্ধি ও পরা প্রয়োজন কৈবল্যের আলোচনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে দেখুন, বাংলাপিডিয়া, পৃ. ৯/৪৫৭।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়াতে আরো আছেÑ যোগ মতে পরমেশ্বর ক্লেশ, কর্ম, কর্মফল, সংস্কার ইত্যাদি থেকে মুক্ত পুরুষ বিশেষ। তিনি লীলাবশে বহু দেহ ধারণ করে লৌকিক ও বৈদিক সম্প্রদায় প্রবর্তন করেন এবং দুঃখদগ্ধ সংসারী জীবগণের প্রতি কৃপা করেন। (বাংলাপিডিয়া, পৃ. ৯/৪৫৭)।
আর এ যোগের আটটি অঙ্গের (তথা যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি) তৃতীয় অঙ্গ আসনই হচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত এ যোগ ব্যায়াম। হিন্দুদের মতে দেহকে স্থির ও সুখকর রাখার উপায় হচ্ছে আসন। এবং এ আসন কেবল হিন্দু ধর্মের নির্দিষ্ট নিয়মেই হয়ে থাকে যেমন ইসলাম ধর্মে নামায।
তাই যোগ ব্যায়াম মূলত: শরীর চর্চার পদ্ধতি নয় বরং হিন্দু ধর্মের পুজার একাটি দৌহিক পদ্ধতি। হিন্দুধর্ম মতে, পরমাত্মা পর্যন্ত পৌঁছতে হিন্দুদের বিশেষ ধর্মাচার। যেমন হিন্দু পুরহিত লোকনাথ বহ্মচারী (ভারতের ২৪ পরগনা জেলার বারাসাতে ১৭৩১ সালে জন্ম ও ১৮৯০ সালে মৃত্যু) এ ধর্মাচারে দীক্ষা নিয়ে যোগ সাধনা দ্বারা যোগী সন্ন্যাসী হয়েছেন। তার মতে, আতেœাপলব্ধি ভক্তি ও একনিষ্ঠ যোগই মুক্তির (সিদ্ধির) একমাত্র পথ। (বাংলাপিডিয়া, পৃ. ৯/২১৩)।
তাই বলা যায়, যোগ ব্যায়াম হিন্দুদের একটি ইবাদত। হ্যাঁ, যদিও এর দ্বারা শরীর চর্চা হয়ে থাকে কিন্তু শরীর চর্চা এখানে মুখ্য নয়। তাই হিন্দু ধর্মে যোগ ব্যায়াম আতœশুদ্ধি, মুক্তি লাভ ও একনিষ্ঠ ইবাদতের উদ্দেশ্যেই করতে হবে। কেউ যদি শরীর চর্চা তথা দুনিয়াবী লাভের উদ্দেশ্যে করে তাহলে লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই হবে।
এ ব্যাপারে গান্ধিজী বলেন, শারীরিক ব্যায়ামের মধ্যে এ ব্যায়াম খুবই ভাল। শারীরিক ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে এ ব্যায়াম নিয়মিত করা ভাল তবে যদি দুনিয়াবী সফলতার উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে আমি মনে করি, উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। (গীতা গিয়ান, পৃ. ৩৬ ৬ষ্ঠ অধ্যায়, চান্দ আহাম আসরী মাসায়েলের সূত্রে পৃ. ২/৯৬)।
তাই যোগ ব্যায়াম করা শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে হোক বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে হোক বিধর্মীদের ধর্মীয় ইবাদত হওয়ায় তা সর্বাবস্থায় মুসলমানদের জন্য হারাম। এ ধরনের ব্যায়াম শরীয়তে জায়েয নেই।
অন্য ধর্মের ইবাদতের সাদৃশ্য গ্রহণ করা, ইবাদতে সৌহার্দ্য প্রকাশ করা, ঘনিষ্ঠ হওয়া সবই নাজায়েয। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, ‘আর পাপিষ্ঠদের প্রতি ঝুঁকবে না। নতুবা তোমাদেরকেও আগুনে ধরবে’। সুরা হুদ: ১১৩।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা কুরতুবি রহ. বলেন, ‘বিধর্মীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা, তাদের সংস্পর্শে থাকা, সৌহার্দ্য প্রকাশ করা, ঘনিষ্ঠ হওয়া, তাদের প্রতি ঝুঁকার কারণে আগুন তোমাদেরকে জ্বালাবে’। (আল জামে লি আহকামিল কুরআন ৫/৭৫, দারুল ফিকির)।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন আমল বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ দেখলে সাহাবায়ে কেরাম রা. কে নিষেধ করতেন। একবার এক বাচ্চার মাথায় ইহুদিদের মত চুলের ঝুটি দেখে বলেন, ‘চুলের ঝুটি দুটি ছেঁটে ফেল অথবা কেটে ফেল কেননা তা ইহুদিদের সাদৃশ্য’। (আবু দাউদ, হা. নং. ৪১৯৮)।
অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখে সে তাদেরই অর্ন্তভুক্ত’। (আবু দাউদ, হা. নং. ৪০৩১)।
প্রকাশ থাকে যে, ইসলাম শরীর চর্চা তথা ব্যায়ামের বিরোধী নয় বরং ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যায়াম জায়েয ও উত্তম। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দূর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে প্রিয় ও উত্তম’। তবে এ ব্যায়াম অবশ্যই ইসলামের মূলনীতি ও শরীয়ত অনুযায়ী হতে হবে।
শরীয়ত বিরোধী হতে পারবেনা। ব্যায়ামের নাম দিয়ে অমুসলিমদের ইবাদত উপাসনা কিংবা তাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন অনুশীলন মুসলমানের জন্য জায়েয হতে পারেনা। মুসলমান তাদের শরীয়ত নির্দেশিত উপায়ে বিভিন্ন রকম ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করতে পারবে।
-এটি