এফাজ মোবারক।।
পৃথিবী কখনোই একই ধারাবাহিকতায় চলমান ছিলো না। যুগে যুগে শতাব্দীতে তার উত্থান পতন ঘটেছে, কখনো উন্নতি কখনো অবনতি দেখা দিয়েছে। মানুষের এই অবনতি যখন একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে তখন আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর মানুষের দিকনির্দেশনার জন্য মহামানবদের আগমন ঘটিয়েছেন।
৫৭০ খৃষ্টাব্দে ধু-ধু মরু আরবের বুকে ফুলের মতো পবিত্র একজন বালক মহামানব হয়ে আসেন। তার আগমনী বার্তাই যেন বলে দেয় পৃথিবী নতুন উদ্যমে নবরূপে সজ্জিত হয়ে উঠবে। তিনি আমাদের নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
শিশু-কিশোর বয়স থেকেই তার আচার-আচরণে ভিন্নতা দেখা দেয়। আর যৌবনে যেন সব পূর্ণতা তার মধ্যে আসতে থাকে। তিনি তৎকালীন আরবের অন্যায় পাপাচার বেহায়া উশৃংখল আর মূর্তিপূজার জীবন দেখে ভাবনায় পড়ে যান। কীভাবে তাদের সৎ নৈতিক ও মানবিক মানুষে পরিনত করা যায়; সে চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতেন। তাদের সাথে থেকেও তাদের কোন কিছুই তিনি গ্রহণ করতেন না বরং সেখানে উত্তম ব্যবহার আচরণ ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতেন।
এভাবে যখন তিনি ৪০বছর বয়সে পুরো আরবের একজন শ্রেষ্ঠ যুবকে পরিনত হলেন এবং নবুওয়তের সময় এলো, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী বানিয়ে পুরো বিশ্বের সামনে পেশ করলেন।
শুরু হলো তার আরেক নতুন জীবন। এতদিন যারা তাকে বিশ্বাসী বলত আজকে তারা তাকে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। তারা এক আল্লাহর দাওয়াত কবুল করতে পারছে না। তাদের বাপ-দাদার ধর্ম মূর্তিপূজা ছাড়তে পারছে না। তাকে মিথ্যাবাদী যাদুকর পাগল বলে আখ্যায়িত করছে। যেখানে আল্লাহর দাওয়াত দিতে যাচ্ছেন সেখানেই শিকার হচ্ছেন—মানুষের অবিশ্বাস গালাগালি মারধর আর নির্যাতনের। কখনো তাকে, তার অনুসারীদেরকে নির্যাতন করে তার আঘাতকে প্রবল করে তুলেছে।
তিনি বরাবরই সবার সাথে উত্তম আচরণ করে যেতেন। কেউ অসুস্থ হলে তার সেবায় এগিয়ে যেতেন, কারো কাজে সাহায্যের প্রয়োজন হলে তিনি সহযোগিতা করতেন, কেউ দুঃখ কষ্ট অনাহারে দিনযাপন করলে তাকে সাধ্যমত দান করতেন, মুসাফিরদেরকে ডেকে এনে খাবার খাওয়াতেন। আত্মীয়-স্বজন, শত্রু-মিত্র কেউ তার ভালোবাসা যত্ন সেবা আর উত্তম কথা আচার-ব্যবহার থেকে বাদ যেত না। তিনি সবার, সব মানুষের, তিনি শত্রুর জন্য যেমন, নিজের অনুসারীদের জন্য তেমন মানুষ। মানুষ হিসেবে তার কাছে কোন ভেদাভেদ ছিলো না—কে গরীর কে ধনী, কে সুন্দর কে কালো এসব কোন বাছ-বিচার তার স্বভাব চরিত্রে কোনদিনও ছিলো না।
তার শত্রুরাও তাকে গোপনে ভালোবাসত বিশ্বাস করতো শ্রদ্ধা করতো, দিবালোকের মতো জানতো মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, শেষ নবী। একজন মানুষের মধ্য সব ভালো গুণের সমাহার একমাত্র নবী রাসূলগনের মধ্যেই থাকতে পারে। তারাই কামেল মানুষ। নারী পুরুষ সবার জন্য তিনি নবী। তার উপরেই নাজিল হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন। তিনি ছিলেন এই কোরআনের বাস্তব নমুনা।
আর তার সাহাবীরা ছিলেন তার একান্ত আনুগত্য। এমন আনুগত্য পৃথিবীর আর কোন নবী রাসূল বা অন্য কোন ব্যক্তির সহচারীদের মধ্যে দেখা যায় নি। কি অসম্ভব ভালোবাসা ছিলো সাহাবিদের মনে—রাসূল যখন যা বলেছেন তখন তারা তাই মেনেছেন, বিশ্বাস করেছেন, নিজেদের জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহন করেছেন। তার কথায় জীবন দিয়েছেন, তার ভালোবাসায় শত শত মাইল সফর করেছেন। এবং কেয়ামত পর্যন্ত আসা সকল মানুষের জন্য তারা আদর্শ হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে নবীকে ভালোবাসতে হয়, তার কথা মানতে হয়, তার মতো জীবন পরিচালনা করতে হয়।
কি এমন গুণ ছিলো না মুহাম্মদ সা. এর মধ্যে—তার নবুওয়তে ২৩বছরের জীবনে তিনি মানুষকে পরকালমুখী করার চেষ্টা করেছেন, বলেছেন, এই নশ্বর জীবনে মানুষ মুসাফির মাত্র, একজন মুসাফিরের গন্তব্য যেমন নিজ বাড়ি আর মাঝখানের জীবনটা হলো তার চলার পথ—ঠিক তেমনি মানুষ গন্তব্য হলো জান্নাত আর দুনিয়া হলো তার সফরকালীন সময়। এভাবে তিনি মানুষদেরকে পরকালের দিকে আহ্বান করেছেন। দুনিয়াতে বেঁচে থাকার জন্য যাবতীয় জীবন বিধানও বলে দিয়েছেন। কখন কি করতে হবে, কি করতে হবে না, কিভাবে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হওয়া যায় তাই বলে গিয়েছেন আজীবন।
তার পুরো জীবনে মানুষের পার্থিব সবকিছুর সমাধান বলে দিয়েছেন, কখনো নিজে করে দেখিয়েছেন বা কারো কাজে সমর্থন করেছেন৷
সাধারণ মানুষ হিসেবে তিনি যেমন অসাধারণ ব্যক্তিত্য ছিলেন তেমনি যুদ্ধ পরিচালনাতেও ছিলেন সর্বোত্তম সমরনায়ক। নির্ভীক সাহসী বীর হিসেবেও তিনি ছিলেন সবার উর্ধ্বে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে গৃহ কর্তৃত্বেও ছিলেন আদর্শ নমুনা।
তার পুরো জীবনটাই ছিলো আত্মত্যগে ভরপুর। আল্লাহ আদেশ পালনার্থে ও তার দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তা সর্বকালের সব নবী রাসূলগনের কষ্টকে ছাড়িয়ে যায়। দ্বীনের জন্য নিজ চাচাকে হারিয়েছেন, প্রিয় সাহাবীদের হারিয়েছে, কন্যকে হারিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, দ্বীনের জন্য আমাকে যে পরিমান কষ্ট দেওয়া হয়েছে তা আর কোন রাসূল নবীকে দেওয়া হয়নি। এমন চরম সত্যবাদী মানুষের কথা থেকেই বুঝা যায় ইসলামকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠান করতে তার আত্মত্যাগ কি পরিমাণ ছিলো!
তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী যা করতেন সব প্রকাশ্যে করতেন। তার গোপন বলতে কিছুই ছিলো না। তার উদারতা মহানুভবতা সাক্ষী হয়েছে তার শত্রুরাই। মক্কা বিজয়ের সময় তার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা পৃথিবীর আর কারো মধ্যে দেখা যায় নি। এতদিন যারা তাকে সময়ে সময়ে সুযোগে সুযোগে কষ্ট দিয়েছে, হত্যার মত নিষ্ঠুর পরিকল্পনা করেছে, তার আত্মীয় স্বজন ও সাহাবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্য করেছে আজ তাদেরকেই তিনি নিরাপত্তা দিলেন। ঘোষণা দিলেন মক্কা মদিনাকে নিরাপদ শহর হিশেবে।
তখনকার সময়ের বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদেরকেও তিনি তার ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তাকে নবী হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বান করলেন।
তিনি তার পুরো জীবনে যা কিছু করেছেন সবই ইসলামের জন্য করেছেন, নিজের জন্য তিনি একটা কাপড়ও পড়েন নি, একটা দানাও মুখে নেন নি—আল্লাহর আনুগত্য বান্দা হিসেবে সবসময় নিজেকে পরিচয় দিতেন৷ দিনে রাতে তার এবাদত ও শুকরিয়া আদায় করতেন। ইবাদত করতে করতে করতে কখনো তার পাদ্বয় ফুলে যেত, তবুও তিনি ক্ষ্যন্ত হতেন না। একজন শুকরগুজার বান্দা হয়ে থাকতেন। কখনো কেউ তাকে সমান্য উপকার করলে তিনি তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করতেন না। সত্য মিথ্যা হক বাতিলের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতেন।
কেউ তাকে বড় হিসেবে দেখুক, রাজার মতো সম্মান করুক—এমন কোন কিছুর আকাঙ্খা কখনোই করতেন না। সবসময়ই বলতেন, আনা আবদুহু ও রসুলুহু—আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। কি সাধারণ জীবন ছিলো তার—রাজ্য শাষণ করেও খেজুরের পাটিতে ঘুমাতেন, তার পিঠে পাটির ডোরাকাটা দাগ বসে যেতো। দুনিয়ার জৌলুশ জীবন তার কখনোই প্রত্যশা ছিলো না আর কেউ তা গ্রহন করতে দেখলে বরং রাগান্বিত হয়ে যেতেন।
শারীরিক দুর্বলতা আর জ্বর নিয়ে তার দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ৬৩২ সালের জুন মাসে ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার তার পৃথিবীর শেষ দিন ছিলো। মৃত্যু সময় তার নিজস্ব সম্পত্তি টাকা পয়সা বলতে কিছুই ছিলো না। নবীরা দুনিয়াতে ধন সম্পদ রেখে যান না তারা রেখে যান তাদের আদর্শ। আর আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. রেখে গেছেন পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান ইসলাম। যা সর্বাকালের একমাত্র মনোনীত ধর্ম। তা কখনোই সেকেলে নয় বরং চিরন্তন, সার্বজনীন। কোন সাম্প্রদায়িকতা ইসলামে নেই, নেই কোন জাতীয়তাবাদ। এখানে সব মানুষ সমান, সবাই আল্লাহর বান্দা আর মুহাম্মদ সা. তার একমাত্র সর্বশেষ রাসূল।
-এএ