।।এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ।।
'মুহাম্মদ'। নিছক প্রিয় একটি নাম নয়, বরং একটি আদর্শ। একটি চেতনা। একটি বিপ্লব। যে নাম প্রতিটি মুমিনের কাছে খুবই প্রিয় ও পরিচিত। নামটির সাথে আলিঙ্গন করে আছে হৃদয়ের প্রতিক্ষণ। যে নামটি জপিলে কণ্ঠে সুধা অনুভব হয়। যার জীবনবৃত্তান্ত শুনলে পশম শিউরে উঠে। যিনি উম্মতের দরদী নবী ও জাতির রাহবার। তিনি দো-জাহানের সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
যখন কুফর ও জাহিলিয়াতের অন্ধকারে আচ্ছন্ন পৃথিবী। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নেই কোন আলোর দিশা। অন্যায় অত্যাচারে অস্থির সমাজ। মানুষের এমন ক্লান্তিলগ্নে বসুধাকে আলোকিত করার লক্ষ্যে ; সমাজ অবক্ষয়ের চরম বিপর্যয় রোধ করার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ সা.কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন।
বিশ্বনবী এর আগমন কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না; বরং সৃষ্টির সূচনা থেকেই মহাজগৎ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় ছিল।যেমনভাবে এ সুভাগমণের বার্তা তাওরাত,যাবুর ও ইঞ্জিলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে রয়েছে। তাওরাতে সুস্পষ্ট রাসুলুল্লাহের আগমণের বার্তা—‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক ও ইলাহ আমার মতো একজন নবী প্রেরণ করবেন ইব্রাহিম (আ.) এর বংশধর তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকে।’ (আল মারজাউ ফি সিরাতুন-নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৬৬)
ইঞ্জিলে সুভাগমণের বার্তা — ‘তোমাদের বলার আমার আরো অনেক কথা আছে। কিন্তু তোমরা এখন তা সহ্য করতে পারবে না। যখন সে সত্য-আত্মা আসবেন, তখন তিনি তোমাদের সত্যের সন্ধান দেবেন। তিনি নিজ থেকে কিছু বলবেন না। যা যা শুনবেন তাই বলবেন এবং ভবিষ্যতের ঘটনাও জানাবেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৮)
রাসুল সা. এর আবির্ভাবে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সমগ্র জগতে নূরের আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। কিন্তু তাঁর মনে ছিল বিষন্ন। কেননা তাঁর জন্মের দুই মাস পূর্বেই সৌভাগ্যবান পিতা হারিয়ে যায়। আট বছর বয়সে হারান দাদাকে। এরপর এতিম হয়ে চাচা আবু তালেবের কাছে লালিত পালিত হতে থাকেন। মা-বাবা থেকে ছোটবেলায় শিক্ষা লাভের সুযোগ না হলেও চাচার সাথে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন। অনন্য পাণ্ডিত্য হাসিল করেন। অতঃপর ২৩ বছর বয়সে খোদা তায়ালা কর্তৃক নবুয়ত প্রাপ্ত হোন। মাত্র ২৩ বছরের স্বল্পকালীন নবুয়তি জীবনে তিনি মানব জাতিকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এমন উচ্চশিখরে উন্নীত করেছিলেন যে, বিশ্বের ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন।
আরম্ভ করলেন দাওয়াতের কাজ। দ্বীনি দাওয়াতের জন্য নবী-রাসূলকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। রক্ত ও শহীদের বিনিময়ে পরিবেশ তৈরি করে নিতে হয়েছে। প্রিয়নবী সা. ও এর বিপরীত নন। নবুয়ত প্রাপ্তির পর মক্কার জমিন তাঁর জন্য ছিল কণ্টকাকীর্ণ। তাঁর প্রতি স্বজাতিদের ঘৃণা, অবজ্ঞা ও শাস্তির মাত্রা ছিল কল্পনাতীত। দিন দিন বাড়াতে থাকে অমানবিক নির্যাতন । বিরোধিতার মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে।
খুব কমসংখ্যকই ইসলাম গ্রহণ করল। তবে সিংহভাগ মানুষই তার উপর নির্যাতন চালিয়ে গেল । এ কঠিন পরিস্থিতে সহযোগিতা ও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্ত সেখানেও তিনি উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। এমনকি তায়েফবাসি রাসূলকে পাথর মারার মত জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। ফলে তিনি আবার মক্কায় ফিরে এলেন। এভাবে এক কঠিনতম সময় এলো—কুরাইশরা মুহাম্মদকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল।
তারা মুহাম্মদকে শেষ করে ফেলবে।ইসলামকে চিরতরে নিভিয়ে দিবে। কিন্তু এ পরিকল্পনায় তারা ব্যর্থ হয়। অতঃপর রাসূল সা. রবের নির্দেশে মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। হিজরত করলেন জন্মভূমি ছেড়ে সূদুর মদিনা। মদিনাতে গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন। মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এভাবেই শুরু হলো সর্বত্র ইসলামের প্রচার। শুনা যাচ্ছে জয় জয় ধ্বনি। বিজয় হলো হলো মক্কা। মক্কা-মদিনা মিলেমিশে একাকার। সকলেই এলো ইসলামের ছায়াতলে। মনে নিলো রাসুলকে। আইডল হিসেবে অনুসরণ করল সবার সেরা শ্রেষ্ঠ মানবকে।যিনি বিশ্বের বুকে দি গ্রেটেস্ট।
এই পার্থিব জীবনে হাজার রকমের লাইফ ইস্টাইল ছড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে অসংখ্য জীবনরূপ। ছিটিয়ে আছে মানুষের জীবনধারার উন্মুক্ত নমুনা। বিশাল এই সমতল শিবিরে বড় বড় দেশ বিজেতা ছিল। যারা তাদের তরবারির আঘাতে ইতিহাসের পাতা গড়ে তুলেছেন। নির্মাণ করেছেন ইতিবৃত্তের তাজদিদ অধ্যায়। কিন্তু তারা সফলতা ও পথ পদর্শনের জন্য কোন পথ রেখে গিয়েছে কি? না, যায়নি। ঠিক এরকমভাবেই এই পৃথিবীতে বড় বড় জ্ঞানী জন্মেছেন।
কিন্তু তারা কী দেখিয়ে গিয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আমাদের সফলতার রাজপথ ? না, তাও রেখে যাইনি। তবে এবার একজনের কথা বলবো। তিনি আমাদের মতো মাটির মানুষ। তবে তাঁর জীবনধারা আমাদের মতো নয়। জীবনচরিত সাধারণ কিছু নয়। সবার থেকে ভিন্ন। সবার থেকে শ্রেষ্ট। যিনি আমাদের আইডল হওয়ার উপযুক্ত। যার পথেই আছে সৌভাগ্য ও সফলতা। যার সম্পর্কে স্বয়ং আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, “নিশ্চয়ই আপনি অনুপম চরিত্রের অধিকারী।” (সুরা ক্বলাম—৪)
নবী সা. এর জীবনযাপন ছিল খুবই ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর আদর্শ ছিল পবিত্র। তাঁর পথচলা বৈরাগ্যবাদের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। তিনি বলতেন—"প্রতিটি মানুষ আল্লাহর বিধান মোতাবেক ঐকান্তিকতার সাথে ইবাদত-বন্দেগি করবে। এটাই আমার সুন্নাত।" (সুনানে আবু দাউদ-১/৩৪)।
সর্বপরি সচেতন ও ন্যায় নিষ্ঠাবান সফল মানব মুহাম্মদ সা.। তাকে অনুসরণ করাই আমাদের সফলতা। তাকে ভালোবেসেই সুপথ হাসিল করা সম্ভব। তাঁর দেখানো পথেই আছে সুখময় জান্নাত। তাই তাঁর পথের নাম রাজপথ। তার আদর্শই শ্রেষ্ট আদর্শ। তাঁর পুরো জীবনই আমাদের মাইলফলক। সোনার অক্ষরে খচিত করার মতো তাঁর ইতিবৃত্ত।
সফল জীবনের নিশ্চয়তা পেতে হলে তাঁর আদর্শের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। কেননা তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তাঁর প্রতিটি কাজ আমাদের জন্য শিক্ষা আর এই শিক্ষা আমাদের সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ পাক আমাদেরকে রাসুলের আদর্শে জীবন বাস্তবায়ন করার তৈফিক দান করুন।আমিন।
-কেএল