মুহাম্মাদ আবু আখতার।।
সমাজের সব মানুষের মন-মানসিকতা সমান নয়। একই বিষয়কে বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। তাই মতভেদ হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে মতভেদ নেই। ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি জীবনের অন্যান্য সব ক্ষেত্রের ন্যায় ধর্মীয় ক্ষেত্রেও মতভেদ বিদ্যমান।
কিন্তু আমাদের সমাজের লোকেরা অন্য সব ক্ষেত্রে মতভেদকে স্বাভাবিক মনে করলেও ধর্মীয় ক্ষেত্রে আলেমদের মতভেদকে বাঁকা চোখে দেখে থাকে। আলেমদের মধ্যে মতভেদ দেখলেই তাদের সম্পর্কে অত্যন্ত বাজে মন্তব্য করা হয়।
আলেমদের মতভেদকে মুসলমানদের দুরবস্থার জন্য দায়ী মনে করা হয়। এক আলেমের অনুসারীরা বিপরীত পক্ষের আলেমদের ব্যাপারে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে কথা বলে।
আলেমগণের পারস্পরিক মতভেদ দেখে সাধারণ মুসলমানদের অনেকে তাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে নিজেদের কুপ্রবৃত্তির চাহিদামাফিক চলতে থাকে৷ আবার অনেকে এসব মতভেদ দেখে আলেমগণের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অশালীন কথাবার্তা বলতে থাকে৷ এমনকি অনেকে তো মতভেদের কারণে গোটা আলেমসমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলে এবং ইসলাম সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। আমাদের সমাজের বিরাট সংখ্যক মুসলমান শুধুমাত্র এ কারণেই আলেমদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকে। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
মতভেদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে আলেমদের মতভেদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা বিরাজ করছে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই মনে করে মতভেদ মানেই খারাপ।
অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে ইজতেহাদী মতভেদ নিন্দনীয় নয়। আসলে ইসলামের মৌলিক যেসব বিষয় কুরআন সুন্নাহতে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এসব বিষয়ে হকপন্থী আলেমগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই৷ এসব বিষয়ে তারা সকলে একমত৷ এক্ষেত্রে আলেমদের মতভেদের কোন সুযোগও নেই।
এসব বিষয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে সে আলেম হিসেবে গণ্য হওয়া তো দূরের কথা মুসলমান হিসেবেও গণ্য হতে পারে না৷ কোরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট মৌলিক কোন বিধানের বিপরীত মত কেউ পোষণ করলে সে ইসলামের গন্ডী থেকে বের হয়ে যাবে। যেমন ইসলামের পাঁচটি মুলভিত্তি ঈমান, সালাত, যাকাত, সাওম, হজ। এসব বিষয় কোরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলীলের আলোকে প্রমাণিত। তাই এসব ফরজ হওয়ার ব্যাপারে কোন আলেমের দ্বিমত নেই।
কেউ যদি এর কোন একটিকেও অস্বীকার করে তাহলে সে ইসলামের গণ্ডি হতে বের হয়ে কাফির হিসেবে গণ্য হবে। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা) যাকাত অস্বীকারকারীদেরকে ধর্মত্যাগী মনে করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তারা যাকাত ব্যতীত ইসলামের অন্য কোন বিধান অস্বীকার করে নি। শুধুমাত্র যাকাতকে অস্বীকার করার কারণে তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ইসলামের শাখাগত যেসব বিষয় কোরআন সুন্নাহতে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না, বরং ইজতিহাদের মাধ্যমে কোরআন সুন্নাহর আলোকে কিয়াস করে বের করতে হয় এসব বিষয়েই সাধারণত মতভেদ দেখা যায়৷ এ ধরণের মতভেদকে ইজতিহাদী মতভেদ বলা হয়।
আর ইজতিহাদী মতভেদ ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দণীয় নয়৷ ইজতিহাদের জন্য কুরআন সুন্নাহ বিষয়ে বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করা জরুরী৷ সাধারণ আলেমদের জন্য ইজতিহাদ বৈধ নয়৷ যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদগণ ইজতিহাদে ভুল করলেও সওয়াব পাবে৷ হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে এ কথা বলতে শুনেছেন, "কোন বিজ্ঞ আলেম ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য আছে দু’টি পুরস্কার।
আর কোন বিজ্ঞ আলেম ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার।" (সহিহ বুখারীঃ ৭৩৫২) যেসব বিষয়ে কুরআন সুন্নাহতে সরাসরি সুস্পষ্ট কোন বিধান পাওয়া যায় না অথবা বাহ্যত বিপরীতমুখী বিধান পাওয়া যায় মুজতাহিদ আলেমগণ সেসব বিষয়ের সমাধান ও সমন্বয় কোরআন সুন্নাহর মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদের মাধ্যমে করেছেন।
যেমন, নামাজে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য তাকবীরের সময় হাত উত্তোলন করা এবং না করা, তাকবীরে তাহরীমার পর বুকের উপর হাত বাঁধা ও নাভীর নিচে হাত বাঁধা, ইমামের পেছনে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া এবং না পড়া, সুরা ফাতিহার পর আমিন আস্তে পড়া এবং জোরে পড়া ইত্যাদি বিষয়ে ইজতেহাদী মতভেদ রয়েছে। উভয় পক্ষের মুজতাহিদগন তাদের মতের পক্ষে দলীল দিয়েছেন। সুতরাং যেকোন মত অনুযায়ী আমল করা যেতে পারে।
মুজতাহিদগণের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুধাবনশক্তি যেহেতু এক ছিল না তাই এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। আর এ ধরণের মতভেদের বৈধতা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা) কর্তৃক অনুমোদিত।
এরূপ ইজতিহাদী মতভেদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগ হতেই চলে আসছে এবং তিনি এরূপ মতভেদের ব্যাপারে মৌনসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন৷ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, নবী (সা.) আহযাব যুদ্ধ হতে ফিরার পথে আমাদেরকে বললেন, বনু কুরাইজা এলাকায় পৌঁছার পূর্বে কেউ যেন আসর সালাত আদায় না করে।
কিন্তু অনেকের রাস্তাতেই আসরের সময় হয়ে গেল, তখন তাদের কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে না পৌঁছে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা সালাত আদায় করে নেব, আমাদের নিষেধ করার এ উদ্দেশ্য ছিল না (বরং উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি যাওয়া) নবী সা. এর নিকট এ কথা উল্লেখ করা হলে, তিনি তাঁদের কারো ব্যাপারে ভর্ৎসনা করেননি।"(সহিহ বুখারীঃ ৯৪৬)
সাহাবী, তাবেয়ী ও পুর্ববর্তী যুগের হক্কানী আলেমদের মধ্যেও ইসলামের অনেক শাখা বিষয় নিয়ে মতভেদ ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ইজতেহাদী মতভেদ থাকলেও তারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং ভালো ধারণা রাখতেন। মতভেদের কারণে একে অপরের প্রতি জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করতেন না।
মতভেদের কারণে তারা কেউ দলাদলি, মারামারি এবং ঝগড়া-ফাসাদ করেন নি। আর ইসলাম ইজতিহাদী মতভেদকে সমর্থন করলেও এসব নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও দলে দলে ভাগ হওয়া সমর্থন করে না।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, "নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ তা'আয়ালার নিকট সমর্পিত। অতঃপর তিনি বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে।" (সুরা আল-আনয়ামঃ১৫৯)
আর যারা শাখাগত বিষয়ে ইজতিহাদী মতভেদের কারণে আলেমগণকে দোষারোপ করে তারা কঠিন বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে৷ কেননা শাখাগত ইজতেহাদী মতভেদ ইসলামে অনুমোদিত। ইসলামে এটা দোষণীয় কোন বিষয় নয়। বরং ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।
আর মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐক্যমত সম্ভব হলেও শাখাগত বিষয়গুলোতে ঐক্যমত হওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়টি না বোঝার কারণে সাধারণ মুসলমানদের অনেকে বিভ্রান্তির স্বীকার হয়।
তাদের এ বিভ্রান্তির কারণে তারা আলেমগণের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে৷ আর সাধারণ মুসলমানদের আলেমগণের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থই হলো ইসলাম হতে তাদের দূরে সরে যাওয়া৷ আর এভাবেই তাদের বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ আলেমদের প্রতি কোন ধরণের বিরূপ মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না৷ মানুষ হিসেবে আলেমদের কিছু ভুলত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আর তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করাও দোষণীয় নয়।
কিন্তু আমাদের সমাজের অনেক কুলাঙ্গার তাদের সামান্য কোন ভুলত্রুটি পেলেই তাদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক ভাষায় কথা বলে। আর কিছু লোকদের দেখলে তো মনে হয় তারা সর্বদা আলেমদের দোষ অন্বেষণেই লেগে থাকে।
আলেমদের কোন দোষ পেলেই তারা সব জায়গায় প্রচার করে তাদের মানহানি করার অপচেষ্টা চালায়। আর কিছু লোক আছে একজন আলেমের দোষ পেলে ঢালাওভাবে সব আলেমকে দোষারোপ করে। ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ার ভুমিকাও এক্ষেত্রে খুবই আপত্তিজনক। আলেমদের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অপপ্রচার চালানো তাদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এসব অপপ্রচার প্রতিরোধে শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইসলামপ্রিয় মুসলমানদের কর্তব্য।
সুতরাং শাখাগত বিষয়ে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব। ইসলামের মৌলিক বিষয়সমুহে যেহেতু মতভেদের কোন সুযোগ নেই তাই এসবের উপর ভিত্তি করে আমাদের ঐক্যের জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য।
ইজতিহাদী মতভেদের আলোকেই প্রধানত চারটি মাজহাবের উদ্ভব হয়েছে৷ চার মাজহাবের ইমামগণ দীনের মৌলিক বিষয়ে সবাই একমত ছিলেন৷ তাদের পারস্পারিক মতভেদ ছিল শুধুমাত্র ইজতিহাদী মাসআলায়৷ আর ইজতিহাদী মাসআলায় সকল মতের পক্ষে দলীল থাকে৷ তবে কোন মতের দলীল একটু শক্তিশালী এবং কোন মতের দলীল একটু দুর্বল৷
কিন্তু কোন মাজহাবই দলীল ছাড়া নয়৷ চার মাজহাবের প্রত্যেকটি দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত৷ কেউ যেকোন একটি মাজহাব অনুসরণ করলে সে হকের উপর থাকবে ইনশাআল্লাহ। তাই জনসাধারণের কর্তব্য হলো কোন হকপন্থী আলেমের পরামর্শ অনুযায়ী ইজতিহাদী মাসআলায় যে কোন একটি মাজহাবের অনুসরণ করা৷
সর্বোপরি আলেমগণের মাজহাবগত মতভিন্নতার ব্যাপারে জনসাধারণের জন্য তাদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা ঠিক নয়৷ বরং জনসাধারণের উচিত আলেমসমাজের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের দিকনির্দেশনা মেনে চলা।
আর আলেমসমাজের উচিত শাখাগত মতভেদ সত্ত্বেও ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে বৃহত্তম ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করা এবং তাদের ব্যাপার জনসাধারণের ভুল ধারণাগুলো দূরীভুত করে সকলকে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়া।
শিক্ষার্থী, আলকোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
-এটি