আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ছাত্রদের জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ সম্পর্কে মুফতি তাকী উসমানীর বিশেষ পরামর্শ ও নির্দেশনা
[দারুল উলূম করাচির 1443-1444 হিজরি/2022-2023 ইংরেজি শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুফতি তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ- একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁর বক্তব্যে তিনটি মৌলিক বিষয়ে আলোচনা এসেছে। প্রথমত শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর বিস্তারিত বিবরণ দেয় হয়েছে-সলিমুদ্দিন মাহদি]
۞ ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন এবং এর সার্টিফিকেট সাধারণত জীবিকা অর্জনের বড় কোন উৎস নয়, তাহলে ধর্মীয় শিক্ষা কেন অর্জন করবো? এটি হাসিল করার লক্ষ্য কী?
۞ দারুল উলূমের অভ্যন্তরে স্মার্টফোন রাখা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। স্মার্টফোনকে আরবীতে الہاتف الذکي "আলহাতিফ আল-জাকি" অর্থাৎ “বুদ্ধিমান ফোন” বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটিকে الہاتف الغوي "আলহাতিফ আল-গাওয়ি" অর্থাৎ “বিপথগামী ফোন” বলা উচিত। এটা ছাত্রের জন্য দস্যু ও পথভ্রষ্টকারি বস্তুর হিসেবে কাজ করছে।
۞ ছাত্রদের জন্য যে কোন মিটিং-মিছিল, যে কোন ধরনের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সব ধরনের সমাবেশে যোগ দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বক্তব্যের মূল বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
(১) সহীহ বুখারীর প্রথম অধ্যায়ের প্রথম হাদীসটি হলঃ ”انما الاعمال بالنیات“ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সকল কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ ভালো নিয়তে কোনো কাজ করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং সওয়াবও পাবে। কিন্তু যদি খারাপ নিয়তে করা হয়, তাহলে একই কাজ, যদিও তা নিজের মধ্যে ভালো, কিন্তু খারাপ নিয়তের কারণে তা শুধু উপকারিতা হারায় না, বরং তা ক্ষতিকর সাব্যস্ত হয়।
(২) ইমাম বুখারী সত্যিই আমার-আপনার কাছে আবেদন করছেন যে, আজ আপনি আপনার পাঠ শুরু করছেন। তাই প্রথমে আপনার মনকে প্রশ্ন করুন এবং নিজেকে পরীক্ষা করুন যে, আপনি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে পড়াশোনা করতে এসেছেন?
(৩) ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে যদি জীবিকা অর্জন করাই তোমার লক্ষ্য হয়, তাহলে তুমি এখানে কেন এলে? দুনিয়া কামানোর অনেক উপায় আছে, সেগুলো গ্রহণ করতে! এখানে দুনিয়ার জাঁকজমক দৃশ্যত দেখা যায় না। এমন কিছু এখানে নেই। এখানকার সার্টিফিকেটের মূল্য এত বেশি নয় যে, তুমি সেখানে গিয়ে উচ্চ চাকরী পেতে পার। যদিও আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমতে এই সনদকে অন্যত্র গৃহীত করেছেন। কিন্তু তারপরও তা অর্থ উপার্জনের বড় উৎস নয়, তাহলে এখানে পড়া-লেখা করার উদ্দেশ্য কী?
(৪) ধর্মীয় শিক্ষার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে:
(ক) সাধারণত যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কেন এই শিক্ষা অর্জন করছেন? তখন কখনো কখনো মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় যে, দ্বীনের সেবার জন্য বা ধর্ম প্রচারের জন্য, দ্বীনি শিক্ষা প্রদানের জন্য। এটা মোটেও খারাপ কিছু নয়, তবে তার আগে একটা কথা আছে, যা সাধারণত আমরা ভুলে যাই। অর্থাৎ প্রথমে আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা এজন্য পড়া-লেখা করছি যে, যেন ধর্মের নিয়ম-কানুন জানতে পারি, সেগুলি নিজেরাই মেনে চলতে পারি এবং নিজেরা অনুসরণ করতে পারি। এটাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমি নিজে যদি খারাপ হই, আর অন্যকে ভালো কাজের দাওয়াত দিই, তাহলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যেমন আমার অন্তরে অহংকার-বড়ত্ত্ব ও ফেরাউনের প্রবৃত্তি আছে, আর আমি অন্যকে নম্রতার শিক্ষা দিই, আমি নিজে নামায কায়েম করি না এবং অন্যকে নামাযের কায়েম করার জন্য অনুরোধ করি; এমন শিক্ষা কখনো কোন কাজে আসবে না।
(খ) অতঃপর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, আমি দ্বীনের জ্ঞান অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব, যে কোনো ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সঙ্গে দ্বীনের খেদমত করব।
(৫) ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য কখনো যশ-খ্যাতি, পদ ও সম্পদের মোহ হতে পারে না।
বর্তমানে বড় ফিতনার বিষয় হলো, বিশেষ করে আমাদের ঘরনার লোকদের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনা ও পরীক্ষা হলো, আমাদের মধ্যে যশ-খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা, মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তার প্রত্যাশা দিনদিন বেড়েই চলছে। এখন আমারা আরও বেশি শ্রোতার প্রত্যাশা করি। আরও অধিক ভক্ত-অনুরক্তের তামান্না করে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে এটি একটি খুব খারাপ নিয়ত। নবী কারীম(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাকে ছাগলের পালের মধ্যে ক্ষুধার্ত নেকড়ে রেখে যাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। ঐ নেকড়ে ছাগলের পালের মধ্যে যে ক্ষতি সাধন করবে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করবে এই যশ-খ্যাতির মোহ।
মাঝে মাঝে মনে মনে চিন্তা আসে যে, আমি অমুক অমুক বিখ্যাত আলেমের মতো হবো, পৃথিবীতে যার খ্যাতি ধ্বনিত হয়েছে। আমিও সেরকম হবো। তখন আমারও খ্যাতি হবে, আমারও অনুসারী হবে। আমার জন্য মানুষ পাগল হয়ে যাবে। মানুষ আমাকেও ভালোবাসবে। যদি এই নিয়ত আসে, তাহলে এটাও দুনিয়ার নিয়ত। এটা পদের মোহের নিয়ত, এটা খারাপ নিয়ত।
সঠিক নিয়ত হলো, আল্লাহর দ্বীনকে অনুসরণ করার জন্য দ্বীনি ইলম অর্জন করা। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে কবুল করেন, তবে এটি তাঁর অনুগ্রহ। এটি তাঁর কাজ। এটি মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হবে, আমি যেন ঠিক হয়ে যায়। আমার মধ্যে যেন দ্বীন চলে আসে। অতঃপর যথাসম্ভব দ্বীনের সঠিক বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে সঠিক কাজ করার জন্য প্ররোচিত করা। তাতে আমার খ্যাতি হোক বা না হোক, মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জিত হোক বা না হোক। এ সব চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে ইলমে দ্বীন অর্জন করতে হবে।
আরে পৃথিবীর যশ-খ্যাতি দিয়ে কী করবে?! কেউ যদি আপনাকে ভালো মনে করে আর আপনার প্রশংসা করে, আবার কেউ যদি আপনাকে খারাপ মনে করে আর আপনার নিন্দা করে, তাতে আপনার কোন লাভ-ক্ষাতি নেই। এ সবকিছু বাতাসে উড়ে যাবে।যদি আজ আপনার উপর প্রশংসার পাহাড়ও বর্ষিত হয়, আর ওদিকে আপনাকে কবরে প্রহার করা হয় (আল্লাহ সকলকে রক্ষা করুন) তাহলে সেই প্রশংসার পাহাড়গুলি দিয়ে আপনি কী করবেন? এগুলো আপনার কোন কাজে আসবে?
অতএব, মানুষের উচিত হলো, সে নিজের জন্য করবে, কারো প্রশংসা অর্জন কিংবা নিন্দা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নয়। তাই আজ থেকে নিজের মনকে ধন-সম্পদের মোহ থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধ নিয়তে জ্ঞান অর্জনে মনোনিবেশ করুন।
(৮) ইমাম মালিকের একটি উক্তি আছে যেটি আমাদের সকলের সর্বদা মনে রাখা উচিত, তিনি বলেছেন:
”العلم لا یعطیک بعضہ حتی تعطیہ کلک“
ইলম আপনাকে তার কিছু অংশও দেবে না, যতক্ষণ না আপনি আপনার সমস্ত সত্তাকে তার কাছে সমর্পণ করেন।
এর মানে কী? এর অর্থ হলো, জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো অংশিদারত্ব থাকতে পারে না। সুতরাং আপনি ইলমে দ্বীনের পাশাপাশি দুনিয়াকেও উদ্দেশ্য বানাতে চান, তা হতে পারে না।
অতএব, আমি সকল ছাত্রদের অনুরোধ করছি, তোমরা যেহেতু দারুল উলূমে অধ্যয়ন করতে এসেছো, তাই তোমাদের সকল কর্মকাণ্ড একমাত্র জ্ঞান অন্বেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে।
(৯) বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং ফিতনার মধ্যে অন্যতম হল মোবাইলের ফিতনা। বিশেষ করে যে মোবাইলে শুধু টেলিফোনের কথা বলা হয় না বরং অনেকগুলি প্রোগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি রয়েছে অর্থাৎ স্মার্টফোন। এটি ছাত্রের জন্য ডাকাত ও ছাত্রের পথের দস্যু। কারণ ছাত্ররা যদি মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তার মন কখনই ইলম অর্জনে নিবদ্ধ হবে না।
আপনি যদি চান যে, আমি মোবাইল উপভোগ করবো এবং ছাত্রও হবো, এটা কখনো হতে পারে না। যে কোন একটিই হবে। হয়ত ছাত্র হবে অথবা মোবাইলের আনন্দ উপভোগ করবে। উভয়টি এক সাথে চালিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়।
বর্তমানে মোবাইলকে বলা হয় (Smart Mobile), যা আরবীতে অনুবাদ করা হয় الہاتف الذکي "আলহাতিফ আল-জাকি" অর্থাৎ “বুদ্ধিমান ফোন”, কিন্তু বাস্তবে একে الہاتف الغوي "আলহাতিফ আল-গাওয়ি" অর্থাৎ “বিপথগামী ফোন” বলা উচিত। কারণ, এটা ছাত্রের জন্য ডাকাত ও পথভ্রষ্টকারি বস্তুর হিসেবে কাজ করছে। সুতরাং যদি সত্যিকারের তালেবে ইলম হতো চান, তাহলে এই ধরনের মোবাইল পরিত্যাগ করতে হবে। মনে রাখবে, দারুল উলূমের অভ্যন্তরে স্মার্টফোন রাখা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
(১০) যে কোনো মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ এবং যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করা যাবে না। পড়াশুনাকালিন সময়ে আপনাকে একজন আন্তরিক ছাত্র হিসেবে থাকতে হবে।
যদি কারো এমন উদ্দেশ্য থাকে, তবে তাদের জন্য পথ খোলা আছে, ভাই। আমরা আপনাকে এখানে থাকতে বাধ্য করবো না। তবে আপনি যদি এখানে পড়তে চান, তাহলে আপনাকে এই বিধি-নিষেধগুলি মেনে চলতে হবে।
মুল : মুফতি তাকী উসমানী –হাফিজাহুল্লাহ।
অনুলিপন-মাওলানা মুহাম্মদ সালমান সকরোভী, শিক্ষক-দারুল উলূম করাচির, পাকিস্তান।
অনুবাদ- সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী, শিক্ষক-আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
-কেএল