এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ: বুদ্ধিবৃত্তি অতি শ্রেয় কর্ম। মহান রবের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। বুদ্ধিতেই মানুষ সম্মানিত-অপমানিত। মানুষ সৃষ্টির সেরা এ বিশেষ গুণের কারণেই। তাই বুদ্ধির প্রয়োগকে ইসলাম শুধু সিদ্ধই বলেনি বরং এর প্রতি মূল্যায়নও করেছে যথার্থ। বুদ্ধি দিয়েই জয় করা যায় বিশ্ব। বুদ্ধিতেই মানুষের সর্বোচ্চ পরিচয়। হাদীছে বর্ণিত ইসলাম শিক্ষাকে যেমন প্রতিটি নর-নারীর ওপর ফরজ করেছেন; তেমনি ফরজ করেছেন বুদ্ধিচর্চাকেও। একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে।শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে সুষ্ঠু ও আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার সন্ধান দিতে পারে। তাই তো বুদ্ধিজীবীদের বলা হয় "জাতির মূল চালিকাশক্তি"।
আজ বিশ্ব মুসলমানদের দুর্দিন।চারিদিকে অসভ্য অপসংস্কৃতির সয়লাব। সভ্য সমাজে অপশক্তির প্রভাব বিস্তার। মুসলমানরা অপসাংস্কৃতির ভয়াল থাবায় ভয়ার্ত। সমগ্র বিশ্ব সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমানদের আস্তানাগুলোতে পশ্চিমা রাম জেঁকে বসেছে। এসব কিছুর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো—ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। মুসলমানদেরকে নিঃশেষ করা। এই ভূমিকে খোদার বিধান থেকে মুক্ত করা।কেবলমাত্র এই জমিনে বসবাস করবে পশ্চিমা অনুসারীদের কতগুলো অমানুষ।এই হিংস্র চেতনাকে লালন করেই তারা পুষে রেখেছে অহমিকা। চালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ-বিগ্রহ। তাদের এই যুদ্ধে যেভাবে সামরিক ক্ষেত্রে সংগঠিত হচ্ছে, তদ্রুপ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রেও। মুসলমানদেরকে সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি চিন্তা লড়াই তথা বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের সম্মুখিন হতে হচ্ছে। তবে একথা অনস্বীকার্য — এখন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে মুসলমানদের থেকে একধাপ এগিয়ে অমুসলিমরা। মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে তারা ক্রমশ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে চলছে....!
তবে হ্যাঁ— আমাদের ও তাদের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য অনেকটা ভিন্ন। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই হল—আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ইসলামের দাওয়াতের। এলায়ে কালিমাতিল্লাহর। আল্লাহর সন্তুষ্টির । বিশ্বব্যাপী কোরআন ও হাদিসের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এবং মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামীর দিকে নিয়ে ন্যস্ত করা । সব ধর্মের জুলুম থেকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার এবং দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে বের করে আখেরাতের প্রশস্ততার দিকে অভিমুখী করার । অপরদিকে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের মূল মাকসাদ কেবল— নিজেদের স্বার্থ হাসিল। পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ নিজেদের দখলে আনা। মানুষদেরকে গোলামীর শিকলে বন্দি করা। তাদের রক্ত চোষা। তারা এসব করে
"মানবতা সহমর্মিতা, স্বাধীনতা, উদারতা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা"র মতো বিশ্বাসঘাতকতার মুখরোচক বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছে ।
বুদ্ধিভিত্তিক এ লড়াই নতুন কিছু নয়। এটা সেই প্রাচীনকাল হতেই চলে আসা একটি কৌশল। বিজয়ের উত্তম পন্থা। সত্য-মিথ্যা, হক বাতিলের লড়াই যেদিন থেকে শুরু, সামরিক লড়াই ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই এর সূচনাও ঠিক সেদিন থেকেই। যদি বলি সঠিক কবে তার জন্ম— হযরত আদম আলাইহিস সালাম সৃষ্টি করার অব্যাহতির পরে আল্লাহ তা'আলার সাথে বান্দার সম্পর্কচ্ছেদের মধ্য দিয়েই এই লড়াই এর সূত্রপাত ঘটে। সেই যে পৃথিবীর শুরু থেকে যুগ,শতাব্দি, কালের পরিক্রমায় সুকৌশলের ধারা অব্যাহত। এই কৌশল ইসলাম ও মুসলমানদের কৃতিত্ব এবং গৌরবান্বিত বিষয়। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের উত্তম হাতিয়ার দিয়েছে ইসলাম। জিহাদের মত চিন্তাযুদ্ধের পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনাও ইসলাম আমাদেরকে প্রদান করেছে।
সব কিছুই আমাদের স্বতন্ত্র। অতএব আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে অগ্রসর হতে হবে। অবতরণ করতে হবে চিন্তাযুদ্ধের ময়দানে। কারণ;পৃথিবীতে প্রচলিত যুদ্ধের ধারা দুটি—
এক. সামরিক যুদ্ধ
দুই. চিন্তা যুদ্ধ।
দুটি ভিন্ন কিছু নয়।বরং পাখির দুটি ডানার মতো একটি অপরটির পরিপূরক। এজন্যই বলা হয়, কোন জনগোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনা তাহজিব-তামাদ্দুন সভ্যতা-সংস্কৃতির বদলে দেওয়া শুধুমাত্র অস্ত্রের লড়াইয়ে যথেষ্ট মনে করা যাবে না, কেননা শুধুমাত্র সামরিক লড়াই সাফল্যের মুখ দেখাতে সক্ষম নয়। এক ডানা দিয়ে যেমন পাখি উড়তে অক্ষম। ঠিক তেমনি শুধু সামরিক যুদ্ধ দিয়েও বিজয় অসম্ভব। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই তার প্রমাণ মিলবে । সোনালী অক্ষরে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকা প্রতিটি বিজয়ী জাতি সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধকে যথেষ্ট কাজে লাগিয়েছে।আমাদের নবীজির কথাই বলি—খন্দকের যুদ্ধে হজরত সালমান ফারসির (রা.) মতো বুদ্ধিজীবী সাহাবির পরামর্শ নিয়ে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করে মদিনার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন প্রিয় নবী (সা.)
আবার হযরত উমরের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই—তার শাসনামলে যখন দেখলেন অমুসলিমরা মুসলিমদের কৃষ্টি-কালচার ও তাহজিব তামাদ্দুন বিনষ্ট করার সুযোগ খুঁজতে তৎপর।তখন তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য স্বতন্ত্র বিধান প্রণয়ন করেন। তাদের সবকিছু আলাদা করে দেন। মুসলিম-অমুসলিমদের মাঝে দূরত্ব বাধ্যতামূলক করেন। এই বুদ্ধিবৃত্তিক সর্তকতা অবলম্বন করেছিলেন—যেন কাফেরদের কোন কার্যকলাপ ও সংস্কৃতি মুসলিম ধর্মে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এভাবেই নবী-সাহাবা, তাবে-তাবেঈন, পীর-মাশায়েখ ওলি-বুজুর্গরা ইসলামকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করে গিয়েছেন।
সময় হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা নানা কাজে ডুবে আছি। হাত-পা গুছিয়ে প্রশান্তির খোঁজে বসে আছি। সামনের সময় আরো কঠিন হবে। সেই কঠিন সময়ের অপেক্ষা না করে কষ্টসাধ্য হলেও এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে।অতএব এখন মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য— আত্মরক্ষার জন্য সামরিক লড়াইয়ের পাশাপাশি চিন্তা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কেননা এর ফল দীর্ঘমেয়াদী। নেতা,রাজনীতিক, আলেম, গবেষক, শিক্ষক-ছাত্র, মসজিদের ইমাম-খতীব সহ প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য ইসলামের শত্রুপক্ষের সকল প্রকার ঢোকাও অপকৌশলের সম্বন্ধে পুণ্যবতী অর্জন করা আর প্রতিপক্ষের সকল প্রকার ঢোকাও অপকৌশলের সম্বন্ধে পুণ্যবতী অর্জন করা আর প্রতিপক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের কৌশল জানার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক অধ্যায়ন করা। বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা।এটাই সময়ের দাবী, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ তার বিপরীত।
হে তরুণ নওজোয়ান!জেগে ওঠো!
কোথায় বীর সালাউদ্দিন আইয়ূবী! মোহাম্মদ বিন কাসেম ও তারেক বিন যিয়াদের উত্তরসূরী।এগিয়ে এসো।ঐ দূর সিমান্তে বসে শত চেষ্টা আর নয়। সমাজ কখনো ওপর থেকে পরিবর্তন করা যায় না সমাজ পরিবর্তন করতে প্রয়োজন তৃণমূলে আঘাত করা। সমাজের তৃণমূলের শিশু-কিশোীদেরকে দিয়েই কাজ শুরু করা। সমাজ সংস্কারের কাজ প্রতিটি শিশু যেন আল্লাহভীরু, স্বদেশপ্রেম ও উন্নত প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখতে পারে। ক্ষমতার মসনদের চিন্তা করতে হলে আগে শক্তি সঞ্চয় করা অপরিহার্য। হঠাৎ রাতারাতি আমাদের হুংকারে রদবদল হবে না। যদি ধরে নিই হয়েছে,তবুও তা দীর্ঘমেয়াদি নয়। আমাদের প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করা।যেমন হতে পারে—আমি লিখতে পারি,আমি লেখক— আমার কাজ আমার লিখনী শিল্পীকে ত্বরান্বিত করা। সর্বাঙ্গীণ অনিন্দ্র ও কালোত্তীর্ণ পর্যায়ে পৌঁছানো। আমি রাজনীতি বুঝি, আমি নেতা— আমার কাজ সুখে-দুখে গরিব দুঃখীর পাশে থাকা। সমাজ উন্নতির লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আবিষ্কার করা।আমি উদ্যোগ নিতে জানি, আমি উদ্যোক্তা—আমার কাজ বেকারত্ব দূর করার চেষ্টা করা।এভাবেই স্ব স্ব অবস্থান হতে সকলেই অলসতার জীর্ণ চাদর ছুড়ে ফেলে কর্মতৎপরতার দিকে এগিয়ে আসা।
পরিশেষে বলবো, বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত জ্ঞানী ব্যক্তিদের ইসলাম যুদ্ধাবস্থায়ও সম্মান প্রদর্শন করেছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দি অমুসলিম জ্ঞানীদের মুক্তিপণ হিসেবে আর্থিক সুবিধার বদলে তারা কোনো মুসলমানকে অক্ষরজ্ঞান দান করলে মুক্তি দেওয়া হবে- এমন শর্ত নির্ধারণ করতেন। জ্ঞানীদের জ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা সারারাতের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। তাই আমাদেরও প্রয়োজনে বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে দূর্গ গড়ে তোলা।আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
-কেএল