মুফতি সাদেকুর রহমান।।
রমজানের শুরুতে যখন আমি জানতে পারলাম, সৌদি সরকার মক্কা-মদিনা শরিফে তারাবির ব্যাপারে করোনাকালীন গৃহীত সিদ্ধান্ত এই রমজানেও পুনর্বহাল রেখেছে। অর্থাৎ মক্কা-মদিনায় ২০ রাকাত এর পরিবর্তে ১০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তখন থেকেই আমি খুবই মর্মাহত ও ভারাক্রান্ত।
আমি বিশ্বাস করি এরূপ অবস্থা শুধু আমার একার নয়। বরং গোটা মুসলিম উম্মার সকলের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন করছে , এ কেমন সিদ্ধান্ত?
যখন পুরো বিশ্ব থেকেই করোনাকালীন বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করা হয়েছে এমনকি স্বয়ং সৌদি সরকার ও সকল সেক্টর থেকে বিধি-নিষেধ উঠিয়ে নিয়েছে, সেখানে হারামাইনের তারাবির বিষয়ে কেন এমন খামখেয়ালী?
দ্বীন-ইসলামের সুরক্ষা কেন্দ্র ও ইলমে নববীর বাতিঘর ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিবাদের সাথে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করছি। চরম ঘৃণা ও ক্ষোভের সঙ্গে সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করছি।
পবিত্র মক্কা ও মদিনা প্রিয় নবির দেশ। ঐশী বাণীর অবতরণস্থল হওয়ার কারণে সৌদি আরবের প্রতি সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে ভালোবাসা ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে। মক্কা মদিনার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি থাকলেও; আমরা বিশ্বাস করি- তারাবিসহ কোন ক্ষেত্রেই মক্কা-মদিনা আমাদের কাছে দলিল নয়। মুসলিম উম্মাহর কাছে প্রামাণ্য বা দলিল হলো- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস।
তবে হারামাইনের তারাবির ব্যাপারে সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত এবং বেশকিছু বিতর্কিত বিষয়ে অনুমোদন দেয়ার ফলে সাধারণ মুসলমানের কাছে তাদের প্রতি আস্থা- বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। তারা যা করবে তাই আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য হবে না। বরং তাদের কার্যকলাপ কুরআন-সুন্নাহর কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে যে দেশ বা জাতি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করবে তারাই আমাদের অনুসরণযোগ্য হবে। চাই তা আরবের কোন রাষ্ট্র হোক বা অনারবের। এ ক্ষেত্রে মূল লক্ষনীয় বিষয় হল কুরআন-সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশেদিনের আদর্শ কোথায় ও কাদের মধ্যে আছে তা খতিয়ে দেখা।
এই চিরন্তন নীতিকথাটিই চৌদ্দশ বছর পূর্বে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন।
এরশাদ হচ্ছে- তোমাদেরকে রাসূল যা আদেশ দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। সূরা হাশর: ৭।
আরো ইরশাদ হচ্ছে হে নবি আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাকে অনুসরণ কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন তোমাদের পাপরাশি মার্জনা করবেন । সূরা আলে ইমরান,আয়াত:৩১।
হযরত মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি এর সূত্রে বর্ণিত, নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তাকে আকড়ে ধরবে ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এক হল আল্লাহর কিতাব তথা কোরআনে কারিম। দ্বিতীয় হল, রাসূলের সুন্নাহ বা আদর্শ। মুয়াত্তা মালেক হাদিস ১৬৬১।
হজরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া রা. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিক- নির্দেশনামূলক উপদেশ দিলেন ফলে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হল। অন্তরগুলো বিগলিত হল। তখন আমরা ভাবলাম এটা যেন বিদায়ী উপদেশ। আমরা বললাম, আপনি আমাদেরকে কী ওসিয়ত করছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে এমন স্পষ্ট দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি, যা রাত দিনের মতো আলোকিত। হতভাগা ও ধ্বংসের অতল গহবরে নিমজ্জিত ব্যক্তিই কেবল তা থেকে বিচ্যুত হতে পারে। আমার ইন্তেকালের পর তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে, সে অনেক মতবিরোধ ও মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার আদর্শ এবং সঠিক পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে। সুনানে ইবনে মাজাহ , হাদিস ৪৩০,আবু দাউদ ৪৬০৯, তিরমিযী-২৬৭৬।
আর এটা সকলেরই জানা, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত সুন্নাহ, ইজমায়ে সাহাবা ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের দ্বারা প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ চার মাযহাব এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ।
যুগ যুগ ধরে এভাবেই মুসলিম উম্মাহ আমল করে আসছে। এমনকি স্বয়ং হারামাইনেও ২০রাকাতের আমল চালু ছিল। সৌদি সরকার করোনার ওজুহাত দেখিয়ে হুট করে ২০রাকাতের পরিবর্তে ১০রাকাতের আমল চালু করে দিল। আর এবছর তো করোনা মহামারী ও নেই। এতে স্পষ্ট হয়, এটা শুধুই হেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের অনুরোধ, অচিরেই হারামাইনসহ মক্কা মদিনার সকল মসজিদে ২০ রাকাত তারাবির চিরায়তধারা চালু করা হোক।
আল্লাহ তা’আলা সকলকে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখে বাতিলের মোকাবেলা করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: মুশরিফ, ফতোয়া বিভাগ শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদারাসা চৌধুরীপাড়া ঢাকা।
-এএ