মুফতি আল আমিন রাহমানী।।
ইতিহাস একগুচ্ছ অতীত। কাল-মহাকালে মানব-সভ্যতার গতি প্রবাহের সরল আলাপ। ইতিহাস মানুষকে হাত ধরে নিয়ে যায় দূর অতীতে। ভাঙ্গা-গড়ার বহু ঘটনার মুখোমুখী এনে দাঁড় করায়।
মেলে ধরে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর লুপ্ত-অবলুপ্ত নানা দৃশ্যপট। উত্থান-পতনের নির্মম পালাবদল, জয়-পরাজয়ের অসীম ঘূর্ণায়ন, চেষ্টা-পরিশ্রমের উত্তাল তরঙ্গায়ন আর স্বপ্ন-স্বাধের আকাশ ছোঁয়া সাফল্য কিংবা ব্যর্থতায় ঢাকা অকাল সমাধির নানা উপাখ্যান ছড়িয়ে থাকে ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে। ইতিহাস এক আলোক মিনার, যা যুগ ধরে আলো বিলায়। দিশা দেয় পথচলার, ইঙ্গিত দিয়ে যায় সফল আগামীর।
ইতিহাস এক বিস্তৃর্ণ পাঠ্যালয়। যেখানে ছড়িয়ে আছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু হীরকখণ্ড। থোকায় থোকায় সাজানো আছে প্রজ্ঞা-বিদ্যায় প্রস্ফুটিত হরেক পুষ্পমাল্য। যুগ-যুগান্তরে বিস্তৃত এ মহাজগতে ইতিহাসের সচেতন পাঠক খুঁজে পায় জীবনের অর্থ। অবাক চাহনিতে চষে বেড়াতে থাকে প্রান্ত হতে প্রান্ত। আচল ভরে সংগ্রহ করে নেয় সফল আগামী বিনির্মাণের যাদুকরী উপায়-উপকরণ।
ইতিহাস মেলে ধরে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন্ত বিরত্বগাঁথা। দিগ্বিজয়ের জ্বলন্ত আখ্যান। ইতিহাস আমাদের সুদিনের গল্প শোনায়। হৃদয়ে ঝড় তোলে। ঘুরে দাঁড়াবার সবক দেয়। চাঁদ ছিড়ে আনা প্রত্যয়ের গর্জন তোলে। বারুদের গায়ে ঠুকে দেয় শাশ্বত চেতনার বহ্নিশিখা।
ইতিহাস আমাদের চিৎকার করে বলে—তোমরা দাস নও, তোমরা বাদশাহ। তোমরা শাসিত নও, তোমরা শাসক। তোমরা ইতিহাসের নির্মাতা। তোমরা ইতিহাসের রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো সিংহ-শার্দূল। তোমরা সভ্যতার স্রষ্টা। তোমরা দূর্জেয় রোম-পারস্যের দম্ভ চূর্ণকারী। তোমরা মুহাম্মদী কাফেলা। গোটা বিশ্ব তোমাদের মাতৃভূমি।
তোমরা ভিখেরী নও। আজকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আদি ফর্মূলা তোমাদের থেকে ধার নেওয়া। চোখ ধাঁধানো আধুনিকায়নের নায়ক তোমরা, পেছনের গল্পটা তোমাদেরই।
জাবির ইবনে হাইয়্যান, আল খাওয়ারিজমী, আল ফাজারী, আল কিন্দী, আল ফারাবী, হাসান ইবনে হাইতাম, আল বেরুনী, ইবনে সিনা, উমর খৈয়াম, ইবনে রুশদ, আল জাযারী, ইবনে বতুতা, ইবনে খালদুন, হাসান চেলেবী তো তোমাদের। তাদের হাত ধরেই তো আজকের পৃথিবী উন্নতি-আধুনিকতার সবক নিয়েছে। গণিত, রসায়ন, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যামিতি, মহাকাশবিজ্ঞান, পদার্থ-বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, পর্যটনশাস্ত্র, অর্থনীতি তো তোমাদের সম্পদ।
একটি জাতি তাদের ইতিহাসে চোখ রেখে এগিয়ে যায়। পূর্বপুরুষদের জাগরণী ইতিহাসের সঞ্জিবনী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠে। পক্ষান্তরে ইতিহাসহারা জাতি নিজেরাই হারিয়ে যায়। ইতিহাসের অপরিণামদর্শী বিস্মৃতি জাতিকে পশ্চাৎপদ করে তোলে। হতাশা আর না পারার বেদনার দহনে জ্বলতে জ্বলতে এক সময় তারা পরিণত হয় উড়ন্ত ধুলিকণায়। ধীরে ধীরে ঠিকানাহীন বাতাসের তালে তালে তলিয়ে যায় কালের অতল গর্ভে।
সম্ভাবনার পায়রাটি কাতরাতে কাতরাতে মুহূর্তে ঢলে পড়ে চির নিদ্রায়। সোনালী দিগন্তের ঝলমলে আলোর আভাস উদ্ভাসিত হতে হতেই আধাঁর কালো মেঘে ছেয়ে যায় সম্ভাবনার বিস্তৃর্ণ আকাশ। যারা আগামীর পৃথিবীতে ইসলামকে নিয়ে স্বপ্ন আঁকে এবং ইতিহাসের বাগডোর নিজেদের হাতে রাখতে চায়, তাদের ইতিহাস অধ্যায়নের বিকল্প নেই। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে অতীতের বহু ঘটনা বিবৃত হয়েছে।
আল কোরআন ইতিহাসগ্রন্থ নয়, কিন্তু মানব জাতির উপদেশ হিসেবে ইতিহাসের নানা অংশ আল কোরআন তুলে ধরেছে। মহান আল্লাহ ইতিহাস মন্থন করে শিক্ষা নেওয়া উপদেশ প্রদান করেছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি ও দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিলো? (সুরা মুমিন, আয়াত: ৮২)
অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে— রাসূলদের যে সকল বৃত্তান্ত আমি আপনার নিকট বর্ণনা করছি, আমি তা দ্বারা আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় করি। এর মাধ্যমে আপনার নিকট সত্য এসেছে এবং মুমিনদের নিকট এসেছে উপদেশ ও সাবধানবাণী। (সুরা হূদ, আয়াত, ১২০)
আমাদের পূর্বসূরীগণও ইতিহাস অধ্যায়ন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে জোড়ালো তাগিদ করেছেন। নিজেদের পঠন-পাঠনে ইতিহাসকে আমরণ জিইয়ে রেখেছেন। সন্তানদের সবক দিয়ে গিয়েছেন।
বিখ্যাত সাহাবী সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এর ছেলে মুহাম্মদ রহ. পিতা সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এর ব্যাপারে বর্ণনা করছেন যেÑ বাবা আমাদেরকে বিভিন্ন যুদ্ধ-জিহাদের বিষয় শিক্ষা দিতেন। বলতেন—এগুলো তোমাদের পূর্বপুরুষদের মর্যাদার প্রতীক। তোমরা এ স্মরণীয় বিষয়গুলোকে বিনষ্ট হতে দিয়ো না। (সিরাতে হালাবিয়্যাহ, ২০৩/১)
একই কথা ‘মুখতাসারু তারিখে দিমাশক’ নামক গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে। (মুখতাসারু তারিখে দিমাশক: ২০৩/১) নবি দৌহিত্র হুসাইন রা. এর পুত্র যাইনুল আবিদীন আলী রহ. বলেন— আমরা নবিজী সা. এর জিহাদের ঘটনাগুলো কোরআনের কোনো সুরা শেখার মতো করে শিখে থাকি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২২৪/৩)
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর দরসের পাঠ্যসূচির একটি অংশ ছিলো নবিজী সা. এর যুদ্ধ-জিহাদের ইতিহাস সম্পর্কে।
ইবনে আব্বাস রা. এর বিশিষ্ট ছাত্র উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ রহ. বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন— কোনো দিন তিনি (ইবনে আব্বাস রা.) ক্লাসে কেবল ফিকহ (ইসলামি আইনশাস্ত্র), কোনো দিন তাফসির, কোনো দিন জিহাদের ইতিহাস, কোনো দিন কবিতা এবং কোনো দিন আরবের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতেন। (তাবাকাতে ইবনে সাআদ: ৩৬৮/২)
শুধু তাই নয়, খেলাফতের স্বর্ণ সময়ে ইসলামের যুদ্ধ-জিহাদের ইতিহাস শিক্ষাদানের জন্য স্বতন্ত্র্য শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হতো। হযরত কাতাদা ইবনে নু’মান রা. এর নাতি হযরত আসেম ইবনে উমর রহ. কে তৎকালীন খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. জামে মসজিদে ইসলামের যুদ্ধ-জিহাদের ইতিহাস এবং সাহাবিদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বিষয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়োগ করেছিলেন। বিষয়টি হাদিসশাস্ত্রে বরিত ইমাম ইবনে হাজার রহ. এভাবে তুলে ধরেছেন— তিনি (আসেম ইবনে উমর) ইলমে দ্বীনের একজন বর্ণনাকারী ছিলেন। যুদ্ধ-জিহাদের ইতিহাস সম্পর্কে তার ভালো জানাশোনা ছিলো।
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. দামেশকের কেন্দ্রীয় মসজিদে মানুষকে ইসলামের যুদ্ধ-জিহাদের ইতিহাস এবং সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা শিক্ষাদানের জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর তিনি সে দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। (তাহযীবুত তাহযীব: ৪৮/৫
ইতিহাস পাঠদানের সে ধারা আজ অবলুপ্ত। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার কথা তো বলাই বাহুল্য, ইসলামি শিক্ষাধারায়ও ইতিহাস বিষয়টি আজ চরমভাবে নিগৃহীত, উপেক্ষিত। তাই বর্তমান সাধারণ মুসলিম সমাজ তো বটেই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীও আত্মবিস্মৃতির নির্মম শিকার। আজকের তরুণরা উমাইয়া, আব্বাসী, ফাতেমী খিলাফাহ সম্পর্কে জানে না। সেলজুক ও প্রতাপশালী উসমানী সাম্রাজ্যকে ওরা রূপকথার গল্প মনে করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজধানীখ্যাত স্পেন, বুখারা-সমরকন্দের ইতিহাস আজ শুধু বইয়ের পাতায়। সে বই ক জন তরুণ আজ হাতে নেয়? আর আমরা ক জনই বা তাদের হাতে তুলে দিই?
পাঠ্যসূচিতে মৌলিকভাবে উপমহাদেশের মোঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কে কেবল আলোচনা করা হয়েছে। আর এটাকেই অনেকটা ইতিহাসের শেষপাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ আমাদের ইতিহাসের কি বিশাল জগত অধরা রয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের প্রতি এ অবিচারের ফলে ই আজ আমাদের হাতে ইতিহাস সেভাবে নির্মিত হচ্ছে না। এ দায় আমাদের, এ দায় সকলের। বিশেষত বোদ্ধা মহল কি এ দায় এড়াতে পারেন?
ইতিহাসের প্রতি এ অবজ্ঞার ফলে আজ আমাদের বারা ভাতে শকুনের দল ভাগ বসাচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে থালাটাও। আর আমরা চেয়ে দেখছি, বলার সাধ্য নেই। চেতনার ঘরে তালা লাগিয়ে আজ যখন আমরা উদাসীনতার ঘুমে বিভোর, তখন তারা তাবৎ বিশ^ দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঘুম পাড়ানির গান শুনিয়ে নিদ্রায় মগ্ন রেখে, আমাদের শাসনের ছড়ি হাতিয়ে ওরা আমাদেরই হাকিয়ে বেড়াচ্ছে। লাঞ্চনার তিলক এঁকে দিচ্ছে আমাদের দূর্ভাগা ললাটে। এ আলস্য নিদ্রার ভঙ্গন কি কভূ হবে?
ইসলামি বিশ্বের ইতিহাস তো এখন হাতের নাগালেই। ক্লিক পরিমাণ দূরত্বে ইতিহাসের সুবিশাল ফিরিস্তি। কিন্তু আমাদের আগ্রহ নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজেদের পেছনটা একটু তলিয়ে দেখতে রাজি নই আমরা। প্রয়োজন সচেতনতার। নিজের। সবার। ইতিহাসের মনোযোগী পাঠই পারে আমাদের আবার রাজ আসনে সমাসীন করতে।
কবে আসবে সে ভোর, যে ভোরের রক্তিম সূর্যটা নতুন দিনের বার্তা নিয়ে হেসে উঠবে পুব দিগন্তে! আমরা আবার ইতিহাসের লাগাম টেনে ধরবো! যাত্রা করবো এক স্বপ্নের পৃথিবীর দিকে। মহামহিম প্রভূর সকাশে এ প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষক, কাজিপুর আল জামিয়াতুল মাদানিয়া মাদরাসা, সিরাজগঞ্জ
-এটি