শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আমরা কি আবার জাহিলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব।।

সেদিন ঢাকায় ‘সিটিং সার্ভিস’ উপাধির একটি লোকাল বাসের যাত্রী হলাম। স্বাভাবিক নিয়মেই গাড়িভর্তি যাত্রী। যে পরিমাণ যাত্রী সিটে বসা, দাঁড়ানো যাত্রীর সংখ্যা তার সমান না হলেও কাছাকাছি। এরপরও ছোট-বড় প্রত্যেক স্টেশনে গাড়ি থামছে। এমনকি রাস্তার পাশে যেখানেই লোকজনের জটলা, যেন অনিচ্ছাতেই গাড়ি গিয়ে সেখানে আটকে পড়ছে। এরপর সেখান থেকে কখনো কেউ উঠছে, কখনো উঠছে না।

এভাবেই জ্যাম ঠেলে ঠেলে গাড়ি এগুচ্ছে।
অন্য অনেক যাত্রীর সঙ্গে আমিও দাঁড়ানো। বসে থাকা এক যাত্রীর সিট ধরে অনুগ্রহভারে নীরব।

হঠাৎ বাচ্চা কোলে নিয়ে এক দম্পতি গাড়িতে উঠলেন। বাচ্চাটি প্রথমে ছিল বাবার কোলে। কিছুক্ষণ পর মায়ের কোলে এলো। মা বোরকা পরিহিতা এক নারী। ‘মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’ দখল করে আছে কয়েকজন পুরুষ। সংরক্ষিত আসন দখল করা এক পুরুষ যাত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বোরকা পরিহিতা নারী। আমি তার কয়েকজন পর।

বাচ্চাটি আবার কোল পরিবর্তন করল। কিছুক্ষণ পর আবার। জ্যামে আটকে থাকা গাড়িতে আমরা প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে আছি। কয়েকবার ইচ্ছে হলো মহিলা আসনে বসা পুরুষদের কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করি। পরে মনে হল, মহিলা যাত্রী তো আরও কয়েকজন দাঁড়ানো। শুধু একজনের জন্য কী বলব? তাছাড়া কারো চেহারার দিকে তাকিয়েও মন সায় দিল না। কিন্তু বাচ্চাটির দু-দুবার কোল পরিবর্তন দেখে তার এবং তার মা-বাবার কষ্ট যেন কিছুটা অনুভব করলাম। মনে হলো, বাচ্চার আগ্রহে নয়, মা-বাবার প্রয়োজনেই কোল পরিবর্তন হচ্ছে। তাই একজনকে বললাম, ভাই! বাচ্চা নিয়ে মহিলাটির খুব কষ্ট হচ্ছে...।

কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, আমার পায়ে ব্যথা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। পাশের জনকে বললাম, আপনি একটু....। তিনি যুক্তির আলোকে বুঝালেন, লোকাল গাড়িতে উঠলে একটু কষ্ট করতেই হয়।
বললাম, এগুলো তো মহিলা সিট। সে হিসেবেও অন্তত...।
তিনি বললেন, গাড়িতে কোন মহিলা সিট হয় না। ভাড়া তো সবাই সমান দিবে। তাহলে পার্থক্য কিসের?
আশ্চর্য হলাম।
পাশের কেউ কোন কথা বলল না। এতক্ষণ মহিলাটি বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেন কারো নজরেই পড়েনি। মহিলার স্বামীও বোধহয় কিছু বলার সাহস পেলেন না।

আমি আমার নরম স্বভাবের কারণে শক্তভাবে কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। মনে তীব্র কষ্ট নিয়ে নীরব দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাদের মানসিক অবস্থা ও বিবেকহীন সামাজিকতার খণ্ডচিত্র দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। এমন সময় একজন পুরুষ বললেন, ‘উনাকে আমার এখানে বসতে বলেন।’
তিনি উঠলে বাচ্চা নিয়ে মহিলাটি সেখানে বসলেন।

তখন ছোট ছেলেটির ভাষাময় নীরব দৃষ্টি আমার দিকে। তার দৃষ্টির ভাষা কিছুটা আঁচ করতে পেরে আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। ভাবলাম, এত ছোট বাচ্চাও কৃতজ্ঞতা বুঝে। সমবেদনা বুঝে! মমতা ও সহানুভূতি বুঝে! অত শব্দ হয়তো জানে না। কিন্তু তার অনুভূতি আছে। তার দৃষ্টি থেকে স্পষ্ট সেই অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে।

থেমে থেমে গাড়ি চলছিল। আমি আনমনে ভাবছিলাম, সহমর্মিতা মানুষের স্বভাবগুণ। জন্ম থেকেই এসব গুণ আল্লাহ তায়ালা মানুষের মাঝে দিয়ে রাখেন। পরবর্তী জীবনে সেই গুণ কারো বাড়ে। পরিবেশের ভিন্নতায় কারো কমে। এর জন্য কে দায়ী?

ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামের ছেলেরা বাবা, চাচা এমনকি প্রতিবেশী চাচাকেও শ্রদ্ধা করতো। তার সামনে দিয়ে হাঁটতো না। তার ধমককে শাসন মনে করত। প্রতিউত্তর করত না। একটু বয়স্ক মুরুব্বী, মান্যগণ্য ব্যক্তি, কিংবা শিক্ষকদের দেখলে সাইকেল থেকে নেমে যেত। আমরা এটাকেই নিজেদের করণীয় মনে করতাম। আবশ্যক জানতাম। ফলে বড়দের কারো সামনে সতর্ক হয়ে থাকতাম। আদব-কায়দা যেন রক্ষা হয়, সেই চেষ্টা করতাম।

আমাদের শৈশব তো এই সেদিনের কথা। অথচ আজ আমাদের আত্মীয় ছোটদের অবস্থা দেখলে অবাক হই। দাদা কিংবা তার চেয়েও বেশি বয়সী মুরব্বিদের তোয়াক্কা করছে না। তাদের সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে তর্ক করছে। স্পষ্ট বুঝা যায়, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। মুরুব্বীদেরও নেই তাদেরকে সামান্য ধমক দেয়ার সৎ সাহস (!)। কর্তব্য মনে করে কেউ কখনো কোন ধমক দিলে, শাসন করলে, ওরা কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। মুরুব্বিদের কথাকে অহেতুক প্রলাপ মনে করছে।

এত দ্রুত সমাজ এতটা বদলে গেছে?
অথচ সেদিনের বাসে ওই মহিলা যাত্রীর বাচ্চাটিকে দেখলাম স্পষ্ট বুঝতে পারছে সহানুভূতি। এমনকি হয়তো বুঝতে পারছিল তার মায়ের কষ্ট এবং অন্যদের তা খেয়াল না করার অমানবিকতা। অতএব বুঝা যায় জন্মগত অনুভব অনুভূতি সবই এখনো আছে আগের মতোই। কেবল বদলে গেছে সমাজের পরবর্তী পরিবেশ। সেই পরিবেশে এই বুঝমান শিশুরাও হয়ে উঠছে অবুঝ।

আগে তো খুব দেখেছি মুরুব্বিদের জন্য সিট ছেড়ে দেওয়ার দৃশ্য। এমনকি বাবা সন্তানকে বলতেন, দেখো, মুরুব্বি দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে বসতে দাও। এখন কি বাবারা বলেন সেসব কথা? মাঝেমধ্যে দেখা যায় মুরুব্বীরা এবং বয়স্ক অসুস্থ মুরুব্বীরা দাঁড়িয়ে থাকেন তরুণ যাত্রীর সিট ধরে। কখনো পাশেই থাকেন তরুণের বাবা। এবং আশ্চর্য যে...
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ কি নেই? কেন যেন ভয় হয়।
মনে পরে মর্মসমৃদ্ধ হাদিসের একটি টুকরো-
كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ

প্রত্যেক শিশু ফিতরাত (আল্লাহর প্রদত্ত উত্তম স্বভাবগুণ) এর উপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি বানায় কিংবা নাসারা বানায় কিংবা বানায় অগ্নিপূজক।-সহীহ বুখারী, হদীস নম্বর : ১৩৮৫

ঠিক একইভাবে প্রত্যেক শিশু জন্মগত উত্তম স্বভাবগুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এরপর বাবা-মা ও চারপাশের পরিবেশ তাকে অমানবিক বানায়। আদব-আখলাকহীন বানায়। তার উত্তম গুণগুলো নষ্ট করে দেয়। কিংবা অন্তত গুণগুলোকে বাড়তে দেয় না।

এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? পনেরোশ’ বছর আগের সেই পুরনো জাহিলিয়াতের যুগে? আসমানী শিক্ষা ও দীক্ষাহীন অজ্ঞতা-মূর্খতার সেই সময়ে? সে যুগের ইতিহাস পড়ে বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে কি তাই মনে হয় না?

হে আল্লাহ! আমাদেরকে, অন্তত মুসলিম উম্মাহকে আপনি ইসলামী শিক্ষায় সমৃদ্ধ করুন। দীনী চেতনায় আলোকিত করুন। করুন সত্যিকারের নীতি-আদর্শে আদর্শবান।

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ