।।মাওলানা আনোয়ার হুসাইন আশরাফী।।
ভাল ফলাফল করতে হলে সারাবছর সময় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হয়। অপরিকল্পিত অনেক পরিশ্রমে সফলতা অর্জিত হয় না।
বিশেষভাবে পরীক্ষাপূর্ব প্রস্তুতির সময় সুচিন্তিতভাবে একটি রুটিন তৈরি করে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী সময় কাজে লাগাতে হবে। রুটিনটি পড়ার সময় ও পঠিতব্য বিষয়গুলোর পরিমানের মাঝে সামাঞ্জস্য বজায় রেখে তৈরি করতে হবে।
যাতে করে কোনো একটি কিতাব বা বিষয় পড়তে পড়তেই সময় শেষ না হয়ে যায়। দরস চলাকালীন সময় ও দরসের ফাঁকে ফাঁকে বহু সময় পাওয়া যায়। সে সময়ও কোনো একটি কিতাবের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগাতে হবে।
কমপক্ষে ভালো ফলাফল প্রত্যাশী একজন সচেতন ছাত্রের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই কাম্য। ভাল ফলাফল প্রত্যাশীদের জন্য কিছু পরামর্শ ধরা হলো।
প্রস্তুতির পূর্ব কথা:
০১- সর্বপ্রথম আপনাকে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে হবে।
০২- শুরুতেই নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। উদ্দেশ্য হবে কিতাবের মাসয়ালাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারা।
০৩- বেশি বেশি দোয়ার ইহতেমাম করা। পিতা-মাতা ও উস্তাদদের থেকে বারবার দোয়া নেওয়া।
০৪- প্রতি ফরজ নামাজের পর একুশ বার করে "ইয়া আলিমু" পাঠ করা।
০৫- বোর্ড পরীক্ষার আপডেট সাজেশনপত্র সংগ্রহ করা। এবং পরীক্ষার সহায়ক অন্যান্য মৌলিক শরাহ শরুহাত ব্যবস্থা করে রাখা।
০৬- পুরো সময়টা সুপরিকল্পিত নিযামুল আওকাতের অধীনে নিয়ে আনা।
০৭- সার্বক্ষণিক সর্ববিষয়ে উস্তাদদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা।
০৮- পড়ার সুন্দর জায়গা ও ভালো সাথী নির্বাচন করা।
০৯- যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে একমনে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া। যথাসম্ভব ফোন ও অনলাইন থেকে দূরে থাকা।
১০- অভিজ্ঞদের থেকে পরামর্শ করুন। নির্দেশনাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন।
প্রস্তুতির শুরু কথা:
০১- প্রতিটি কিতাবের কমপক্ষে বিগত বারো বছরের প্রশ্নগুলো খুব ভালোকরে অনুশীলন করা।
০২- স্বাভাবিকভাবে প্রথম পর্যায়ে শুরুর তিন প্রশ্ন টার্গেট রাখা।
০৩- ক্ষেত্রবিশেষ পাঁচ নম্বর প্রশ্নেও নজর দেওয়া যেতে পারে। কারণ এই প্রশ্ন টা তুলনামূলক সহজ ও কমন হয়ে থাকে।
০৪- গুরুত্বপূর্ণ ইবারতগুলো হরকতসহ ঠিক করে রাখা। মনে রাখবেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইবারতের প্রশ্নেই কিন্তু পাশ নম্বর চলে আসে।
০৫- প্রশ্নগুলো সামনে রেখে আপনার মেধা ও সক্ষমতা অনুযায়ী নির্ধারিত পৃষ্ঠা বাছাই করে নিন।
০৬- সবার আগে গত বছরের প্রশ্ন লক্ষ্য রাখবেন। কারণ এই বছরের সিলেবাস ও গতবছরের সিলেবাস কাছাকাছি।
০৭- যাই পড়বেন সংক্ষেপে নোট করে রাখবেন। যাতে ছরছরি নজর দিলে পুরো আলোচনা সামনে চলে আসে।
০৮- বিশেষ বিশেষ জায়গা নির্বাচন করুন। বিভিন্ন পরিভাষা মুখস্থ রাখুন।
০৯- ইমামদের ইখতেলাফগুলো সংক্ষেপে নোট করে রাখুন। নামগুলো খুব ভালোকরে মুখস্থ রাখুন।
১০- কিতাবের মূল নাম, পুরো নাম মুখস্থ রাখুন। লেখকের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। কিছু ব্যাখ্যাগ্রন্থের নাম।
১১- যেসব স্থানে একাধিক মতামত পাওয়া যায় সেসব স্থানগুলো চিন্থিত করে ভালভাবে মুখস্থ করা।
১২- ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম পুরোটা পড়ে একটা খোলাসা দাঁড় করানো এবং সেই অনুযায়ী মুখস্থ করা।
১৩- দৈনিক কিছু উত্তর লেখার অনুশীলন করা। সংশ্লিষ্ট উস্তাদ ও ভালো ছাত্রদের থেকে সহযোগিতা নেওয়া।
১৪- কোন বিষয়কেই গুরুত্বহীন মনে করবেন না। আবার কঠিন ভেবে ধৈর্য হারাবেন না।
১৫- পরিশেষে মনে রাখবেন পরীক্ষার ফলাফল আপনার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি।
কিতাব ভিত্তিক কিছু পরামর্শ:
মেশকাত শরীফ:
০১- হাদিসের হরকত ঠিক করা।
০২- হাদিসের বিশুদ্ধ তরজমা করা।
০৩- হাদিসের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জেনে রাখা।
০৪- বিভিন্ন যমিরের মারজা' জেনে রাখা।
০৫- মহল্লে ইরাব জেনে রাখা।
০৬- নতুন নতুন শব্দের অর্থ জানা।
০৭- গুরুত্বপূর্ণ শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ জানা।
০৮- বিভিন্ন বিষয়ের হুকুম জেনে রাখা।
০৯- বিভিন্ন ইখতেলাফি মাসয়ালায় উলামায়ে আহনাফের দলিল মুখস্থ রাখা।
১০- হাদিসের বাহ্যিক পরস্পরবিরোধিতা নিরসন জেনে রাখা।
১১- কিছু জিনিসের নাম করণের কারণ জেনে রাখা।
১২- বিভিন্ন তাশবীহের বিশ্লেষণ জেনে রাখা।
১৩- প্রসিদ্ধ রাবিদের জীবনী জেনে রাখা। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু সহ চার খলিফা ও আবাদালায়ে ছালাছা এবং আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ও আনাস রাযিঃ সহ প্রসিদ্ধ সাহাবাদের জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে মুখস্থ রাখা। বিশেষকরে মৃত্যু তারিখ।
১৪- পঞ্চম প্রশ্নে সামনে রেখে বাব ভিত্তিক হাদিস মুখস্থ রাখা।
১৫- মনে রাখবেন:
(ক)- মেশকাত শরীফ প্রথম খন্ডে সাধারণত প্রথম (১০- ১০৫) একশো পৃষ্ঠার মধ্যেই তিন প্রশ্ন চলে আসে। তাই সচেতন হোন। নিজের প্রতি যত্নশীল হোন।
(খ)- মেশকাত শরীফ দ্বিতীয় খন্ডে সাধারণত প্রথম (২৬৭- ৪০৪) একশো পঁয়তিরিশ পৃষ্ঠার মধ্যেই তিন প্রশ্ন চলে আসে। আর দেরি না। শুরু করুন।
(গ)- মেশকাত শরীফ দ্বিতীয় খন্ডের তৃতীয় প্রশ্ন টা অনেক সময় একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাই প্রশ্নগুলো দেখে বুঝে নেওয়া।
তাফসিরে বায়যাবি শরীফ:
০১- প্রথম ত্রিশ পৃষ্ঠা ভালোভাবে আয়ত্ত করা। তিন প্রশ্ন এর বাইরে যাবে না ইনশাআল্লাহ।
০২- সূরা ফাতিহা খুব ভালো করে মুখস্থ করে ফেলা।
০৩- কবিতাগুলো অর্থসহ, লেখকের নাম ও মহল্লে ইসতেশহাদ মুখস্থ রাখা।
০৪- আয়াতের পারস্পরিক সম্পর্ক মুখস্থ করা। যাকে বলা হয়, রবতুল আয়াত।
০৫- কিতাবের পূর্ণ নাম ও লেখক পরিচিতি।
০৬- সূরা ফাতিহার বিভিন্ন নাম, কারণসহ মুখস্থ করা।
০৭- উক্ত পেজগুলোর গুরুত্বপূর্ণ হাশিয়া ও বাইনাস সতর দেখে রাখা।
০৮- বিভিন্ন পরিভাষা মুখস্থ করা।
০৯- দুর্বোধ্য শব্দের সমাধান ও কঠিন জায়গাগুলোর মহল্লে ইরাব হল করা।
১০- বিভিন্ন শব্দের বিভিন্ন কিরাত মুখস্থ করা।
হেদায়া শরীফ:
০১- গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ইবারত হরকতসহ ঠিক করা।
০২- যেসব ইবারতে ইখতিলাফ বর্ণণা করা হয়েছে সেগুলো আলাদাভাবে ঠিক করা।
০৩- পক্ষে বিপক্ষে দলিল ও জবাবগুলো খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া।
০৪- সংক্ষিপ্তভাবে নোট করে ইখতিলাফি মাসয়ালা গুলো মাঝেমধ্যে নজরে দেওয়া।
০৫- পঞ্চম প্রশ্নে ছোট ছোট প্রশ্ন আসে। এখানে ছোট ছোট মাসয়ালা, বিভিন্ন সংজ্ঞা ও পার্থক্যজনিত মাসয়ালা গুলো বেশি আসে।
০৬- গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ের আভিধানিক ও পারিভাষিক পরিচয় মুখস্থ রাখা।
০৭- প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরু ও শেষের দিকের মাসয়ালা গুলো ভালো করে স্মরণ রাখতে হবে।
০৮- নতুন নতুন সব অধ্যায়ের শুরুর মাসয়ালা গুলো ছরছরি নজর দিয়ে রাখা।
০৯- ক্ষেত্র বিশেষ মহল্লে ইরাব ও চাইতে পারে।
১০- (ক) হেদায়া তৃতীয় খন্ডের শুরু থেকে কিতাবুল কাফালাহ পর্যন্ত মাসয়ালা গুলো মৌলিক ভাবে স্মরণ রাখা। এরমধ্যেই তিন প্রশ্ন চলে আসে সাধারণত।
(খ) হেদায়া চতুর্থ খন্ডের প্রথম ৬০-৭০ পৃষ্ঠা ভালো করে পড়া। আরো একধাপ এগিয়ে বাবুল কারাহিয়াত শেষ করতে পারলে ভালো।
নুখবাতুল ফিকার:
০১- ইবারত হল করা।
০২- তরজমা ও তাশকিল ঠিক করা।
০৩- বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে লেখকের উদ্দেশ্য কি তা জেনে রাখা।
০৪- লেখকের জীবনী ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
০৫- প্রথম থেকে ৭০-৮০ পৃষ্ঠার মধ্যে তিন প্রশ্ন চলে আসে সাধারণত।
০৬- বিভিন্ন কিছুর পরিচয় ও পার্থক্য নির্ণয়।
০৭- বিভিন্ন হুকুম বর্ণণায় ইমামদের ইখতেলাফ।
০৮- খুঁজে খুঁজে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নির্বাচন করা।
শরহে আকায়েদ:
০১- কিতাবের ভূমিকাসহ প্রথম ৫০ পৃষ্ঠা।
০২- শেষের দিকে আযাবুল কবর থেকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুখস্থ করা।
০৩- প্রতিটি আলোচনা পড়ে মৌলিক বিষয় টা মুখস্থ করে নেওয়া।
০৪- কিছু জিনিসের পরিচয় ও প্রকার।
০৫- ইবারত ও তাশকিল ঠিক করা।
তাহরিকে দারুল উলুম দেওবন্দ:
০১- পঞ্চম প্রশ্ন টার্গেট রাখা।
০২- প্রতিটি শিরোনাম পড়ে সারকথা মুখস্থ করা।
০৩- সাল তারিখ নোট করে নেওয়া।
সর্বশেষ:
০১-একজন আদর্শবান ছাত্রের জন্য যথেষ্ট মেহনত ও একনিষ্ঠ সাধনা অনিবার্য। উপরোক্ত দিক নির্দেশনা দ্বারা ছাত্র ভাইদের সামনে উপকারী ও সম্ভাবনাময় এবং অবশ্য পালনীয় কিছু ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। যা সামগ্রিকভাবে উপকারী বলে বিবেচিত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে সফলতার উচ্চ সোপান অন্বেষীদের জন্য সম্ভাবনা ও ধারণার স্থানকে যথেষ্ট মনে করা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাদেরকে কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাশিয়াসহ ভালোভাবে আয়ত্ত করার পরামর্শ দিচ্ছি।
০২- গল্প গুজব করে সময় নষ্ট করবেন না। আপনার ভবিষ্যৎ আপনাকেই গড়তে হবে। কেউ এসে গড়ে দিবে না। একয়দিনের জন্য বন্ধুদের ভুলে যান।
০৩- পড়ার টেবিলের সামনে উৎসাহমূলক বিভিন্ন কথা লিখে রাখবেন।
০৪- নিয়মিত সালাতুত হাজতের আমল করার চেষ্টা করুন।
০৫- পারলে মান্নত মানুন। দান সদকার পাশাপাশি রোজা রাখতে পারেন।
পরীক্ষার হলে:
০১- পাক সাফ হয়ে হলে যাবেন।
০২- ইয়া আলিমু ও দরুদ শরীফের আমল বেশি বেশি করবেন।
০৩- হলে ঢোকার পর একটাও কথা বলবেন না।
০৪- যা বুঝবেন তাই লিখবেন। মুযাকারা বা সহমর্মিতার আলাপ পরিহার করবেন।
০৫- প্রশ্ন না বুঝলেও দাঁড়াবেন না। যা বুঝবেন তাই যথেষ্ট।
০৬- শুরু থেকেই সময়ের প্রতি যত্নবান হবেন।
০৭- কোন জুয না লিখে আসবেন না।
০৮- পয়েন্ট আকারে ও প্যারা সিস্টেমে লিখবেন।
০৯- ঝকঝকে ও পরিষ্কার করে লিখবেন।
১০- পরিক্ষার দিনগুলোতে নিজের প্রতি যত্নশীল হবেন।
১১- খেয়ারে ভালো করে পড়বেন তাহলে পরীক্ষার সময় রাত জাগতে হবে না।
১২- সর্বশেষ কথা, পরীক্ষা একটি খেলা। একটি মানদন্ড। দোয়ার ইহতেমাম করুন। গুনাহ পরিহার করুন।
বিঃদ্রঃ ইতিহাসের ক্ষেত্রে ৩ বিষয় লক্ষণীয়ঃ-
১.আলোচিত ব্যক্তির নাম
২.স্হান অর্থাৎ কোন জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে।
৩. সাল অর্থাৎ কত সনে ঘটনাটি ঘটেছে।
-কেএল