ফাহিম সিদ্দিকী।। আমি বলবো এটা অন্যায় হয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা ও ননদ-দেবরদের কোনো কাজে সহযোগিতা করা— স্ত্রীর দায়িত্ব নয়।
বরং এটা তার একটি অতিরিক্ত কাজ। কিন্তু বর্তমান সমাজে বিষয়টাকে এমনভাবে দেখা হয় যে, যেন এটা তার অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। বরং এটিই যেন তার প্রধান দায়িত্ব!
বিভিন্ন পরিবারের অবস্থা তো এমন যে, ছেলের জন্য বউ আনা হয় কেবল শ্বশুর-শাশুড়ির সেবার জন্য। আরও সত্যি করে বললে, সমাজের বৃহত্তর অংশের ভাবনায় ঘরে পুত্রবধু আনা হয় কাজের লোক হিসেবে। এসবই পরিমিতিবোধের চরম লংঘন।ইসলামের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। মা-বাবার সেবা-শুশ্রূষা করা সন্তানের দায়িত্ব— কোনোভাবেই পুত্রবধূর নয়। (আল-বাহরুর রায়েক : ৪/১৯৩; কিফায়াতুল মুফতি : ৫/২৩০)
মা-বাবার খেদমতের প্রয়োজন দেখা দিলে, ছেলে নিজ কর্তব্যে তাদের সেবা-যত্ন করবেন। স্ত্রী যদি সন্তুষ্টচিত্তে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির বা স্বামীর মা-বাবার সেবা করে, সেটা প্রশংসনীয়।
বিনিময়ে তিনি সওয়াব পাবেন। তবে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে, এসব করতে স্ত্রী আইনত বাধ্য নয়।
ইসলাম ও নৈতিকতাবোধের দাবি এটা যে, স্ত্রী স্বামীর বাবা-মাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান দেবেন। তাদের প্রতি সমীহের চোখে দেখবেন। মনেপ্রাণে তাদের ভালোবাসবেন।
তাদের সেবা-যত্নকে নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করবেন। অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িরও কর্তব্য হলো- পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো আদর ও মমতায় আবদ্ধ করা। তার সুখ, আনন্দ ও সুবিধার প্রতি সবিশেষ মনোযোগ দেওয়া।
এই অযাচিত বাধ্যবাধকতা কি স্ত্রীত্বের মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করে না? আল্লাহ তাআলা যাকে পুরুষের জীবন-পরিক্রমার দোসর বানিয়েছেন অংশতঃ হলেও তাকে কেন গোটা পরিবারের সেবাদাসী করে রাখা হবে এবং কেন সে তার সেবাশ্রমের যথাযথ মর্যাদাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে? এ বঞ্চনা কি তার একার?
এর দ্বারা প্রকারান্তরে স্বামী নিজেও কি বঞ্চিত হচ্ছে না? এরকম নিরবকাশ শ্রমক্লিষ্ট স্ত্রীকে স্বামী ঠিক কতখানি পায়? তার তো স্বামীকে সঙ্গ দেওয়ার কোন অবকাশ নেই। তার কোন ছুটি আছে কি? স্বামীর ঠিকই ছুটি আছে। সে কৃষক হলেও তার ছুটি আছে। তার কাজের মওসুম আছে। মওসুম শেষে তার যথেষ্ট বিরতি থাকে।
শ্রমিক স্বামীদেরও সাপ্তাহিক ছুটি আছে, আছে জাতীয় ছুটি এবং আরও বিভিন্ন উপলক্ষে প্রাপ্ত অবকাশ। তা ছাড়া যারা অফিস-আদালতে কাজ করে তারাও নানারকম ছুটি ভোগ করে।
কিন্তু স্ত্রীদের ছুটি কোথায়? তাদের তো বছরের তিনশ’ পয়ষট্টি দিনই সমান ডিউটি, নিরবচ্ছিন্ন কর্মব্যস্ততা। স্বামীদের ডিউটির দিনগুলোতেও ব্যস্ততা থাকে অফিসযাত্রা থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। অন্যদেরও কমবেশি এরকমই, কিন্তু স্ত্রীদের কাজ শুরুও হয় আগে এবং শেষও হয় পরে। অথচ কুরআন মাজীদের ভাষ্য অনুযায়ী বিবাহের অন্যতম প্রধান লক্ষ হল
لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا
যাতে তোমরা স্ত্রীদের সান্নিধ্যে পৌঁছে (দেহমনের) প্রশান্তি লাভ করতে পার (রূম : ২১)। কিন্তু সারাদিনের কর্মক্লান্ত স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে প্রশান্তি যোগানো কতটুকু সম্ভব? এভাবে তাদেরকে অপরিমিত খাটানোর ফলে বিবাহের এক প্রধান লক্ষই কি ভেস্তে যায় না?
তা যায় বলেই তো বহু অসংযমী স্বামী ভিন্ন পথে প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায় আর এভাবে কেবল নিজ চরিত্রই হনন করে না, পরিবারকেও বিপর্যস্ত করে এবং সমাজকেও করে ক্লেদাক্ত। আল্লাহ আমাদের শান্তিপূর্ণ একটি ইসলামী সমাজ দান করেন এই কামনায় শেষ করছি।
উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায় ঘটেছে এই ঘটনা। অসুস্থ মায়ের যত্ন নিতে অবহেলা করায় ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন এক পরিবারের ৩ সহোদর।
আলজেরিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে গালফ নিউজ জানিয়েছে, রোববার বাইরের কাজ থেকে ঘরে ফিরে ওই ৩ ভাই দেখতে পান, বাড়ির উঠোনে তাদের অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে প্রতিবেশীরা স্নান করাচ্ছেন এবং স্ত্রীরা আশপাশে নেই।
এই ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন তিন ভাই এবং উঠোনে দাঁড়িয়েই স্ত্রীদের তালাক দেন তারা। গালফ নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ ছেলে ছাড়াও এক মেয়ে রয়েছে সেই বৃদ্ধার।
এতদিন পর্যন্ত তিনিই মায়ের দেখাশোনা করতেন। কিন্তু সম্প্রতি তার স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়ায় তাকে সময় দিতে হচ্ছে, মায়ের সেবা করার জন্য সময় বের করতে পারছেন না তিনি।
এদিকে, ৩ ভাই তাদের স্ত্রীদের তালাক দেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে— এমন বলার সুযোগ নেই। কারণ স্ত্রীরা তাদের শাশুড়ির যত্ন-আত্তি নিতে পারবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। আপাতত প্রতিবেশীরাই দেখভাল করছেন ওই বৃদ্ধার। সূত্র: গালফ নিউজ
-এটি