শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যে জ্ঞান প্রকৃত সফলতার পথ দেখায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ

আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন। আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। মানুষ জ্ঞান অর্জন করে এবং কর্মে লিপ্ত হয়। কারো জ্ঞান সৎকর্মে ব্যবহার হয় আর কারো মন্দকর্মে। সৎকর্মের দ্বারা কীর্তিমান হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুগ যুগ ধরে বেঁচে রয়। আর মন্দকর্মের দ্বারা নিন্দিত, কলঙ্কিত ও অপমানিত হয়।

মানুষ কর্মের দ্বারাই নিজের অবস্থান তৈরী করে। কর্মের দ্বারা কেউ শিক্ষক, কেউ কৃষক, কেউ ড্রাইভার, কেউ প্রকৌশলি, কেউ শিল্পপতি, কেউ এমপি, কেউ মন্ত্রী, কেউ রাষ্ট্রপতি হয়। আবার কেউ চুর, কেউ ডাকাত, কেউ মদ্যপায়ি, কেউ মিথ্যাবাদি, কেউ ব্যভিচারি, কেউ অত্যাচারি হয়। মানুষের জ্ঞান আল্লাহর আদেশ-নিষেধের আলোকে পরিচালিত করলে মানুষ সফলতা লাভ করে; অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মানুষ কি করবে, কি করবে না, কোনটি অপরাধ, কোনটি অপরাধ নয়Ñসে বিষয়ে প্রতিটি সমাজ-সভ্যতারই আলাদা আলাদা নীতিমালা রয়েছে। নির্ধারণকৃত নীতিমালার উর্ধ্বে গিয়ে কেউ অপরাধে লিপ্ত হলে সমাজিক বিধির আলোকে শাস্তির বিধান রয়েছে। গ্রাম থোকে শুরু করে শহর-নগর-বন্দরে আইন, আদালত, কারাগার রয়েছে। ভালো কাজের পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

কিন্তু এতো আইন, আদালত, কারাগার, ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের শাস্তির বিধান থাকার পরেও আমাদের সমাজ দিন দিন এতো অধঃপতন-অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে কেন?

এর কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজব্যবস্থা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল (সাঃ) -এর বাতানো পথ ও পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি মানুষের শান্তি-নিরাপত্তার সাথে বেঁচে থাকার জন্য যত আইন-কানুন বা নিয়ম-নীতির প্রয়োজন তা পরিপূর্ণরূপে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

কী কাজ করলে মানুষ শাস্তির উপযুক্ত হবে, আর কী কাজ করলে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে সবই আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন স্পষ্ঠভাবে ব্যক্ত করে দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব সমাজ বা সভ্যতা স্রষ্টার বিধানের উর্ধ্বে গিয়ে নিজেদের মনগড়া চিন্তা-চেতনার আলোকে বিধান প্রয়োগ করে জীবনযাপন করেÑসেসব সমাজ বা সভ্যতায় দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাট, অরাজকতা। এসব সমাজ অধঃপতন-অবনতির দিকে ধাবিত হয়।

মানুষের তৈরী মনগড়া বিধান দিয়ে দুনিয়াবি সফলতা, উঁচু দালান আর আকাশে গ্রহ-উপগ্রহ নির্মাণ করা গেলেও মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়ন সাধন করে প্রকৃত সফল ও শান্তির সমাজ গঠন করা সম্ভব হয় না। বর্তমান তন্ত্রমন্ত্র এর জলন্ত প্রমান। আর যেসব সমাজ বা সভ্যতা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধানের আলোকে পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে এগুলোই হয়েছে প্রকৃত শান্তির সমাজ বা সভ্যতা। রাসূল (সাঃ) -এর মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে নিয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ এর উজ্জল দৃষ্টান্ত।

আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলগণ আসমানি কিতাবের আলোকে মানুষকে খোদপ্রদত্ত বিধি-বিধান শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সমাজবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপনের পথ ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) -কে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি মানুষকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন।

এই কুরআন জাহান্নামের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে প্রকৃত সফলতার পথ দেখালো। কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আরবের অধঃপতিত জাহেলী সমাজ পরিবর্তন সাধিত হলো, গড়ে উঠলো আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা। জাহেলী যুগের মানুষগুলো সোনার মানুষে পরিণত হলো। তাঁরা হয়ে গেলেন সাহাবায়ে কেরাম।

আল্লাহ তা’লা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন এবং আল-কুরআনে ঘোষণা করলেনÑ ‘তাদের জন্য তাদের মালিকের কাছে পুরস্কার রয়েছেÑ এমন এক জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হবে ঝর্ণাধারা, এরা সেখানে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে, আল্লাহ তা’লা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন, তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হবে, এই জন্য যে তারা তাদের মালিককে ভয় করেছে।” (সূরা বাইয়্যেনাহ-৮)।

আল-কুরআনের সুচনায় আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন মানুষকে সফলতার পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন। সূরায়ে ফাতেহার মধ্যে আল্লাহপাকের বাণীÑ ‘হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

পথভ্রষ্ঠ অভিশপ্তদের পথে পরিচালিত করো না।’ (সূরা ফাতিহা)। সরল সঠিক পথ হচ্ছে সেই পথÑযে পথের পথিক হয়েছেন নবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ, পূণ্যবানগণ। এসব মহান মানুষরা যে পথের পথিক হয়েছেন এ পথটিই হচ্ছে প্রকৃত সফলতার পথ। এ পথের পথিকরাই জান্নাতের অধিবাসী। যে জ্ঞান আহরণ করলে সরল সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যায় সে জ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত সফলতার জ্ঞান।

যেই জ্ঞান অর্জন করলে মহান স্রষ্টার কথা স্মরণ হয়, ঈমান বা বিশ্বাস দৃঢ় হয়, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে আগ্রহ বাড়ে, ইবাদতে একাগ্রতা আনে, সৎকর্মের প্রতি মন ব্যকুল হয়ে থাকে সেই জ্ঞানই আসল জ্ঞান। যার জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি আল্লাহর বিধি-নিষেধের আলোকে পরিচালিত হয়Ñসেই প্রকৃত জ্ঞানী।

যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর বিধি-বিধানের আলোকে জীবনযাপন করে, আল্লাহকে ভয় করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করে, আখেরাতকে বিশ্বাস করে, এসব মহৎ ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল-কোরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথপ্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।’

যে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ স্র্রষ্টাকে চিনতে পারে না। যে জ্ঞান স্রষ্টার বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে নিজেদের খেয়াল-খুশি মত জীবনযাপনে অনুপ্রাণিত করে, পাপিষ্ট শয়তানের প্ররোচনায় জীবনকে গোনাহের কাজে নিমজ্জিত করে, নফসের পুঁজারী হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানকে অগ্রাহ্য করে ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশে মেতে থাকাকে জীবনের উৎকৃষ্ট অর্জন মনে করে। স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ফরজ বিধানাবলী ছেড়ে দিতে থাকে। কেউ কেউ তা অস্বীকার করে ফেলে।

আবার অহেতুক গবেষণার ফলে বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন কিছু মানুষ স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে অসভ্য মন্তব্য করে ঈমানহারা হয়ে যায়। কেউ কেউ শিক্ষিত হয় বটে; কিন্তু সে তার আপন বাবা-মা, অত্মীয়-স্বজনদেরকেও ভালোভাবে চিনে না বা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। তাদেরকে অকথ্য গালিগালাজ করে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। এমনকি কোন কোন পাষণ্ড কুশিক্ষিত সস্তান আপন বাবা-মাকে হত্যা করে ফেলেÑ এমন দুঃসংবাদও মাঝেমধ্যে মিডিয়ার পাওয়া যায়।

মানুষ বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণার দ্বারা সচেতনভাবেই শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবসহ নানরকম সামাজিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মানব সমাজের বিবর্তন হয়েছে বন্যদশা থেকে বর্বরদশা এবং বর্বরদশা থেকে সভ্য দশায়। বিজ্ঞানচর্চা করে মানুষ আবিস্কার করেছে, রোবট, মোবাইলফোন, কমপিউটার, ইন্টারনেট, রেলগাড়ী, উড়োজাহাজ, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নত থেকে উন্নততর যন্ত্রপাতি। তৈরী করেছে যানবাহন, লঞ্চ, স্টীমার, জাহাজ, নৌকা, ইত্যাদি। সর্বশেষ সাগরের তলদেশে সভা-সমাবেশও হচ্ছে।

এসবই মহান আল্লাহ তা’লার নিদর্শন ও অনুগ্রহ। দুর্ভাগ্য ঐসব মানুষের জন্য! যারা আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের আশ্চর্যজনক আবিস্কার করতে পারলেও জ্ঞানের মালিককে চিনতে পারলো না। আকাশ, বাতাস, সাগর, পানি, মাটি, বৃক্ষরাজি ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় বস্তু ও পণ্যসামগ্রী তৈরী করতে পারলেও এগুলোর প্রকৃত মালিককে চিনতে পারলো না। যেই জ্ঞান অর্জন করে স্রষ্টার পরিচয় অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টি হয় না, সেই জ্ঞান কিঞ্চিত দুনিয়াবি সফলতার জ্ঞান হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সফলতার জ্ঞান হতে পারে না।

কালামেপাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রকৃত জ্ঞানীরাই আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করেন।’ এই আয়াতে প্রকৃত জ্ঞানী বলতে সেই সকল ব্যক্তিগণকে বুঝানো হয়েছে, যারা জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহ পাকের পরিচয় লাভ করেছেন এবং আল্লাহ তায়ালার কুদরত, নেয়ামত এবং তার বিধানাবলী সম্পর্কে অবগত ও সচেতন। আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাতের জ্ঞান যখন পূর্ণ হয় তখন মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টি হয়। এর ফলে সে চুরি করে না। দুর্নীতি করে না। মাদক সেবন করে না। খুন, সন্ত্রাস, রাহাজানি করে না। ধর্ষণ, যেনা-ব্যভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয় না। মিথ্যার পুঁজারি হয় না। সত্যাশ্রয়ী হয়। হয় প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী খাঁটি মানুষ।

শেখ সাদি বলেন, বলেন, ‘তুমি সত্যবাদী, জ্ঞানের সাধক এবং পাপকে ঘৃণা কর। তুমি যে কোন কাজই করো না কেন, বিশ্বাস করো, তোমার মর্যাদা অল্প নয়। তুমিই যথার্থ ধার্মিক। তুমিই প্রকৃত সফল।’

মানুষের জীবন খুবই সীমিত সময়ের। দুনিয়া মানুষের চিরস্থায়ী ঠিকানা নয়। মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়। ক্ষমতাধরের ক্ষমতা মুহুর্তেই ধুলিস্যাত হয়ে যাবে যখন মৃত্যু দুয়ারে এসে হাঁক দিবে। রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, সবল-দুর্বল কেউই মৃত্যু থেকে বাঁচবার উপায় নেই। অতিথি পাখির মত পৃথিবীতে এসে পরকালের দিকে চলে যেতে হয়। সীমিত সময়ের জীবনের কর্ম দিয়ে অনন্তকালীন জীবনের সুখ-শান্তি অর্জন করে নিতে হয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতে পুুঁজি অর্জনের জায়গা’।

পরকালীন জীবনের সুখ-শান্তির মার্কেটিং এর জায়গা হচ্ছে দুনিয়া। দুনিয়া নামক মার্কেট থেকে যিনি ঈমানদার হয়ে সৎকর্ম নিয়ে যেতে পারবেন, তিনিই হবেন প্রকৃত সফলকাম। তিনিই হবেন সরল সঠিক পথের যাত্রী।

শিক্ষক: জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ