ফারুক ফেরদৌস।।
আজকে সকালে বাসার কাছে মাতুয়াইল কবরস্থানে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝেই যাই। আমার দাদা-দাদী-ছেলের কবর ওইখানে। বের হওয়ার পথে একটা দৃশ্য দেখে খুব খারাপ লাগলো। একজন নারী কবরস্থানের গেট ধরে শূন্য দৃষ্টিতে ভেতরে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত তার কোনো প্রিয়জনকে সম্প্রতিক সময়ে এখানে সমাহিত করা হয়েছে। তিনি ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। অনুমতি নাই। একটু দূরেই সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘মহিলাদের কবরস্থানে প্রবেশ নিষেধ’।
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার কথা জানি না, আমাদের এদিকে বহু কবরস্থানেই এ রকম সাইনবোর্ড দেখা যায়। নারীদেরকে কবরস্থানে প্রায় অস্পৃশ্য বানিয়ে রাখা হয়েছে, তারা কবরস্থানে ঢুকলেই যেন বিরাট কোনো পাপ হয়ে যাবে, কবিরা গুনাহ হয়ে যাবে।
আমি এই অবস্থাকে দীনের স্পষ্ট তাহরীফ বা বিকৃতি মনে করি।
বাংলাদেশের প্রায় আশি শতাংশ মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী। হানাফী মাযহাবের মাযহাবী মত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী ফকীহদের মত হলো, নারীদের জন্য কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব যেমন পুরুষদের জন্য মুস্তাহাব। (আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু) তাদের দলিলও অত্যন্ত শক্তিশালী। রসূল সা. বলেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করো। এটা তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। -সহিহ মুসলিম
এই হাদীসের নির্দেশে নারী পুরুষের মধ্যে প্রার্থক্য করা হয়নি।
নারীদের সম্পর্কিত বিধি বিধান আয়েশা রা. সবচেয়ে ভালো জানতেন। তারও স্পষ্ট বক্তব্য আছে এ সম্পর্কে। আবু মুলাইকা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আয়েশা রা. কবরস্থান থেকে ফিরলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম হে উম্মুল মুমিনীন! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? তিনি বললেন, আমার ভাই আব্দুর রহমান ইবনে আবী বকরের কবরে গিয়েছিলাম। আমি বললাম, রসূল সা. কি কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেননি? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ নিষেধ করেছিলেন, পরে আবার নির্দেশ দিয়েছেন কবর যিয়ারত করতে। -মুসতাদরাকে হাকেম (ইরাকী ও আলবানী রেওয়ায়াতটিকে সহিহ বলেছেন)
কোনো কোনো হানাফী ফকীহ এবং অন্যান্য মাযহাবের ফকীহরা নারীদের কবর যিয়ারতকে মাকরুহ বলেছেন। কিন্তু এই মতামতের কারণ বা ধরণও বুঝতে হবে। তারা বলেছেন, নারীদের যেহেতু অন্তর নরম, ধৈর্য কম, তাই তারা কবরস্থানে গিয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে, উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করতে পারে, কবর চাপড়ে বা বুক চাপড়ে বিলাপ করতে পারে। এই কারণে তাদের কবর যিয়ারত করতে যাওয়া অপছন্দনীয় বা মাকরুহ।
কেউ যদি নারীদের কবর যিয়ারতকে তাদের মত অনুযায়ী মাকরূহ বা অপছন্দনীয়ও মনে করেন, তবুও কি কবরস্থানে এ রকম সাইনবোর্ড লাগানো সঙ্গত যে, ‘নারীদের কবরস্থানে ঢোকা নিষেধ’? এটা তো হারাম কাজ না। কোনো নারী কি অপছন্দনীয় মেনেও কবর যিয়ারত করতে চাইতে পারে না? অনেক নারীই কি এটা মনে করতে পারে না যে তার আত্মবিশ্বাস আছে যে সে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সুতরাং ওই কারাহাত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না?
পরের কথা হলো, ‘কবর যিয়ারত করা অপছন্দনীয়’ আর ‘কবরস্থানে ঢোকা নিষেধ’ দুইটা বিষয় কি এক হলো? কবর যিয়ারতের ইচ্ছা ছাড়াও তো কবরস্থানে ঢোকা যায় বা ঢোকার প্রয়োজন থাকতে পারে। পাতাকুড়ানি কোনো মেয়ে কি পাতা কুড়ানোর জন্য কবরস্থানে ঢুকতে পারবে না?
এই তাহরীফের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়া দরকার। কেউ যদি মনে করেন, নারীদের কবর যিয়ারত মাকরূহ বা অপছন্দনীয় হওয়াই উচিত, তার দৃষ্টিতেও সাইনবোর্ড লিখে নারীদের কবরস্থানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যেতে পারে না। কেউ কবর যিয়ারত করতে চাইলে তাকে বাঁধা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
এনটি