।।যাকওয়ানুল হক চৌধুরী।।
হৃদয়ের প্রশান্তি থাকা। মানসিক উদারতা সে তো মহা দৌলত। মানুষের মধ্যে অনেক গুন থাকে। সুন্দর গুনবিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্ব সুন্দর মননের অধিকারী। নিজের স্বার্থকে ত্যাগ করে গরীব, ধনী, দরিদ্র, অসহায়, আত্মীয়, অনাত্মীয়, নির্বিশেষে সকলকে নিজের সহোদর ভেবে সর্বোত্তমভাবে তাদের উপকার করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করার যোগ্যতা সবার নাই। পরোপকার; এটা সহজ তাদের জন্য, যারা শুধু নিজের চিন্তা না করে আম জনতার দরদ পোষেন অন্তরের গহিনে।
পরোপকার হলো মানবজাতীর শ্রেষ্ঠত্বের অলংকার । আল্লাহ কুরআনে বলেছেন "তোমরা শ্রেষ্ঠজাতি! মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে।" (আল ইমরান-১১০) রাসুল সা. বলেছেন "মানুষের মধ্যে সেই উত্তম, যে অন্যের উপকার করে " ।
এ জগত সংসারে কেউ ধনী, কেউ গরিব, কেউ আশরাফ, কেউ আতরাফ, কিন্তু সকলেই এক বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টি । তাই আল্লাহর রাজ্যে বসবাস করে মানবজাতির উচিত হলো, ছোটো-বড়ো, ধনী-গরিব- ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য না করা। একে অপরের মাঝে শ্রেনী বা শ্রেষ্ঠত্বের ভেদাভেদ না করা। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মাঝে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব স্থাপন মনুষ্যত্বের পরিচয় । আমাদের মনে রাখতে হবে পরিবারের বাইরেও যে আমাদের একটা পৃথিবী আছে। পরিবার ছাড়াও অন্যান্য মানুষও আপনার প্রয়োজন আছে।
মানুষের পাশে দাঁড়ালে মানুষও আপনার পাশে থাকবে । আর যারা মানুষকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন । হাদিসের ভাষায়"যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দুনিয়ার একটি সমস্যা দূর করবে, আল্লাহ আখেরাতে তার একটা সমস্যা দূর করবেন। যে তার অপর ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন । আল্লাহ তায়ালা বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার অপর ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে"।
ইসলাম ধর্মে বারবার অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । বিপদের সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়াবে; ইসলাম এটাই শিক্ষা দেয় । পবিত্র কুরআন ও রাসুল সা. এর অনেক হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট । অন্যের উপকার করলে আল্লাহ খুশি হন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায় ।
অন্যের উপকার করো, এর মানে অন্যের জন্য প্রাণ দাও, এটা উদ্দেশ্য না । অপরের ছোট ছোট দুঃখগুলোকে তুমি দূর করো । শুধু টাকা দিয়ে সাহায্য করার মানে পরোপকার নয়, নানান ভাবে পরোপকার করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত, পরিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয়, ধর্মীয়, শারীরিক, আর্থিক মানসিক দিক দিয়ে পরোপকার করা যায় । শুধু টাকা নয়, মুখের কথা দিয়েও উপকার করা যায়। যেকোনো ভালো কাজ বিশেষ করে পরোপকার করার সুযোগ পেলে তা করা উচিৎ । রাসুল সা. বলেছেন "কারো সামনে ভালো কাজের সুযোগ এলে, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, কেউ জানে না কখন এ সুযোগ শেষ হয়ে যাবে"।
আর পরোপকার করলে অন্যরা যেমন লাভবান হয়, তেমনি পরোপকারী নিজেও উপকৃত হয়। যে পরোপকার করে তার উপরও এর ইতিবাচক প্রভাব আবর্তিত হয় । আত্নত্যাগের মানসিতা বাড়ে। এ ধরণের সৎকাজ গোটা মানব সমাজকেই প্রভাবিত করে । চাই সে বিধর্মী হোক না কেনো। প্রখ্যাত নও মুসলিম মনীষী মুহাম্মদ আসাদ তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রথম কারণ হিসেবে একটা
ঘটনা উল্লেখ করেন; তিনি তখন ইয়াহুদি ছিলেন । একবার ট্রেনে সফর করার সময় তার পাশের সিটে ছিলো এক আরব যাত্রী । পোশাকে মনে হয় সাধারণ আরব বেদুইন । নাস্তার সময় আরব যাত্রী নিজের সঙ্গে থাকা একমাত্র রুটি দু'টুকরো করে একটুকরো তাকে দিলো। তিনি নিতে কিছুটা দ্বিধা করছিলেন । তখন আরব লোকটি বললেন, তুমিও মুসাফির আমিও মুসাফির, কিছু সময়ের জন্য তুমি আমার প্রতিবেশী। তাহলে আমার দাওয়াত কবুল করছো না কেনো?
বলা বাহুল্য যে, আরব লোকটির এ আচরণ ছিলো একেবারে নিঃস্বার্থ ও ইসলামের আদেশ পালন করার উদ্দেশ্যে, অন্যকে সাহায্য করার জন্য, আল্লাহর আদেশ পালন করা ছাড়া তাঁর আর কোন উদ্দেশ্য ছিলো না । তার এই উপকার ইয়াহুদি যুবকের অন্তরে তা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো। যা শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করার কারণ হয়েছিলো । এটা পরোপকারের উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকবে ।
তাছাড়া পরোপকারের দ্বারা হৃদয়ের বিকাশ ঘটে। পরোপকারকারীর মন ক্রমশ প্রশস্থ, উদার হয় । মানুষ যতই অপরের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অপরের সেবায় আত্ননিয়োগ করে, ততই তার সঙ্কীর্ণতা, স্বার্থপরতা, স্বীয় ভোগ, সুখ, আরাম-আয়েশের চিন্তা দূর হয়ে যায় । সে ধীরে ধীরে শুদ্ধ, শান্ত, পবিত্র হয়ে উঠে । অবশেষে এমন এক সময় আসে, যখন নিজের ভুলে অপরের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে অনুভব হয় ।
যে পরিমান অন্যের দুঃখ দূর করা যায়, যতখানি অন্যকে শান্তি দেওয়া যায় ঠিক ততোখানি শান্তি অনুভব করা যায় নিজের জন্য । তাই, শুধু নিজের মধ্যে নয়, চলুন অন্যের মাঝেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি । আল্লাহ সবাইকে নেক কাজ করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক- শিক্ষক ও সাংবাদিক।
-কেএল