শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইসলাম প্রচারে জুমার বয়ানের ভূমিকা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল আমীন আজহার: জুমার দিন ও জুমার নামাজ অনেক তাৎপর্যময়।এ দিনটি মুসলমানদের সাপ্তাহিক সম্মেলনের দিন।এই দিনকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বের মসজিদে মসজিদে ধনী গরীব ছোট বড় কোটি মানুষের সমাবেশ ঘটে থাকে।

জুমার নামাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো নামাজপূর্ব খুৎবা।যা পড়া ও শুনা উভয়ই ওয়াজিব বা আবশ্যক। হাদিসের মধ্যে জুমার বয়ান ও খুতবা শোনার বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-ইমাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য বের হন তখন ফেরেশতারা জিকির শোনার জন্য হাজির হয়ে থাকেন। (বুখারি, হাদীস নং ৯২৯, মুসলিম,হাদীস নং ৮৫০)

আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় খুৎবা পড়া হলেও অনারব দেশগুলোতে আরবি খুতবার পূর্বে খতিবগন বয়ান বা দাওয়াত হিসেবে তারই ভাবান্তর বা ভাষান্তর করে থাকেন মাতৃভাষায়।যা আগত মুসল্লিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ নসীহা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

বয়ান তথা দাওয়াতের গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত - যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে।সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দিবে।' ( আলে ইমরান- আয়াত নং ১০৪)

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- 'তোমরা একটি বাণী হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও।' ( বুখারী, হাদীস নং ৩৪৬১, তিরমিযি: হাদীস নং ২৬৬৯)

এভাবে দ্বীনের পথে দাওয়াত দানকারীদের অনুপ্রাণিত করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে- যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে এবং নিজেও সৎকাজ করে আর বলে - আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ (হা-মিম সিজদাহ - আয়াত নং ৩৩)

আর খুৎবা পূর্ববর্তী মাতৃভাষায় ইসলাম বয়ানে শরীয়াতে কোন নিষেধাজ্ঞা ও নেই।হযরত আসেম রাযিয়াল্লাহু আনহু আপন পিতা হতে বর্ণনা করেন- 'হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু জুমার দিন খুতবার পূর্বে জুতা খুলে মিম্বরের পাশে দাঁড়াতেন এবং আগত মুসল্লিদেরকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন বাণী শোনাতেন।' (মুসতাদরেকে হাকেম- ১/১৯০)

ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে সমাজ উন্নয়নের শিক্ষা-দীক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজকের ইমাম-খতিবরা নিভু নিভু ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও সমাজে ইসলামের শিক্ষা প্রচার-প্রসারে নবীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।তাদের বক্তব্য সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং আলোর পক্ষে। এমতাবস্থায় অবহেলা কিংবা নিয়ন্ত্রণের নামে তাদের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হবে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত।

জুমার এই বয়ান হতে পারে অপরাধ ও কুসংস্কার মুক্ত ইসলামী আদর্শ সমাজ গড়ার মাধ্যম। হতে পারে সুদ ঘুষ দুর্নীতি যৌতুক প্রথা ইভটিজিং নারী নির্যাতন কুসংস্কার মাদকাসক্তি যুব সমাজের অধঃপতন ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন সকল সমস্যার সমাধান।

প্রয়োজন যোগ্য আলোচক খতিব: ইসলামের আলোকে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে দেশের প্রতিটি জুমা মসজিদে ইলম ও আমলদার সহি আকিদার যোগ্য আলোচক খতিব নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন এবং খতিবদেরও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী বয়ান করা কর্তব্য।খতিবগন মুসল্লিদের সাথে পরামর্শ করে বয়ানের সময় ঠিক করে নেবেন।

সহজ পদ্ধতি হলো, প্রথম আজানের পর বয়ান শুরু করবেন, মুসল্লিরা এসে নীরবতার সাথে বয়ান শুনবেন। খুতবার ১০ মিনিট আগে বয়ান শেষ করে মুসল্লিদের সুন্নত পড়ার সুযোগ দেবেন। এরপর খতিব আজানের পর আরবি ভাষায় দু’টি খুতবা দিয়ে সাথে সাথে নামাজ পড়াবেন। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১২/৩৮৬-৩৯২)

ইমাম-খতিবগণ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। তারা মসজিদে প্রতি জুমায় আগত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বয়ান করবেন। তাদের বয়ানে ইসলামের মূলনীতি, নান্দনিক আদর্শ, কোরআন-হাদিসের বিধান ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে সমকালীন সময় সম্পর্কে ইসলামের দিক-নির্দেশনা।

খতিবগন প্রচলিত নিয়মে আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়ে আবদ্ধ না থেকে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সমাজ সংস্কারে তাঁর সাহাবাদের মসজিদভিত্তিক শিক্ষা দিয়েছিলেন সেই শিক্ষা অনুসরণ করে কুরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জীবন, পরকালের জীবন, জান্নাতের শান্তি, জাহান্নামের শাস্তি, সুদ, ঘুষ, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কুসংস্কার, মাদকাসক্তি, যুবসমাজের অধঃপতন, ইসলাম ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন প্রসঙ্গসহ ইসলামের সার্বিক বিষয় পর্যায়ক্রমে মুসল্লিদের মাঝে তুলে ধরবেন।

এভাবে প্রতি সপ্তাহে সময়ের চাহিদা মাফিক নতুন নতুন বিষয়ে আলোচনা করে সমাজের অসঙ্গতিগুলো মানুষের সামনে স্পষ্ট করে তুলবেন।

কিন্তু অ-চিকিৎস রকমের বাস্তবতা এই যে- অনেকাংশেই ইমাম-খতিবরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার দরুন তাদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাহীনতার কারণে কিছু সংখ্যক বিত্তশালী অহংকারী বদমেজাজি এবং ক্ষমতার গোলাম কমিটির কাছে তাঁদের জবান বন্ধ হয়ে আছে।

অথচ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইমাম-খতিবদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ধর্মীয় হানাহানি বন্ধ, মানবতাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিষয়ে জনমত গঠন, মাদকের কুফল, সন্ত্রাসের ভয়াবহতা, নারী নিগ্রহের অপকারিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, সমাজের স্থিতিশীল উন্নয়ন ধরে রাখা এবং পরিবেশ শান্ত রাখার জন্য তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন ও ব্যয়বহুল ইমাম ও খতিবগন সেসব কর্মসূচি খুব সহজেই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।

এরপরও তারা পঙ্করুদ্ধকণ্ঠে আজও এই কলুষিত সমাজে মানুষের মানুষ হয়ে বাঁচবার জন্য অতীত গৌরবের সুগন্ধি থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছেন।

ইমাম-খতিবরা যেমন সমাজ ও মানুষকে ভালোবেসে নিয়মিত আলো দিয়ে যাচ্ছেন, অনুরুপ তাঁদের জন্যেও সম্মানের সঙ্গে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করলে এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে দেশ এগিয়ে যাবে আরো বহুদূর।

প্রয়োজন বিষয় ভিত্তিক আলোচনা: একটি ইসলামিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের জন্যে যেমন কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি সহ ইসলামের মূলনীতি মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গের বয়ান জরুরি তেমনি আলোচনা সমালোচনা এবং পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজন নান্দনিক উপস্থাপন সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ঔদার্য মনোভাব মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তথ্যবহুল জ্ঞানভাণ্ডার।

আলোচনা হতে হবে ঐতিহাসিক বাস্তবিক এবং সার্বজনীন। আর এজন্য প্রয়োজন বিষয় ভিত্তিক এবং তথ্যবহুল তাত্ত্বিক আলোচনা।কোন একটি বিষয় নির্দিষ্ট করে গভীর অধ্যয়নের পর সুবিন্যস্ত এবং গঠনতান্ত্রিক আলোচনা এবং পর্যালোচনা করার মাধ্যমেই সে বিষয়ে সমাজের অসঙ্গতিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা সম্ভব।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা না করে হরেক রকমের সুরে আজগুবি মিথ্যা এবং বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী বলে নিরক্ষর মানুষদের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে বাহবা এবং মারহাবা লাভ করাটা মিম্বারের সময় নষ্ট বৈ কিছু নয়।

আজগুবি মিথ্যা এবং বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমে মিম্বারের ধ্বনি সমাজের শিক্ষিত মহল এবং বিবেকবান মানুষের কাছে পৌঁছে না। বরং এতে আরো অকল্যাণ সাধিত হয় এবং অসঙ্গতি তৈরি হয়। ফলে মিম্বারমুখী মানুষেরাও মিম্বারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। ইমাম খতিব এবং ওলামা মাশায়েখের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়। যা সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

একটি বয়ান বা বক্তব্য তখনই মানুষ ও সমাজের অকল্যাণ এবং অসঙ্গতি দূর করতে পারে যখন বয়ানকারীর মধ্যে থাকে- তাওহীদি চেতনা, দ্বীনের প্রচার উদ্দীপনা, আত্মবিসর্জন চিন্তা, সত্যপ্রীতি, সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ,অনাথ সত্যের তরে মাতম, দুনিয়া বিমুখতা এবং আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা। আর বয়ানের মধ্যে থাকে- তাওহীদি চেতনা,তত্ত্বজ্ঞান, তাত্ত্বিকতা এবং ধৈর্যের রূপ ও নকশা।

যখন বয়ান হবে ঐতিহাসিক বাস্তবিক সার্বজনীন সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ঔদার্য দৃষ্টিভঙ্গির কেবল তখনই মানুষ এ বয়ানের মাধ্যমে নিজেদের আত্মিক এবং চারিত্রিক জগতের প্রাসাদ নির্মাণ করবে।

লেখক: কবি লেখক ও অনুবাদক

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ