শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মহাকালের চাকাটিকে অতীতের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী মুহাম্মাদুল্লাহ।।

আমার পরম সৌভাগ্য, আমি শেষ নবীর উম্মত হতে পেরেছি। আমি মুসলিম হয়েছি। আমার মন চায়, শুধু মন চায়, শুধুই মন চায় মহাকালের চাকাটিকে অতীতের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে। তাহলে আমি সব কিছু দেখতে পাবো স্বচ্ছ কাঁচের মতো। তাহলে অতীত আর অতীত থাকবে না। সব হয়ে যাবে বাস্তব।

যদি মহাকালের চাকাটিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেতো, যদি এই চাকাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, ঠেলে ঠেলে ১৫ শত বছর পেছনে নিয়ে নেওয়া যেতো, তাহলে তো রাসূলকে দেখতে হতো না সীরাতগ্রন্থে, হাদীসের কিতাবে, সাদা কাগজে কলো অক্ষরে। আমি রাসূলকে দেখতাম আমার দুই নয়নে, চর্মচোক্ষে।

আমি দেখতে পেতাম, আমার পেয়ারা হাবীবের জ্যোতির্ময় সশরীরের উপস্থিতি। ওই তো রাসূল মিম্বরে বসে বসে বয়ান করছেন। আর সাহাবায়ে কিরাম চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছেন।

রাসূল যে ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি ওই ঘরের সামনে। আমি দেখছি, রাসূলের জন্ম হয়েছে। গোটা পৃথিবী আলোকিত হয়ে গেছে। চারদিকে আলোয় আলোয় ভরা। চারপাশ নূরে নূরে ছাওয়া। ওই তো আসমানের তারকারাজি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন আমার তো ভীষণ ভয় হচ্ছে, না জানি এসব আমার ওপরই ধসে পড়ে, ভেঙে পড়ে।

আমি আরও দেখতে পেতাম, রাসূলের আম্মুকে। তিনি বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করছেন। মনে হচ্ছে তিনি খুউবই আশ্চর্য কিছু দেখছেন। তাই তিনি বিস্মিত, একদমই হতভম্ব।

তিনি দেখছেন, হঠাৎ তাঁর ঘর থেকে তীব্র গতিতে আলোর ঝলকানি বের হলো। এবার এই আলো ছুটতে লাগলো। কোন দিকে? সিরিয়ার দিকে। সিরিয়ার বড়ো অট্টালিকা সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো। এখন সিরিয়ায় আলো আর আলো। কিরণ আর কিরণ। এসব দেখে প্রিয় রাসূলের আম্মু অবাক, হতবাক, নির্বাক। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি দেখছি, রাসূলের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পারস্যে শুরু হয়েছে অলৌকিক ঘটনা।

আমার সামনে পারস্যের প্রসাদে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ, নড়া-চড়া করছে। ডানে-বাঁয়ে দুলছে। সব কিছু হেলে পড়ছে।
মনে হচ্ছে সব কিছু ভেঙে পড়বে। সব কিছু ধসে পড়বে। কট কট শব্দ হচ্ছে। মট মট আওয়াজ আসছে। সবাই যারপরনাই আতঙ্কিত।
সবার চেহারায় হতাশার কালিমাখা। চারদিকে রব উঠেছে, দৌড়া দৌড়া।পালা পালা। বাঁচতে হলে দৌড়ে পালা। না পালালে খাইবি ধরা।

কালের ওই মহাচাকায় ভর করে আমি এখন পারস্যে। দাঁড়িয়ে আছি পারস্যের সৌরম্য প্রাসাদের সামনে। ওই তো প্রাসাদের চৌদ্দটি গম্বুজ হুড়মুড় করে ধসে পড়েছে মাটিতে। আমি সে দিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। শুধু তাই নয়, পারস্যে হাজার বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডটি ধপ করে নিভে গেলো। এই পরিস্থিতিতে রাজকীয় সব অনুষ্ঠান বন্ধ হলো।

সবাই হতাশ। আতঙ্কিত। সবাই ভয়ে কাঁপছে। কী হলো তাহলে? এমন তো কখনও হয়নি? ভয়ে তাদের রক্ত জমে গেছে। ধমনীর খুন হিম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে হা করলে প্রাণবায়ু এখনই বের হয়ে আসবে। ওজির-নজির পেরেশান। সম্রাট পেরেশান। সবাই পেরেশান।

হ্যাঁ, ঘুরছে মাহকালের চাকাটি। আমিও আছি তার সঙ্গে। দেখছি সব কিছু, রাসূল যাওয়া-আসা করেন হেরা গুহায়। সেখানে বসে বসে ধ্যান করেন। ইবাদত-বান্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। প্রিয় রাসূলের কাছে এখন আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। তিনি ছুটে যান হেরা গুহায়। গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকেন সেখানে।

সকাল নেই। বিকেল নেই। সন্ধ্যা নেই। দিন নেই। রাত নেই। সপ্তাহ নেই। মাস নেই। কী যে ধ্যান করেন। কী যে ভাবেন।

এখানে বসে বসে ভাবতে তাঁর ভালো লাগে। এখানে বসে বসে ধ্যান করতে মজা লাগে। হেরা গুহায় সময় কাটাতে তাঁর আনন্দ লাগে। বাড়ি এলে, খাদিজার কাছে এলে তাঁকে আবার টানে হেরা গুহা।

আমি সব দেখছি, বাড়িতে রাসূলের মন টেকে না। খাদিজার কাছে পেয়ারা হাবীবের মন বসে না। আমি দেখছি, রাসূলের চোখের চাহনি বলে তিনি কোনো একজনকে খুঁজছেন। তিনি মহান কারও অনুসন্ধানে আছেন। তাই কোনো কিছুতে রাসূলের মন বসে না। আমাকে রাসূলের পবিত্র কলব ডেকে ডেকে বলে, জানো, কেনো তোমার পেয়ারা রাসূলের অন্তরে শান্তি নেই? কেনো তিনি পেরেশান? কেনো তাঁর বুকে আকাশের বিচ্ছিন্ন মেঘের ভেলার মতো হাহাকার ঘুরে বেড়ায়?

কেনো তিনি দুমড়ে যাচ্ছেন? কেনো তিনি মুচড়ে যাচ্ছেন? কী তিনি খুঁজে বেড়ান? কাকে তিনি তালাশ করেন? কেনোই-বা বারবার ছুটে যান হেরা গুহায়? কেনো? কেনো? এসব শুনে আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না।

কোনো উত্তর আমার মনে আসে না। মহাকালের চাকা ঘুরছে। ঘুরছি আমি। আমি দেখছি, রাসূল ধ্যান করেন হেরা গুহায়। দিন নেই, রাত নেই প্রভুকে ডাকেন। একদিনের কথা। রাসূল ধ্যানে মগ্ন। হঠাৎ রাসূল চমকে উঠলেন! ভয় লাগছে তাঁর। ছোট্ট হেরা গুহা। হঠাৎ রকের গতিতে ভেতরে আলো এসে পড়লো। মুহূর্তেই পুরো গুহা আলোয় ভরে গেলো।

আলো আর আলো। সামনে আলো। পেছনে আলো। ডানে আলো। বাঁয়ে আলো। ওপরে আলো। নিচে আলো। আলো আর আলো। মোটকথা, আলোয় ঝলসে উঠেছে চারপাশ। আমি দূর থেকে দেখছি, রাসূল ভয়ে কাঁপছেন। এবার এক ফিরিশতা ভেতরে প্রবেশ করলেন। রাসূলকে সালাম দিলেন।

কে এই লোক? কী তাঁর পরিচয়? রাসূলের চোখে-মুখে বিস্ময়! পুরো চেহারায় ভয়ের কালি মাখা। আমি দেখছি, রাসূল ভয় পাচ্ছেন। কাঁপা কাঁপা চোখে তাকালেন তাঁর দিকে। তাঁকাতেই লোকটি বলে উঠলো, ‘পড়ুন!’

‘আমি পড়তে জানি না, পড়তে পারি না।’ ভয়ে ভয়ে, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিলেন পেয়ারা হাবীব। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
লোকটি আমার পেয়ারা নবীকে আবার আদেশ করলেন, ‘পড়ুন।’ তিনিও একই উত্তর দিলেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’

এসব আমি দেখছি হেরা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মহাকালের চাকাটি ঘুরছে। সঙ্গে আছি আমি। আমার সামনে সব কিছু এখন পরিস্কার। সূর্যের আলোর ন্যায় স্পষ্ট।

আমি দেখছি, লোকটি রাসূলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবার রাসূলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জোরে চাপ দিলেন। এদিকে আমার পেয়ারা হাবীবের কষ্টের শেষ নেই। তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এবারও লোকটির একই কথা, ‘পড়ুন।’ ‘নাহ্, আমি তো পড়তে পারি না।’
এরপর রাসূলকে আল্লাহর নামে পড়তে বললেন। তিনি পড়তে লাগলেন। আমি দেখছি রাসূল দ্রুত ঘরে ফিরে গেলেন। থর থর করে কাঁপছে তাঁর পুরো শরীর।

সব হচ্ছে আমার সামনে। আমি সব দেখছি। রাসূল কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। ভয় একটু দূর হলো। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা রাসূলকে নিয়ে গেলেন ওয়ারাকা ইবনে নাওফালের কাছে। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘তুমি নবুওয়াত পেয়েছো। তুমি নবী হয়েছো। তবে তোমাকে দেশত্যাগ করতে হবে।’

শেষের কথা শুনে রাসূল বিস্মিত হলেন। আমি তো অদূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছি। সব হচ্ছে আমার সামনে। আমি আছি রাসূলের সঙ্গে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

লেখক: শিক্ষক, মাদরাসা উলূমে শরী‘আহ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ