শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যের যুগে মকতবের প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের করণীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

যোবায়ের ইবনে ইউসুফ

মকতব শব্দটি আরবি 'মাকতাব' শব্দের বাংলা রূপ। যার অর্থ, লেখার স্থান, শিক্ষাকেন্দ্র বা বিদ্যালয়। মুসলিম শিশুদের যেখানে ইসলামী প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয় তাকে মকতব বলে। সাধারণত মসজিদ বা মাদরাসা কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এই মকতব। যার তত্ত্বাবধানে থাকেন মসজিদের সম্মানিত ইমাম সাহেবগণ।

প্রভাতে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে শিশুরা দলবেঁধে ছুটে আসে মসজিদ পানে। সুর করে তেলাওয়াত করে কুরআন মজিদ। শিক্ষা লাভ করে বিভিন্ন দোয়া কালিমা মাসআলা-মাসায়েল। অর্জন করে বিশুদ্ধ আকিদা ও ইসলামের মৌলিক জ্ঞান।

ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব: যেকোনো উপকারী বিষয় জ্ঞান অর্জন করতে উৎসাহ দেয় ইসলাম। তবে দীনি শিক্ষা ইসলামে বাধ্যতামূলক। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সূরা আলাক: ০১। নবীজি বলেছেন, 'ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ।' সুনানে ইবনে মাজাহ, ১/৮১।

যারা এই ইলম শিক্ষা করবে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন। এরশাদ হয়েছে, 'তোমাদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম বা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দিবেন। সূরা মুজাদালা: ১১। আরেক হাদীসে নবীজি বলেছেন, 'ইবাদতের ফজিলতের চেয়ে ইলমের ফজিলত অধিক উত্তম।' মুস্তাদরাকে হাকিম, ১/১৭১।

মকতবে দীন শিক্ষার ফজিলত: প্রভাতে মসজিদে দীন শিক্ষার ব্যাপারে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে নবীজি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সকালবেলা বা দ্বিপ্রহরের পূর্বে মসজিদে গমন করে, এবং তার গমনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় কোন ভালো কিছু শিক্ষা করা অথবা শিক্ষা দেওয়া, তবে সেই ব্যক্তি একটি পরিপূর্ণ হজের সওয়াব লাভ করবে।' মুনযিরী, আত তারগীব ১/৫৯। মকতবের গুরুত্ব ও ফজিলত এই হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

মকতব যেভাবে শুরু

আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম মসজিদ ভিত্তিক দীনি শিক্ষার এ পদ্ধতি চালু করেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শিক্ষক ছিলেন তিনি নিজেই। স্থান ছিল মসজিদে নববী।

সাহাবায়ে কেরামদেরকে ইমান-আকিদা, পাক-পবিত্রতা, কুরআন-সুন্নাহ, হালাল-হারাম, নামাজ রোজা ইত্যাদি সকল দীনি বিষয় শিক্ষা দিতেন তিনি মসজিদে নববীতে। তার সাথে কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাহাবীও এই শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলী, হযরত আবু হুরায়রা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম এবং আবুজার গিফারী 'রাদিয়াল্লাহু আনহুম' প্রমুখ সাহাবী উল্লেখযোগ্য। সাড়ে চোদ্দশত বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও এখনো মসজিদে নববীতে 'কুরআনের হালকা' নামে এই মকতব চালু রয়েছে। যা সবার জন্য উন্মুক্ত এবং সেখানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কোন ফি প্রদান করতে হয় না। কালের আবর্তনে মসজিদ ভিত্তিক এই দীনি শিক্ষা পদ্ধতিটা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই এটি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে।

মুসলিম শাসনামলে বাংলাতেও এই মকতব শিক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। ইসলামী ধর্মশাস্ত্রে বিজ্ঞ আলেমগণ মকতবে শিক্ষাদান করতেন। সুলতানি ও মুঘল আমলের শাসকগণ মকতব ও মাদরাসা পরিচালনায় উদার পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন এবং এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য লাখারাজ ভূমি বন্দোবস্ত দিতেন।

এই ভূমি বন্দোবস্তকে বলা হতো মদদ-ই-মাশ। ২০ শতকের আগ পর্যন্ত মকতব মুসলিম বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল। সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতো এই মকতব। এই মকতব মুসলিম সমাজের হাজার বছরের ঐতিহ্য। আবহমানকাল থেকে চলে আসা ইসলাম শিক্ষার এক সহজ, অভিনব ও সুন্দর পদ্ধতি।

মকতবের কার্যাবলি

মকতব আদর্শ বিদ্যাপীঠ: শিক্ষার প্রধান ও প্রথম উদ্দেশ্য হলো, স্রষ্টার পরিচয় এবং মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানা। আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। সর্বোপরি মনুষ্য মননে আখেরাতের চেতনা জাগরুক করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, মেধার বিকাশ, মানসিক ও নৈতিক গুণাবলির উন্নয়ন। যেখানে এই মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া হয় না, তা কখনো আদর্শ বিদ্যাপীঠ হতে পারে না। মকতবে যেহেতু এই উভয় বিষয়ই শিক্ষা দেওয়া হয়, তাই মকতব হলো আদর্শ বিদ্যানিকেতন।

ইসলামের মৌলিক বিষয় শিক্ষাদান: নবীজি বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। ১.এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ সা. আল্লাহর বান্দা ও রসূল। ২.নামায প্রতিষ্ঠা করা ৩.যাকাত প্রদান করা ৪.হজ করা এবং ৫.রমজান মাসে রোজা রাখা। সহীহ বুখারী-০৮।

এই মৌলিক বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই মকতবে ইমান-আকিদা, ইবাদত-বন্দেগী, হালাল-হারাম, সুন্নত ওয়াজিব ফরজ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। পাশাপাশি এগুলো কিভাবে সঠিক নিয়মে বিশুদ্ধভাবে আদায় করা যায় সেটাও হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়া হয়। মাসনুন দোয়া, মাসআলা মাসায়েল প্রভৃতি ইসলামের প্রাথমিক ও বুনিয়াদি ধারনা শিশুরা মকতব থেকেই গ্রহণ করে।

কুরআন হাদীস শিক্ষা: আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'এবং সুস্পষ্টভাবে তুমি কুরআন তেলাওয়াত করো।' সূরা মুজাম্মিল:০৪। নবীজি বলেছেন, 'সর্বোত্তম সে ব্যক্তি, যে কুরআন মাজিদ শিক্ষা করে এবং তা শিক্ষা দেয়।' সহীহ বুখারী-৫০২৭। মকতবে সহীহ শুদ্ধভাবে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হয়।

বিশুদ্ধভাবে কুরআন মজিদ পড়ার জন্য মকতবে শিশুদের সর্বপ্রথম শিক্ষা দেওয়া হয় অক্ষর জ্ঞান ও শুদ্ধ উচ্চারণ। তারপর শব্দ গঠন, বাক্য গঠন এবং আরবি পড়ার নিয়ম কানুন ইত্যাদি। মকতবের পাঠ্যতালিকায় রয়েছে কায়দা, আমপারা, তাজবিদ, পূর্ণাঙ্গ কুরআন নাজেরা এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট সংখ্যক হাদিস মুখস্ত। পড়ালেখার অনুশীলন ও পাঠাভ্যাস শিশুরা মকতব থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

নৈতিকতা শিক্ষা: আদর্শবান মানুষ হওয়ার জন্য সর্বাগ্রে আমাদের চরিত্র সুন্দর ও নিষ্কলুষ করে নিতে হবে। নবীজি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁর চরিত্রের সাক্ষী দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।' সূরা কলাম:০৪। মকতবে শিক্ষা দেওয়া হয় নবীজির উত্তম চরিত্র ও গুনাগুন।

যেমন, সততা, বিনয়-নম্রতা, সহানুভূতিশীলতা ও উত্তম আখলাক। শিক্ষা দেওয়া হয় শিষ্টাচার তথা আদব-কায়দা। ফলে শৈশবেই শিশুরা গড়ে ওঠে আদর্শবান মানুষ রূপে। তারা কটু কথা বলে না, বকাঝকা করেনা, মানুষের সাথে উগ্র আচরণ করে না, বড় ছোট সবাইকে সালাম দেয়, মাতা-পিতা ও গুরুজন পাড়া-প্রতিবেশী সকলের সাথে ভালো আচরণ করে।

পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা: পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কুরআন পাকে এরশাদ হয়েছে, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং যারা বেশি বেশি পাক-পবিত্র থাকে, তাদের ভালোবাসেন।' সূরা বাকারা-২২২। নবীজি বলেছেন, 'পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ।' সহীহ মুসলিম-২২৩। মকতবে শিক্ষা দেওয়া হয় অজু-গোসল, শিক্ষা দেওয়া হয় কিভাবে পাক সাফ থাকতে হবে তা। ফলে শিশুরা নিজেকে, নিজের পোষাক পরিচ্ছেদ, নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি পুরো পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে মনোযোগি ও যত্নবান হয়।

ইসলামি সংস্কৃতির সাথে পরিচয়: ইসলাম আপন বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত। ইসলাম কারো সংস্কৃতি ধার করে চলে না। একমাত্র ইসলামই পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এটা আল্লাহর ঘোষণা। এরশাদ হয়েছে, 'আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন-জীবন ব্যবস্থা কে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ পরিপূর্ণ করে দিলাম।

আর ইসলামকে তোমাদের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করে দিলাম।' সূরা মায়েদা- ০৩। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দীন বা জীবন ব্যবস্থা।' সূরা আলে ইমরান-১৯। যেহেতু ইসলাম‌ই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্বজনীন জীবনদর্শন ও চিরগতিশীল শাশ্বত জীবনব্যবস্থা।

তাই স্বভাবতই ইসলামি অনুশাসনের প্রভাবে ইসলামে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে। ইসলাম অনুমােদিত ও ইসলামি শরিয়ত নির্দেশিত মুসলিম জাতির জীবনপদ্ধতিই হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি। মকতবে শিশুরা উস্তাদের সাহচর্যে থেকে যেমন ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করে, তেমনি তারা ইসলামি সংস্কৃতির সাথেও পরিচিত হয়।

শিশুদের সামাজিকীকরণ: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তবে এই সামাজিকতা কিন্তু মানুষ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না। বরং শিখে নিতে হয়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক কি হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই-ভাই। সূরা হুজুরাত-১০।

মকতবে আসার মাধ্যমে শিশুরা ভ্রাতৃত্ববোধ শেখে। সমাজে সবার সাথে মিলেমিশে কিভাবে চলতে হবে, তা শিখে। কারণ তারা যখন মকতবে আসে তখন পাড়া-প্রতিবেশী বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন আকৃতির মানুষের সাথে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কথাবার্তা ও ওঠাবসা হয়। এর মাধ্যমে তারা সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করার শিক্ষা গ্রহণ করে। অবচেতন মনে শিশুদের সামাজিকতা শেখার পেছনে এভাবে বড় ভূমিকা রাখে এই মকতব।

জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও মেধার বিকাশ: বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ইবনে সিনা তার একটি বইয়ে মকতব বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। সম্মিলিতভাবে মকতবে পড়ার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, 'একজন শিশু ব্যক্তিগতভাবে গৃহশিক্ষকের চেয়ে শ্রেণীকক্ষে অধিক উত্তমভাবে শিক্ষালাভ করতে পারে।'

এর কারণ হিসেবে তিনি ছাত্রদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এবং দলগত আলোচনা ও বিতর্কের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেও তাই। কোন শিশু যখন দেখে তার সহপাঠী তার চেয়ে পড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তার মনে পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। সে তার সহপাঠী কে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লেগে যায়। আর পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। ইরশাদ হয়েছে, 'এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। সুরা মুতাফফিফিন: ২৬।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন, সাহাবিরা নেক কাজে প্রতিযোগিতা করতেন, সে কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একে অপরের ওপর আনন্দিত হতেন এবং একে অপরকে অনুপ্রাণিত করতেন। আর রুহ : ১/২৫১। আর শিশুমনে লেখাপড়া এবং পুণ্যের কাজে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা জরুরি। এতে তার উন্নতি হয় এবং মেধার বিকাশ ঘটে। শিশুমনে একবার পড়ার আগ্রহ ঢুকিয়ে দিতে পারলে, সে স্বাভাবিকভাবে আর অমনোযোগী হতে পারে না। যা শিশুদের জীবন গঠনের জন্য অত্যন্ত জরুরী।

মানবতা ও চেতনাবোধ জাগরণ: আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন 'তোমরা সৎকর্ম এবং খোদাভীতিতে একে অন্যকে সাহায্য করো।' সূরা মায়েদা-০২। মকতবে বিভিন্ন পরিবেশের ছেলেমেয়েরা একত্রে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। তাদেরকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি, সমবেদনা ও সহযােগিতার ব্যাপারে উপদেশ দেওয়া হয়। শিশুদের মন কাদামাটির মতাে। শৈশবে তাদের এ সকল বিষয়ে উপদেশ ও তাগিদ দেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সহানুভূতি, সমবেদনা ও সহযােগিতা করার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সমাজের সকলের সাথে মিলেমিশে চলতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠে।

সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা: মকতব হলো, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে সকল শ্রেণী পেশার লোকদের সন্তানেরা প্রায় বিনামূল্যে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করতে পারে। অন্যান্য শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মকতবের শিক্ষার একটা বড় ব্যবধান হলো, মকতবে সকলের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ আছে। যার ফলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় না। ব্যাপকভাবে অশিক্ষা দূর করতে মকতবের ভূমিকা অপরিসীম।

মকতবের প্রভাব

একটি বিখ্যাত আরবি প্রবাদ আছে, 'শৈশবের শিক্ষা পাথরে অঙ্কিত নকশার ন্যায় স্থায়ী।' মকতব শিশুদের প্রথম বিদ্যালয়। শৈশবে শিশুরা যা শেখে, তা কখনোই ভুলতে পারেনা। এ সময় তাদেরকে যেভাবে গড়ে তোলা হবে, তারা সেভাবেই বেড়ে উঠবে। নবীজি বলেছেন, 'সকল মানব শিশু সহজাত ধর্ম তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর পিতা-মাতা তাকে ইহুদি-খ্রিস্টান অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে।' সহীহ বুখারী-১৩৫৮। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ।

সুতরাং তোমরা সকলে তাঁর নিকট আত্মসমর্পন করো' সূরা হজ- ৩৪। এ আয়াত এবং হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, আমাদের জন্ম ইসলামের উপর, ইসলাম গ্রহণ করা এবং ইসলাম অনুযায়ী চলা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। এ কারণেই মকতবের পাঠ্য বিষয়বস্তু ইসলাম। যেন শিশুদেরকে শৈশব থেকেই মুসলিম বানিয়ে তোলা যায়। মকতবে শিশুদেরকে ইমান-আকিদা, নামাজ রোজা মাসআলা-মাসায়েল ইত্যাদি প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হয়।

শিশুরা ইসলামের ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করে এই মকতব থেকেই। যার ফলে তাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। পরবর্তীতে তারা যদি মাদরাসায় পড়ার সুযোগ নাও পায়, তারপরও ইসলামী বিধি-বিধান মেনে নেওয়ার একটা মানসিকতা তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। যে কারণে ইসলাম বহির্ভূত কিছু করা কিংবা অনৈতিক কোন কাজের সাথে জড়িত হওয়ার সাহস তারা করতে পারে না।

মকতবের প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের করণীয়

প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার। প্রাথমিক শিক্ষাটা প্রত্যেকের জন্য ইসলামিক শিক্ষা হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষাটা মকতব থেকেই শুরু হয়। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামের বিভিন্ন জটিলতা, মকতবের শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন এবং কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে গার্ডিয়ানদের অমনোযোগিতা শিশু কিশোরদের মকতব থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছে।

অন্যদিকে বৈষয়িক শিক্ষায় পাঠের অনুপযোগী বিষয় নির্বাচনের ফলে শিশু মনে অস্থিরতা ও অনৈকিকতার বীজ বপিত হচ্ছে। যা সময়ে মহীরুহ হয়ে ব্যাক্তির পাশাপাশি সমাজকেও কলুষিত করছে।

আজ তরুণ সমাজে নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সততা, সম্মান বোধ, স্নেহ ভালবাসা সমাজ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। সমাজে শিশু কিশোরদের মারামারি কাটাকাটির ব্যপকতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিশোর আপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হাড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য মহামারী আকার ধারণ করছে। যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচিত হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের এই দৌরাত্ম্য এবং এই অধঃপতনের মূল কারণও ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া। সমাজ গবেষকেরা বলছেন, কিশোরদের এরকম বিগড়ে যাওয়ার মূল কারণ, ভুল শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার হাতেখড়ি।

আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম নয়। অথচ চারিদিকে এত অশান্তি, এত অরাজকতা, এত অনৈতিকতা ও এত অস্থিরতা কেন? এর কারণ হলো, এই প্রজন্ম কুরআন-সুন্নাহর ইলম ও ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে শুধু বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। অর্থ উপার্জনকেই তারা একমাত্র জীবনের লক্ষ্য মনে করছে।

ফলে সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় ও অনৈতিক কাজের প্রসার ঘটছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদির ব্যাপকতায় সমাজ‌ ও রাষ্ট্র থেকে শান্তি-শৃঙ্খলা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ যারা এসব কাজে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের প্রায় সবাই জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উচ্চ শিক্ষিত ও মেধাবী হয়েও শুধুমাত্র ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শের অভাবেই তারা এসব অসামাজিক ও অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে।

চরম সত্য হলো, ইসলামী জ্ঞান, খোদাভীতি এবং নববী আদর্শ অনুকরণ ছাড়া মানুষ কখনোই অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অন্যায় অবিচার থেকে বাঁচতে পারে না। আমরা যদি আমাদের জাতিসত্তাকে সৎ, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের জন্য ইসলামী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আর ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক ও মৌলিক ধাপ হলো মসজিদ-মাদরাসা ভিত্তিক এই মকতব শিক্ষাব্যবস্থা। মকতবের শিক্ষা স্বল্প পরিসরে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

এই জন্য এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হলো, গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, শহর-নগর-বন্দর, এককথায় প্রতিটি জনপদে গণহারে মকতব চালু করা। যদি পূর্ব থেকে চালু থাকে, তাহলে তা আরও সক্রিয় করা, বেগবান করা। আর আমাদের শিশু-কিশোরদের প্রাথমিক শিক্ষা যেন মকতব থেকেই শুরু হয়, তা নিশ্চিত করা। তাহলেই আদর্শবান হিসেবে গড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমরা হব আদর্শবান সুখী সমৃদ্ধ শক্তিশালী অনন্য এক জাতি।

লেখক:


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ