যুবায়ের বিন আখতারুজ্জামান।।
ইতিহাস৷ অতীতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনাই একেকটা ইতিহাস৷ যারা জয়ী হয় ইতিহাসে তাদের কথাই লেখা থাকে৷ যারা পরাজিত তাদের পক্ষে সাধারণত ইতিহাস লেখা হয় না৷ আর পরাজিতদের পক্ষ থেকে লেখা ইতিহাসে থাকে প্রচুর বানোয়াট তথ্য৷ বিরোধী দলকে তারা দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি হিসেবে উল্লেখ করে৷ কিন্তু এই ধরনের বানোয়াট ইতিহাসের মধ্যেও কিছু সত্য থাকে৷ বিজ্ঞান ও অগ্রগতির কথা তারা কখনো অস্বীকার করতে পারবে না৷ প্রতিপক্ষের যুদ্ধ কৌশল কেমন ছিল সেটাও বর্ণনা করতে বাধ্য৷
মুসলিমদের যুদ্ধের ইতিহাস:
মধ্যযুগের মুসলিমদের ইউরোপীয় ইতিহাসবিদগণ বর্বর বলে প্রজন্মের সাথে পরিচয় করান৷ কিন্তু মুসলিম ইতিহাসবিদগণ মধ্যযুগে মুসলিমদের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচয় করান৷ কেন এমনটা হয়? পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হয় কেমন? একই সময়তো কোনো জাতির স্বর্ণযুগ ও বর্বরতা হতে পারে না৷ এরূপ প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে কিনা? হ্যাঁ, এরূপ প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে৷ ইতিহাসের ছাত্র নয় বরং ইতিহাস প্রেমিদের কাছে এটা অনেক চিন্তার বিষয়৷ বিশেষ করে মুসলিম ইতিহাস প্রেমীদের তো বটেই৷ আচ্ছা, এখন চিন্তা করে বলুন তো মুসলিমদের বর্বর বলা হয় কোন কোন ক্ষেত্রে? মুসলিমদের বর্বর সব ক্ষেত্রেই বলা হয় না৷ যারা ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন তারা দেখবেন মুসলিমদের বর্বর বলা হয় শুধু মাত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে৷ সামাজিক, পারিবারিক ও বৈজ্ঞানিক জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই মুসলিমদের বর্বর বলা হয় না৷
যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিমদের বর্বর বলার যথেষ্ট কারণও তাদের কাছে আছে৷ আর থাকাটাই স্বাভাবিক৷ কোনো জাতিকে তো যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়াই দোষারোপ করা যায় না৷ চলুন বদরের যুদ্ধ থেকে শুরু করে কয়েকটা যুদ্ধের উদাহরণ দেই৷
১. বদরের যুদ্ধ: ইসলাম সবে মাত্র জন্ম গ্রহণ করছে৷ কিন্তু তার উপরই চেপে বসেছে কাফের সৈন্যরা৷ যুদ্ধ ছাড়া উপায় নেই নইলে চিরজীবনের জন্য ইসলাম ধর্ম বিলীন হয়ে যাবে৷ এমতাবস্থায় মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ৩১৩ জন যোদ্ধা নিয়ে ১০০০ কাফের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী লাভ করলেন৷ এটাকে অমুসলিম ইতিহাসবিদগণ বর্বরতা ছাড়া কি-ইবা বলতে পারে?! তারা তো আর আল্লাহর রহমতে বিশ্বাসী নয়৷
২. খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর যুদ্ধ সমূহ: খালিদ বিন ওয়ালিদের যুদ্ধগুলোকে আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করছি না৷ উনার বীরত্বের দরুন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উপাধি দিয়েছিলেন আল্লাহর তরবারি৷ আমাদের চোখে আল্লাহর তরবারি কি কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে পারে? যদিও তার যুদ্ধের কলা কৌশলগুলো অত্যান্ত নিখুঁত ও সুন্দর ছিল৷ তার সমর কৌশলগুলো বর্তমান সমরবিদদেরকেও তাক লাগিয়ে দেয়৷ তার নেতৃত্বেই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যগুলো পরাজয় বরণ করে৷ মুসলিমরা তরবারির মাথা দেখে জান্নাত আর কাফেররা দেখে মৃত্যু৷ যার কোনো মৃত্যু ভয় নেই তার সাথে পেরে উঠবে কে? পরাজিত ঐতিহাসিকদের নিকট এটা বর্বরতা৷
৩. আইনে যালূতের যুদ্ধ: এখানে দাউদ আ. এর সাথে যালূতের যুদ্ধের কথা বলছি না৷ বরং মোঙ্গলদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধের কথা বলছি৷ যেই মোঙ্গল জাতিরা অতি অল্প সময়ে সারা বিশ্বের শান্তি নষ্ট করে সব দখল করে নেয় ৷ যারা নাকি মানুষের রক্ত পান করত৷ ঐতিহাসিকদের ভাষ্যমতে মোঙ্গলরা বাগদাদে ২০ লক্ষ মুসলিম হত্যা করেছে৷ তারাই আইনে যালূতে এসে মুসলিমদের বর্বরতার স্বীকার হলো৷ এ কেমন কথা? প্রায় সব ঐতিহাসিকদের মতেই মোঙ্গলদের দ্বারা মানবজাতির জন্য কোনো একটি ভাল কাজই হয়নি৷ সেই মোঙ্গলরাই আইনে যালূতে এসে সাইফুদ্দিন কুতুযের নিকট পরাজয় বরণ করে নিল৷ এরপর থেকেই মোঙ্গলদের পরাজয়ের ধ্বনি বাজতে শুরু করল। প্রতিপক্ষের ঐতিহাসিকরা ভালভাবেই বলতে পারে মুসলিমরা মোঙ্গলদের থেকে বেশি বর্বর ছিল বিধায় মোঙ্গলরাও তাদের কাছে পরাজয় বরণ করেছে৷
৪. ভারত আক্রমণ: প্রতিশোধের জের ধরে মুসলিমরা সর্বপ্রথম ভারত আক্রমণ করে৷ রাজা দাহিরের অত্যাচারের জবাব দিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ১৮ বছর বয়সী মুহাম্মদ বিন কাশিম কে সেনাপ্রধান করে ভারতে পাঠান৷ ভারতের একজন ক্ষমতাধর রাজা দাহির যুদ্ধে বিন কাশিমের সাথে পরাজয় বরণ করে৷ এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ বর্বর বলেই উল্লেখ করেন৷
মুসলিমদের বিজ্ঞান ও অগ্রগতির ইতিহাস: মধ্যযুগ হচ্ছে মুসলিমদের অগ্রগতির স্বর্ণযুগ৷ মধ্যযুগে মুসলিমরা সব চেয়ে বেশি অগ্রসর ছিল এক্ষেত্রে কোনো ঐতিহাসিকগণ দ্বিমত পোষণ করে নি৷ চিকিৎসাবিদ্যা, সমরবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন ও গণিত ইত্যাদি কোনো বিষয়ে মুসলিমদের সাথে টক্কর দেওয়ার মত কেউ ছিল না৷ এর আবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ তৎকালীন খ্রিস্টান সম্রাটেরা বৈজ্ঞানিকদের উপর প্রচুর অত্যাচার করত আর বিজ্ঞান চর্চায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করত না৷ এর মূল কারণ বৈজ্ঞানিকদের গবেষণা লব্ধ সূত্রাবলী ও ফর্মূলা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলের সাংঘর্ষিক হত৷ পক্ষান্তরে মুসলিমদের সূত্রাবলী ও ফর্মূলা কুরআনের সাথে মিলে যেত৷ সেই কারণেই মুসলিম সম্রাটেরা বিজ্ঞান চর্চায় বৈজ্ঞানিকদের সহায়তা করত৷ আর খ্রিস্টান সম্রাটেরা বিজ্ঞান চর্চায় বিরোধিতা করত৷
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিমদের যে সকল ক্ষেত্রে বর্বর বলা সেটা মূলত রাগ ও ক্ষোভের কারণে বলা হয়৷ যদি কোনো জাতি জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর হয় সে জাতি কখনও বর্বর হতে পারে না৷
আরো পড়ুন: ইসলামের ইতিহাস পাঠে সাবধানতা জরুরি
এনটি