সাইফুল্লাহ সুবহান।।
জলিল সাহেব একমনে কাজ করছিলেন। ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিতেই বিরক্তির ভাঁজ পড়ল কপালে। বউয়ের ফোন। ঘণ্টাখানেক আগেও তো বাসায়ই ছিলেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে অব্দি বউয়ের মধুঝড়া(!) বাণী শুনেছেন। এমন কী কথা বাকী রয়ে গেছে, এখন আবার ফোন করতে হচ্ছে!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করলেন। বউয়ের ফোন! রিসিভ না করে কী উপায়!
উপায় নিরুপায়ের ধার অবশ্য জলিল সাহেব ধারেন না । তিনি সাহসী পুরুষ। বিশাল দশাসই শরীর। বহুদূর থেকে চোখে পড়ার মতো বিরাট ভুড়ি!বিকট নাক চোখওয়ালা ভীষণ সুন্দর(!) চেহারা! বউকে ভয় তিনি করেন না। তবে খুব সমীহ করে চলেন। নিন্দুকেরা বলে এ চাকরিখান নাকি তার শ্বশুর মশাইয়ের দয়ার দান! যার দানে অন্ন জোটে তার কন্যাকে সমীহ করে চলতে হয় বৈকি!
কপালে থেকে বিরক্তির ভাঁজ মুছে আকর্ণ বিস্তৃত হাঁসি দিয়ে শুরু করলেন কথা। ফোনের ও প্রান্তে থাকা মানষিটিকে সম্বোধন করলেন 'ময়নার মা' বলে। এই সল্প সময়ের বিচ্ছেদে শোকাতুর হয়ে ফোন করার কারণ জানতে আগ্রহী ছাত্রের মতো মিনতি ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। ও প্রান্ত থেকে হয়ত কোন গুরতর উত্তর এলো। আকর্ণ বিস্তৃত হাঁসি ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গেলো। কপাল কুঞ্চিত হতে হতে আগের মতো ভাঁজ পড়া হয়ে গেলো। গোটা চেহারায় ভয় ও বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট। মিনমিনে গলায় বললেন, ''ছুটি কাটিয়ে এসেছি সপ্তাহ পার হয়নি। এখন আবার কী করে ছুটি চাই!" এরপর ও প্রান্ত থেকে হয়ত কোন গরম উত্তপ্ত কথা হয়ে থাকবে। এসি রুমে বসেও জলিল সাহেবের ভাঁজ পড়া কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো এবং তিনি অঝোরে ঘামতে লাগলেন।
ফোন কেটে গেল। মানে ও প্রান্তের মহিয়সি ফোন কেটে দিলেন। ভয় ভাবনা আর বিরক্তি মিশ্রিত আজব চেহারা নিয়ে জলিল সাহেব কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আনলেন। সযত্নে পকেটে রাখলেন। পুরা খাট্টা হওয়া মেজাজে সামনে পড়ে থাকা কাজের দিকে চোখ ফেরালেন। না, এখন আর এ কাজ করার সময় নেই। মনে মনে ছুটির একটা ব্যবস্থা করার তাগাদা অনুভব করলেন!
মিসেস জলিলের বড় ভাই তথা জলিল সাহেবের বড় শ্যালকের শাশুড়ির জন্মদিন। তারা থাকেন উত্তরবঙ্গে। সেখানকার হোমরাচোমরা। আগামী পরশু আয়োজন। আজ সকালে জলিল সাহেব বেরিয়ে পড়লে মিসেস জলিলের কাছে পৌঁছে নিমন্ত্রণটা। নতুন কটুম বাড়ির নিমন্ত্রণ, না গেলে ছোটলোক ভাববে না! যে করেই হোক যেতেই হবে!
জলিল সাহেব পিয়নকে ডেকে বড় সাহেবের রুমে পাঠালেন। স্যার এসেছেন কিনা খোঁজ নিয়ে জানাতে বললেন দ্রুত।
বড় সাহেব মানে বস। জলিল সাহেব তার অধীন কর্মকর্তা (কর্মচারী!)। গত কয়েকদিন বড় সাহেব অফিসে আসেননি। হাসপাতালে ছিলেন। হয়েছে কি, সপ্তাহ তিনেক আগে একদিন রাতের বেলা কী মনে করে একটা ধারি ইঁদুর বড় সাহেবের পা কামড়ে দিয়েছে। কামড়ে দিয়েছে মানে কামড়ে দিয়েছে। কাঠ বা কাগজের মতো কুটিকুটি করেনি। তবে বেশ একটু জখম হয়েছে। যে জখম তা নিয়ে প্রথম দিনই অফিস করা যায় না। একদু'দিন চিকিৎসা ও বিশ্রামে কাটানো যায়। দুএকদিনেই তা সেরে যাবার কথা। কিছুদিন আগে এক লেবারকেও ইঁদুর কামড়ে ছিল।দুদিন পর সেরেও ওঠেছিল সে।
কিন্তু বড় সাহেবের হাসপাতালেই যেতে হলো। যেতে হলো একটা সমস্যার কারণে। তিনি হলেন বড় সাহেব, বিশাল বড় মানুষ। সামন্য ইঁদুরে তাকে কামড়েছে, ইঁদুর কামড়ে তিনি ঘায়েল, এ খবর রাষ্ট্র হলে মানসম্মান কিছু থাকে! বাঘ সিংহ কামড়ালে একটা কথা ছিল! তার সাথে মানানসই হতো। নিদেনপক্ষে বিদেশি কুকুর হলেও চলতো। এরা তো কামড়ালো না। কামড়ালো গিয়ে নেংটি ইঁদুর!
এখন কী করা যায়? ইঁদুরের কথা তো আর বলা যায় না। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন বড় সাহেব। অগ্রিম বুকিং দিয়ে একটা ভিআইপি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন। হাসপাতালের ভিভিআইপি ক্যাবিনি আরামে থাকতে লাগলেন। অফিসে রটিয়ে দিলেন বাড়ির অ্যলসেসিয়ান কুকুরটার বদনাম। সবাই জানল হঠাৎ মাথা বিগড়ে বড় সাহেবকে কামড়ে দিয়েছে কুকুরটা। কুকুরটা অবশ্য এ খবর জানতে পারেনি। জানতে পারলেই যে খুব রাগ করত এমন মনে হয় না। দীর্ঘদিন মানুষের পায়ে পায়ে থেকে এ জাতটার স্বভাব সে ভালোই বুঝেছে। রাগ গোস্বার মর্ম বা মূল্য কোনটাই যে এরা বোঝে না সে বিদ্যা তার হয়েছে।
বড় সাহেবের এ দুর্ঘটনার কথা শুনে সবারই মন খারাপ মন খারাপ ভাব। চোখে মুখে বেদনার আনাগোনা। যেন বড় সাহেবের দুর্ঘটনার দুঃসংবাদে তুমুল গাঢ় কষ্টে সবাই টালমাটাল। অথচ ভেতরে ভেতরে সবাই আনন্দে আটখানা। ছোট থেকে বড় সবার মনেই একটা ঝিলিক দেয়া মুক্তির আনন্দ। তবু মুখে মুখে বড় সাহেবকে দেখতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন অনেকেই। পরের চাকরি! পাপি পেটের ধান্ধা! কত ভনিতাই করা লাগে বেঁচে থাকতে! হায়রে বেঁচে থাকা! শেষতক আকাঙ্ক্ষাই সার। দেখতে কেউ আর যায় না। ভালোবাসা মনে না থাকলে, মুখ দিয়ে আর কতটুকু প্রেম দেখান যায়!
তবে জলিল সাহেব কিন্তু না গিয়ে পারলেন না। তাকে যেতে হলো। তিনি বড় সাহেবের কাছের মানুষ। অসুস্থতার দিনগুলোতে অফিসের দেখা শুনার সার্বিক দায় ভার তার কাঁধেই তুলে দিয়েছেন বড় সাহেব। এত বিরাট সম্মান(!) যিনি দিলেন, তার অসুস্থতায় দেখতে না যাওয়া অকৃতজ্ঞতা বৈ আর কি! জলিল সাহেবরা আর যাই হোক বসদের অকৃতজ্ঞ হননা!
হাসপাতালে এসে হাজির হলেন জলিল সাহেব। এসেই তো অবাক। বড় সাহেব সুস্থ সবল প্রাঞ্জল। কোন রোগ শোক আঁচড় কামড়ের চিহ্নও কোথায় নেই। দিব্যি আরামে আছেন। জলিল সাহেবের অবাক ভাব উপলব্ধি করে বড় সাহেব সব খুলে বললেন। ইঁদুর কি করে কুকুর হলো সে গল্প সবিস্তার শুনালেন। শেষে এই রায রাষ্ট্র হলে তার চাকরির গোড়ায় যে গরম পানি বাহিত হবে সে দিকে ইঙ্গিত করে বিদায় জানালেন। তারপর তিন সপ্তাহ প্রায় কেটে গেল। বড় সাহেব ভীষণ অসুস্থতার মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন! গত রাতে ফোন করে ছিলেন।বললেন এখন তিনি একটু সুস্থ (!) আগামীকাল অফিসে আসবেন।
পিয়ন এসে খবর দিল স্যার তার রুমেই আছেন। কিছুক্ষণ হয় এসেছেন। এতদিন পর স্যার সুস্থ (!) হয়ে ফিরেছেন, জলিল সাহেব প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন। আগে গেলে আগে লাভ। কিন্তু না, লাভ হলো না। গিয়ে দেখেন, স্যার পর্যন্ত যারা আসতে পারে তাদের প্রায় সবাই তার আগে এসে গেছে।
রশীদসাহেব স্যারের মুখমুখি চেয়ারে বসে হাত কচলে দাঁত কেলিয়ে কথা বলছে! জলিল সাহেবের জন্য এ পিত্ত জ্বালা করা দৃশ্য। তার পিত্ত ভীষণ জ্বালা করে ওঠলো।
জলিল সাহেবকে দেখে বড় সাহেব বেশ গদগদ হয়ে ওঠলেন। "আসেন, বসেন" বলে বলে খুব একটা ব্যস্ত-সমস্ত পশ্রয়ের ভাব প্রকাশ করলেন। জলিল সাহেবও একেবারে গলে যাওয়ার ভাব নিয়ে এই প্রশ্রয়ের সুযোগ গ্রহণ করলেন। পাশের চেয়ারে বসতে বসতে হাসি হাসি মুখ করে রশীদ সাহেবকে বললেন, " এখন তো বেশ আগেই চলে এসেছেন দেখছি। স্যার এতদিন হাসপাতালে রইলেন, একদিন তো দেখতে গেলেন না?" রশীদ সাহেব খোঁচাটা বুঝতে পারলেন। তার মুখ কালো হয়ে গেলো। বড় সাহেবের সাথে তার কথবার্তা আর জমল না।
সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলে যে যার মত কাজে চলে গেল। জলিল সাহেব এতদিনের অর্পিত দায়িত্বের হিসাব কিতাব বুঝিয়ে দিতে প্রবৃত্ত হলেন। প্রথমেই সবার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা ও কর্তব্য অবহেলার ঢালাও অভিযোগ করলেন। তিনি যে একাই কেবল খেটে খুন সে বয়ান বিস্তারিত শুনালেন। এমনকি ছুটিতে গিয়েও যে ফোনে ফোনে অফিস করে তিনি কেবল কর্তব্যের খাতিরে আনন্দ মাটি করেছেন সে বিষয়ের উল্লেখ করতেও ছাড়লেন না। তারপর ঢালাও অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ স্বরূপ স্পেসেফিক কিছু কাহিনী শুনানোয় মন দিলেন। টক ঝাল মিষ্টির বর্ধনে মিশ্রনে কাহিনীর পর কাহিনী চলতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর জলিল সাহেব হাসিমুখে বড় সাহেবের কাছ থেকে বেরিয়ে এলেন। ভেতরে ডাক পরল কামরুল হোসেনের। জলিল সাহেবের নিচের পদে তার। তার মা অসুস্থ। মাকে দেখতে যেতে এ সপ্তাহের শেষে দুদিনের ছুটি চেয়ে জলিল সাহেবের কাছে দরখাস্ত দিয়েছিল গতকাল। আজ বড় সাহেব বললেন কোন ছুটি নেই। জলিল সাহেব একটা বিশেষ কাজে কাল থেকে দিন চারেকের ছুটিতে যাবেন। কামরুল হোসেনেকে থাকতে হবে তার পরিবর্তে। বুকের ভেতর একটা তুফান শুরু হলো। একটু হলেই চোখে বৃষ্টি নামবে। কামরুল হোসেন ''জ্বী!ঠিক আছে'' বলে বিদ্ধস্ত চেহারায় বেড়িয়ে এলো।
এনটি