আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ফজর পর প্রায়সময় আব্দুল্লাহ কুরআন অধ্যয়ন শেষে সাহিত্য পড়ে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইমাম গাজালী রহিমাহুল্লাহ লিখিত 'মরণের আগে ও পরে' বইটি গতকাল থেকেই পড়া শুরু করেছে। আজকে আমাদের ক্লাস বন্ধ থাকায় আমিও শুয়ে আছি। পাশেই রুমী তার মোবাইলে ফেবুর টুকরো টুকরো ভিডিও দেখছে। হঠাৎ, রুমী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "নতুন নাস্তিক মেয়েটার ভিডিওটা দেখেছিস?"
-"না, দেখিনি।"
-"এদিকে আয়! দেখ…।"
.
ভিডিও দেখা শেষ হতে না হতেই রুমী বলল, "এই মেয়েটার যুক্তিটা তো ঠিকই মনে হচ্ছে। এইরকম পরিস্থিতিতে আল্লাহ কীভাবে সমাধান করবেন?"
আমি রুমীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, "আব্দুল্লাহ, এদিকে আয় তো।"
আব্দুল্লাহ আমার দিকে তাকিয়ে বই বন্ধ করতে করতে বলল, "কী হয়েছে?"
তার এই এক সমস্যা। পড়ায় বসলে, তখন তার আশেপাশে কেউ খুন হয়ে গেলেও সে বুঝবেনা।
.
আমি কিছু বলতে যাব... অমনি রুমী বলে উঠল, "দেখ ভাই, আমরা জানি যে, জান্নাতে আমাদের মন যা চাইবে, আমরা ঠিক তা-ই পাবো। ঠিক?"
-"হ্যা, তাই। এটাতো কুরআনেরই ঘোষণা।"
-"তাহলে মনে কর, জান্নাতে যাওয়ার পর সেখানে যদি আমি এমন কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই, যাকে দুনিয়াতে আমার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব ছিলো বা যাকে প্রস্তাব দিয়ে বিয়ে করতে পারিনি! আর তখন সেই মেয়েকে অর্থাৎ আমার ক্রাশকে যদি বলা হয়, 'আমাকে বিয়ে করে নিতে'। কিন্তু, তখন যদি সেই মেয়ে বলে যে, 'আমাকে তো তার দুনিয়াতেই পছন্দ হয়নি। বরং, সেই মেয়ের পছন্দ হলো অন্য কেউ। যাকে সে দুনিয়ায় স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু পায়নি। তখন আল্লাহ কি করে আমার ইচ্ছে পূর্ণ করবেন?"
.
আব্দুল্লাহ গলা খাঁকারি দিল। বুঝাই যাচ্ছে, এখন সে ভাষণ শুরু করবে। হলোও তাই। শুরু করলো, "প্রথমত মানুষের 'দেহ' টা আসল মানুষ নয়। দেহ হলো বস্তুসত্তা। যা পশুর দেহ তৈরীর মতো বিভিন্ন উপাদানে সৃষ্টি। দেহের ভালমন্দের কোনো চেতনা নাই। এজন্যই, দেহ ভোগের বেলায় পশুর মতোই বৈধ বা অবৈধের বিবেচনাও করতে পারেনা। আর দেহ সৃষ্টির আগেই আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যাকে কুরআনে 'রুহ' বলা হয়েছে। আর বাংলায় এটাকে বিবেক বলা হয়। অর্থাৎ, 'বিবেক' হলো আসল মানুষ। আর বিবেকই মূলত, দেহের চাহিদার ভালমন্দ বাছাই করে। সুতরাং বলা যায় যে, মানবসত্তা হলো দুটি। প্রথমটি হলো, দেহ বা বস্তুসত্তা। 'দেহ' ক্ষুধা লাগলে, খাবার চায়, ঠাণ্ডা লাগলে, গরম চায়, পিপাসা লাগলে, পানি চায়। এককথায় 'দেহ' সবসময়ই 'ভোগ' করতে চায়। দেহের এসব দাবীকে কুরআন এককথায় 'নফস' বলেছে। যা বাংলায় 'প্রবৃত্তি' বা 'আকাঙ্ক্ষা' বলা হয়। আর অপর সত্তা হলো, নৈতিক সত্তা। যাকে আমরা 'বিবেক' বলি। আর এই দুটি সত্তা দেহের বিভিন্ন চাহিদা তথা দাবী নিয়ে লড়াই করে।" এই পর্যন্ত বলে আব্দুল্লাহ থেমে টেবিল থেকে পানির বোতল হাতে নিলো। এমন সময় রুমী বিরক্ত হয়ে বলল, "আরে ভাই। তুই বিবেক, প্রবৃত্তি এসব কী বলছিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।"
.
শুধু রুমী না; আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা যে আব্দুল্লাহর ঐ লম্বা ভাষণের সাথে জান্নাতের বা রুমীর প্রশ্নের সম্পর্ক কী?
.
"পুরোটা বলতে দে আগে?" আব্দুল্লাহ বললো। আমি আব্দুল্লাহকে সমর্থন করে বললাম, "তুই শেষ কর।"
.
--"দেহের দাবী পূরণের জন্য নফস ও রুহের যে লড়াই হয়, তার ফলাফলের উপর নির্ভর করে, নফস তিন ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত, নফসে আম্মারা অর্থাৎ মন্দ কাজের নির্দেশদাতা নফস। দেহের দাবী পূরণে এই প্রকার নফস সবসময়ই বিবেক তথা রুহের উপর বিজয়ী হয়। এটা মন্দ কাজ করে সবসময়। এক্ষেত্রে বিবেক নফসকে বাধা দিতে অক্ষম। এজন্যই একে মন্দ কাজের হুকুম কর্তা নফস বলা হয়েছে কুরআনে। [১]
.
আর দ্বিতীয় প্রকার হলো- নফসে লাউওয়ামাহ।
এটা এমন নফস, যা দেহের মন্দ দাবীতে বিজয়ী হয় মাঝেমধ্যে। তবে, অতঃপর বিবেক বুঝে যে, কাজটি করা ঠিক হয়নি। তখন সে অনুতপ্ত হয়। অর্থাৎ, এটা ভালো এবং মন্দ সব কাজই করে। এককথায়, এটাকে তিরস্কৃত নফস বলা হয়। [২]
.
কেননা, দেহের দাবীতে মন্দ কাজটা করার পরই নিজেই নিজেকে তিরস্কৃত করে। আর তৃতীয় তথা সর্বশেষ প্রকারের নফস হলো, নফসে মুত্বমাইন্নাহ। এটা হলো সবচেয়ে উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নফস। যেটা সবসময় বিবেকের কাছে পরাজিত হয়। ফলে এই নফস কখনই খারাপ-মন্দ দাবী জানাতে পারেনা। কেননা, এই নফসের উপর বিবেক একশোভাগই বিজয়ী। আর এটাই হবে জান্নাতবাসীদের নফস। [৩]
.
তাই, জান্নাতিরা হবে এমন 'নফস' বা প্রবৃত্তির অধীকারী, যে নফসের দেহ কুরুচি বা বিবেকহীন দাবী কখনোই করবেনা। ফলে কেউ তার দুনিয়ার ক্রাশকে নিজের জন্য চাইবেনা।"
.
এবার আব্দুল্লাহ রুমীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা, তোর হয়তো মনে আছে যে, আমাদের দাখিল রেজাল্ট আউট হওয়ার আগে তোর বাবাকে বলেছিলি যে, পাশ করলে তোকে যেনো সাত হাজার টাকা দিয়ে তোর পছন্দের এনড্রয়েড ফোনটা কিনে দেয়?"
-"হ্যাঁ, মনে আছে।"
-"তারপর তুই পাশও করলি এবং ভালো রেজাল্ট করলি। তখন তোর বাবা খুশি হয়ে তোকে ৭০০০ টাকার না; বরং ১৫ হাজার টাকার এন্ড্রয়েড ফোন দিয়েছিলেন। তাই না?"
-"হ্যা, তাই। তো?" রুমীর বিরক্তিমাখা জবাব।
-"আচ্ছা, তখন কি তুই তোর বাবাকে বলেছিলি, 'আব্বু আমাকে ১৫ হাজার টাকার মোবাইল না দিয়ে, আপনি আমার আগের পছন্দ করা সেই ৭০০০ টাকা দামের মোবাইলটাই কিনে দিন'?"
-"আমি কি পাগল যে, এমনটা বলবো? তখন তো আরো খুশি হয়েছিলাম।" এবার মুচকি হেসে রুমী জবাব দিলো।
.
-"হ্যা ভাই, এটাই হলো মূল কথা। জান্নাতে গেলে তুই সেখানে দুনিয়ার সবচে সুন্দরী কারোর চেয়ে আরো অনেক বেশী সুন্দরী কাউকে যখন পাবি। অর্থাৎ, যারা এতটা সুন্দরী হবে, যাদের গোস্তের ভিতরের হাড্ডি পর্যন্ত দেখা যাবে। তখন খুশিতে তোর দুনিয়ার ক্রাশের কথা একদম ভুলে যাবি। কেননা, কোনো মানুষ যখন তার দাবী বা চাহিদার চেয়েও বেশী কিছু পায়, তখন সে এমনিতেই তার আগের চাহিদার কথা ভুলে যায়। এটাই নিয়ম। আর আল্লাহ নিজেই যখন বলেছেন, 'জান্নাতে আমি এমনসব নিয়ামতরাজি রেখেছি, যেসব কোনোদিন কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান যার সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনেনি, এমনকি, কোনো কলব কখনো কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি।' [৪]
.
অতএব, আমাদের হৃদয়ের কল্পনার চেয়ে বেশি সুন্দর কিছু আমাদের জন্য যখন সেখানে রয়েছে, তখন সেইসব দেখে কি কেউ এই দুনিয়ার সামান্য জরিনা কিংবা ছকিনাকে চাইবে?"এই পর্যন্ত বলে আব্দুল্লাহ থামতেই আমি বললাম, "যতো বড়োই পাগল হোক; কেউই এমনটা চাইবে না।" আমার কথা শুনে আব্দুল্লাহ এবং রুমী একসাথে হাসতে শুরু করলো…। (সংগৃহিত)
-কেএল