মুহাম্মাদ আবু আখতার।। আমাদের সমাজে বিরাট একটা অংশ নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিলেও তাদের কথায় ও কর্মে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। বর্তমান যুগের মুসলমান নামধারী ইসলামবিদেষী মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য এবং ধার্মিক মুসলমানদের প্রতি তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশস্বরুপ গালি হিসেবে কিছু শব্দ বহুল পরিমাণে ব্যবহার করে।
অনেক সাধারণ মুসলমানও মমার্থ না বুঝেই এসব শব্দ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। তাই এসব নিয়ে আলোচনা করা জরুরি যেন অনেকেই সতর্ক হয়। আর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এসব শব্দ যারা ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। প্রতিরোধ এত শক্ত হওয়া উচিত যেন আর কোন কুলাঙ্গার এসব শব্দ ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেয় করার সাহস না পায়।
১) মৌলবাদ ও মৌলবাদীঃ মৌলবাদ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ fundamentalism এবং মৌলবাদী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ fundamentalist. শব্দ দুটো মূলত প্রথমদিকে বিজ্ঞানবিরোধী খ্রিস্টান ধর্ম ও বিজ্ঞান চর্চায় বাঁধা দানকারী গোঁড়া খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এ শব্দ দুটো ইসলাম ও ধার্মিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষীরা ব্যবহার করে ইসলামকে বিজ্ঞানবিরোধী ধর্ম এবং মুসলমানদেরকে বিজ্ঞানবিরোধী হিসেবে অভিহিত করতে চায়।
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের সুরে সুর মিলিয়ে ইসলামকে তারা মৌলবাদ এবং মুসলমানদেকে মৌলবাদী বলে গালি দেয়। ইতিহাস সাক্ষী খ্রিস্টান পাদ্রীদের মতো ধার্মিক মুসলমানরা কখনো সত্যিকার বিজ্ঞান চর্চায় বাঁধা দেয় নি। বরং বিজ্ঞানচর্চায় মুসলমানদেরও অনেক অবদান আছে। আর ইসলামে বিজ্ঞানচর্চায় কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই বরং উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ডারউইনের বিতর্কিত কল্পবিজ্ঞান এবং এ ধরণের অপ্রমাণিত থিওরী ছাড়া বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সত্যের সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের কোন বিরোধও নেই। বরং অনেক সামঞ্জস্য আছে। খ্রিস্টান বিজ্ঞানী ডক্টর মরিচ বুকাইলীর লেখা "বিজ্ঞান, বাইবেল ও কুরআন" বইটি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সুতরাং বিজ্ঞানবিরোধী হিসেবে ইসলামকে মৌলবাদ হিসেবে অভিহিত করা এবং মুসলমানদেরকে মৌলবাদী বলা ইসলামবিদ্বেষীদের জঘন্যতম অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামবিদ্বেষী ছাড়া কোন মুসলমানের মুখে এগুলো শোভা পায় না।
২) জঙ্গিবাদ ও জঙ্গীঃ জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস অর্থে এবং জঙ্গী সন্ত্রাসী অর্থে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত দুটো শব্দ। ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের গুরুত্বপুর্ণ একটি ফরজ বিধান জিহাদের ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ শব্দ দুটো ইসলাম ও ধার্মিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। ইসলামের জিহাদের বিধানকে তারা সন্ত্রাস হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। এজন্য তারা জেএমবি, হিজবুত তাহরীর, হেজবুত তাওহীদ ইত্যাদি কিছু পথভ্রষ্ট দলের জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করে।
অথচ হক্কানী আলেমগণই এসব দলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কঠোর বিরোধী। এছাড়াও তারা আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ইত্যাদি মুসলিম দেশে যেসব নির্যাতিত মুসলমান জালিম ইয়াহুদী, খ্রিস্টান এবং তাদের পা চাটা গোলাম মুসলমান নামধারী ইসলামবিদ্বেষী শাসকদের জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদেরকেও জঙ্গী তথা সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করে।
অথচ জিহাদ ও জঙ্গিবাদ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। আর মুজাহিদ ও জঙ্গী কখনো সমান হতে পারে না। জঙ্গীবাদ তথা সন্ত্রাস দমনের জন্যই ইসলামে জিহাদের বিধান দেয়া হয়েছে। ইসলামে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার কোন বিধান নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা জঘন্য পাপ। তবে যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং মুসলমানদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ইসলাম জিহাদের নির্দেশ দিয়েছে।
এক্ষেত্রেও জিহাদের ব্যাপারে ইসলামের সুন্দর নীতিমালা আছে। জিহাদের সময় এসব নীতি লঙ্ঘন করা বৈধ নয়। এর অন্যতম একটি মূলনীতি হচ্ছে উপযুক্ত কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে কোন নিরীহ বেসামরিক নিরস্ত্র লোক, শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবে না। এমনকি ধর্মযাজকরা যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তাদের নিজ নিজ উপসনালয়ে থাকে তাহলেও তাদেরকে হত্যা করা নিষেধ।
জিহাদ হবে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে। এখন মুসলমানদের কোন পথভ্রষ্ট দল যদি জিহাদের নীতিমালা লঙ্ঘন করে জিহাদের নাম করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে এর দায় সম্পূর্ণ তাদের উপর। ইসলামের জিহাদের বিধান ও সত্যিকার মুজাহিদদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমানে অনেক মুসলমান নামধারী তো জিহাদের আলোচনা যারা করে এবং জিহাদ সম্পর্কিত বই যারা পড়ে তাদেরকেও জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করে। এটা তাদের ইসলামবিদ্বেষ ও মুনাফিকীর জঘন্যতম নমুনা। একমাত্র ইসলামবিদ্বেষী ছাড়া অন্য কেউ জিহাদকে জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাস এবং জিহাদ সম্পর্কিত বই পাঠকারীদেরকে এবং জিহাদের ব্যাপারে আলোচনাকারীকে জঙ্গী তথা সন্ত্রাসী বলতে পারে না।
৩) সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িকঃ সাম্প্রদায়িকতা শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতযুক্ত মনোভাব। আর যাদের মধ্যে এ ধরণের মনোভাব আছে তাদেরকে সাম্প্রাদায়িক বলা হয়। ইসলামবিদ্বেষীরা সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িকের বিকৃত ব্যাখা করে এ শব্দ দুটো ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালি হিসেবে ব্যবহার করে।
কোন ইসলামবিরোধী বিজাতীয় কর্মকান্ডের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক করা হলে এটাকে ইসলামবিদ্বেষীরা সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে অভিহিত করে। আর যারা মুসলমানদেরকে ইসলামবিরোধী বিজাতীয় অপসংস্কৃতি হতে বিরত থাকার উপদেশ দেয় তাদেরকে তারা সাপ্রদায়িক হিসেবে গণ্য করতে চায়। ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে অনেক উদার। তবে এক্ষেত্রে ইসলামের নিজস্ব রূপরেখা আছে।তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে কোন মুসলমানকে বিজাতীয় কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অনুমতি ইসলাম দেয় না। তবে অমুসলিমরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় কাজকর্ম করবে এতে ইসলামে কোন বাঁধা নেই।
ভিন্ন ধর্মের লোকেরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রমুলক কাজকর্ম না করলে তাদের সাথে সদাচরণমূলক আচরণেও ইসলামে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং ইসলাম এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ভিন্ন ধর্মের লোকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে। আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ না করার নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি বিধর্মীদের ধর্মীয় উপাস্যদের গালি দেয়াও মুসলমানদের জন্য নিষেধ। এরপরও যারা ইসলামকে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক শক্তি বলে গালি দেয় তারা যে চরম ইসলামবিদ্বেষী তাতে সন্দেহ নেই।
৪) ফতোয়াবাজি ও ফতোয়াবাজঃ ফতোয়া ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা। শরীয়তের চার দলীল তথা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে কোন ইসলামী বিধানের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের রায়কে সাধারণত ফতোয়া বলা হয়। সাধারণ মুসলমানদের ইসলামের যেসব বিধান সম্পর্কে জানা না থাকে তাদের দায়িত্ব কোন বিজ্ঞ আলেমের কাছে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা।
এরপর তিনি শরীয়তের আলোকে এর যে সমাধান দিবেন সেটাই হচ্ছে ফতোয়া। শরীয়তের বিধিবিধানের ব্যাপারে অভিজ্ঞ নন এমন কোন নামধারী আলেমের ফতোয়া দেয়ার কোন অধিকার নেই। আর এসব অনভিজ্ঞ আলেম কিংবা পথভ্রষ্ট আলেমদের শরীয়তবিরোধী মতামতকে ফতোয়া হিসেবে অভিহিত করাও অন্যায়। এক কথায় বলা যায়, ফতোয়া হচ্ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের দিকনির্দেশনা। জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যে ব্যাপারে ইসলাম আমাদেরকে কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি।
সুতরাং ফতোয়া মুসলমানদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। যারা ইসলামের বিধান পছন্দ করে না তারা ফতোয়ার প্রতি তাদের ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ করতে ইসলামী বিধানকে ফতোয়াবাজি বলে গালি দেয়। আর যেসকল আলেম ফতোয়া তথা ইসলামের বিধান বর্ণনা করেন তাদেরকে ফতোয়াবাজ বলে হেয় করে। ইসলামবিদ্বেষীরা ফতোয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরণের অপপ্রচার চালিয়ে ফতোয়ার বিরুদ্ধে বিষেদাগার করে। বিশেষ করে ইসলামের তিন তালাকের বিধানের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে তারা ফতোয়ার বিরুদ্ধে মানুষের মনে ব্যাপক ঘৃণা ছড়ায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কাজসমুহের মধ্যে তালাক সবচেয়ে জঘন্য। তাই ইসলাম তালাকের সংখ্যা তিন পর্যন্ত সীমিত করে এবং তিন তালাকের ব্যাপারে একটু কঠোরতা আরোপ করে। ইসলামে কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয় তাহলে সেই স্ত্রীকে নতুনভাবে বিয়ে করেও ফিরিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ থাকে না। তবে সে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যদি অন্য স্বামী গ্রহণ করে এবং তার সাথে সহবাসও হয়। এরপর ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় স্বামী যদি ঐ স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে ইদ্দতের পর চাইলে ঐ স্ত্রী প্রথম স্বামীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথম স্বামীর জন্য স্ত্রীকে হালাল করার জন্য দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তালাকের শর্তে চুক্তিবদ্ধ বিয়ে যা আমাদের সমাজে হিল্লা বিয়ে নামে পরিচিত এটা বৈধ নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে হিল্লা বিয়ে যে করে এবং যার জন্য হিল্লা বিয়ে করা হয় উভয়ে অভিশপ্ত।
বিয়ে করে সহবাসের পর তালাক দিবে" এমন চুক্তি করে বিয়ে করা ইসলামে অবৈধ। এমন অবৈধ হিল্লাহ বিয়ে দ্বারা তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে নতুনভাবে বিয়ে করা তিন তালাকদাতা স্বামীর জন্য বৈধ হবে না। কিন্তু ইসলামবিদ্বেষীরা এ ধরণের হিল্লা বিয়েকে ইসলামের তিন তালাকের বিধানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে এবং একে ফতোয়া হিসেবে অভিহিত করে ফতোয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালায়। আসলে ইসলামের তালাকের বিধানের সৌন্দর্য সম্পর্কে তাদের অনেকেই অজ্ঞ। ইসলামে তালাকের সর্বোত্তম উপায় হলো স্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেয়া। আরো বেশি দিতে চাইলে কমপক্ষে দুই তালাক আলাদাভাবে দেয়া।
কেননা এক্ষেত্রে পরবর্তী সময় চাইলে স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ের শর্ত ছাড়াই তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে। কোন স্বামী যদি স্ত্রীকে এক তালাক অথবা দুই তালাক দেয় তাহলে ইদ্দত তথা তিন মাসিক পূর্ণ হওয়ার আগে নতুন করে বিয়ে করা ছাড়াই ঐ স্বামী মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তার সংসারে ফিরিয়ে নিতে পারবে।
আর যদি এক বা দুই তালাক দেয়ার পর ইদ্দত তথা তিন মাসিক পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে পরে চাইলে যেকোন সময় নতুনভাবে বিয়ে পড়িয়ে ফেরত নিতে পারবে। এক্ষেত্রে অন্য স্বামীর সাথে বিয়ে বঁন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কোন শর্ত নেই। আর একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য একটি কাজ। একসঙ্গে তিন তালাক দেয়াকে ওলামায়ে কেরাম বিদআত ও গোনাহের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। আর স্বামী তার স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ ও তার সাথে সহবাসের পর দ্বিতীয় স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর ইদ্দত পৃর্ণ করা ব্যতীত প্রথম স্বামীর সাথে নতুনভাবে বিয়ে করা বৈধ হবে না।
এটা এজন্য করা হয়েছে যেন কোন পুরুষ নারীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। জাহেলী যুগে পুরুষ যতবার ইচ্ছা তালাক দিতো এবং যতবার ইচ্ছা ফিরিয়ে নিতো। তালাকের কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না। ফলে নারীরা পুরুষের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। যখন ইচ্ছে কোলে তুলে নিতো আর যখন ইচ্ছে ছুড়ে ফেলে দিতো। যখন ইচ্ছা তালাক দিবে আবার যখন ইচ্ছা ফেরত নেবে পুরুষের এমন স্বেচ্ছাচারিতার পথ বন্ধ করার জন্যই ইসলাম তিন তালাকের ব্যাপারে এতো কঠোরতা আরোপ করেছে। অনেক নাদান মুসলমানও না বুঝে তিন তালাকের এ বিধানের ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করে।
আর ফতোয়া শুধুমাত্র তালাকের সাথে সম্পৃক্ত নয়। মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সুতরাং ফতোয়া অস্বীকার করার অর্থই হলো ইসলামের বিধানকে অস্বীকার করা। আর ইসলামবিদ্বেষী ছাড়া কোন মুসলমানই ইসলামের বিধান অস্বীকার করতে পারে না।
৫) অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধ/গোঁড়া: ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের বিশ্বাসগুলোকে অন্ধবিশ্বাস এবং একনিষ্ঠ ধার্মিক মুসলমানদেরকে ধর্মান্ধ এবং গোঁড়া বলে গালি দেয়। যে বিশ্বাসের পক্ষে কোন দলীল থাকে না সেটাকেই সাধারণত অন্ধবিশ্বাস বলা হয়। আর যারা ধর্মের নামে দলীলবিহীন অযৌক্তিক বিষয়ে বিশ্বাস করে এবং দলীলবিহীন অযৌক্তিক মতাদর্শ অনুসরণ করে তাদেরকে সাধারণত ধর্মান্ধ বলা হয়। ইসলামবিদ্বেষীদের কাছে ওহী তথা আল্লাহর পক্ষ হতে নবী-রাসুলদের কাছে পাঠানো বাণী ও নির্দেশনা কোন দলীল-প্রমাণ না হলেও মুসলমানদের কাছে এটা শক্তিশালী একটি দলীল।
ইসলামের সব বিশ্বাস ওহী তথা কুরআন হাদীসের আলোকে প্রমাণিত। ইসলামের বিশ্বাস কারো মনগড়া মস্তিস্কপ্রসুত কল্পনা নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত অকাট্য সত্য। মুসলমানদের প্রত্যেকটি বিশ্বাসের পক্ষে ওহী তথা কুরআন হাদীসের অকাট্য দলীল প্রমাণ রয়েছে। আর মুসলমানরা যে মতাদর্শ অনুযায়ী চলে তার খুটি নাটি সব বিষয়েও কুরআন হাদীসে দিকনির্দেশনা রয়েছে।
ইসলামী বিশ্বাস ও মতাদর্শের পক্ষে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবী রাসুলদের এবং আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের উপর নাজিলকৃত ওহীর সাক্ষ্য ও সমর্থন আছে। এরপরও যারা ইসলামকে অন্ধবিশ্বাস ও ধার্মিক মুসলমানদেরকে ধর্মান্ধ বলে গালি দেয় এবং তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে তারা যে চরম ইসলামবিদ্বেষী তাতে কি কোন সন্দেহ আছে?
৬) অবরোধ ও অবরোধবাসিনী: ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের যেসব বিধানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান পর্দার ব্যাপারে। নারীদের পর্দাবিধানকে তাদের অনেকে অবরোধ প্রথা বলে এবং পর্দানেশীন নারীদেরকে অবরোধবাসিনী হিসেবে অভিহিত করে। পর্দাকে নারীস্বাধীনতা ও নারী প্রগতির অন্তরায় হিসেবে তারা গণ্য করে। এমনকি তারা পর্দাকে নারীর অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে করে।
আসলে পর্দা সম্পর্কে এসব কথা ইসলামবিদ্বেষীদের জঘন্য অপপ্রচার। ইসলামে পর্দার অর্থ এই নয় যে তারা সবসময় ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকবে এবং প্রয়োজন সত্ত্বেও ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না। ইসলাম প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নারীদেরকে ঘরের বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তবে শালীনভাবে আপাদমস্তক ঢেকে বের হতে হবে। আর আপাদমস্তক ঢেকে শালীনভাবে রাস্তায় চলার দ্বারা তাদের সম্মান কমে না বরং বাড়ে।
যেসব নারী শরীয়তসম্মত পোশাকে চলাফেরা করে এবং যারা খোলামোলা পোশাকে বেপর্দায় নির্লজ্জভাবে চলাফেরা করে এ দু শ্রেণীর মধ্যে কাদেরকে পুরুষরা মা-বোনের মত সম্মান করে আর কাদেরকে বখাটে কুলাঙ্গাররা বেশি ইভটিজিং করে? এ প্রশ্নের উত্তর কারো অজানা থাকার কথা নয়। আর ইসলাম নারীদেরকে পর্দার সাথে সব ধরণের বৈধ কাজের অনুমতি দিয়েছে। পর্দা নারীর উন্নয়ন ও প্রগতির পথে কোন প্রতিবন্ধক নয়, বরং সহায়ক। যেসব বৈধ কাজের মাধ্যমে নারী উন্নতি ও প্রগতির পথে চলতে পারে যেমন শিক্ষার্জন, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি সব কাজ পর্দার সাথে করার অধিকার তার আছে।
পর্দা নারীদেরকে বখাটে পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে হেফাজত করে। সুতরাং এটাকে অবরোধের সাথে তুলনার কোন সুযোগ নেই। বরং পর্দা হচ্ছে নারীর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। পর্দাকে নারীস্বাধীনতা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক বলা ইসলামবিদ্বেষীদের জঘন্য অপপ্রচার। তারা বিকৃত ব্যাখ্যা করে পর্দার বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায়।
তাদের বিকৃত ব্যাখ্যা মতে নারী স্বাধীনতার অর্থ যদি এমন হয় যে, নারীরা তাদের ইচ্ছামত নির্লজ্জভাবে অর্ধনগ্ন পোশাক পরিধান করে যুবকদের চরিত্র নষ্ট করবে তাহলে এ ধরণের স্বাধীনতা ইসলাম নারীদেরকে দেয় নি। নারী অধিকারের অর্থ যদি হয় যখন যে পুরুষের সাথে ইচ্ছা অবৈধ মেলামেশা করবে তাহলে এমন অধিকার ইসলাম নারীদেরকে দেয় নি।
নারী প্রগতির অর্থ যদি হয় পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে বেগানা নারী পুরুষের একসঙ্গে বেপর্দায় চাকরি করা তাহলে এমন নারী প্রগতি ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম চায় বেগানা পুরুষ ও নারীর কর্মক্ষেত্র আলাদা হোক। আর কোন কারণবশত উভয়ের কর্মক্ষেত্র এক হলেও পরিপূর্ণ পর্দা রক্ষা করা জরুরি। আর পর্দার মধ্যেই নারীর নিরাপত্তা, কল্যাণ ও সম্মান নিহিত।
৭) সংকীর্ণমণা: সংকীর্ণমনা অর্থ নীচু মনের অধিকারী। ইসলামবিদ্বেষীরা অনেক ক্ষেত্রেই ধার্মিক মুসলমানদের এ গালি দিয়ে থাকে। ইসলামপ্রেমিক কেউ যখন গাইরে মাহরাম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পর্দা মেনে চলাফেরা করে কিংবা ছেলে মেয়েদেরকে বেপর্দাভাবে মেলামশা করতে নিষেধ করে তখন আধুনিকমনা ইসলামবিদ্বেষী নামধারী মুসলমানদের অনেকে তাকে ন্যারোমাইন্ড বা সংকীর্ণমনা বলে গালি দেয়। আবার ধার্মিক মুসলমানরা যখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে প্রচলিত অপসাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে তখনও ইসলামবিদ্বেষীরা তাদেরকে এ গালি দিয়ে থাকে।
৮) মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী: দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি পরা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী বলা এক শ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষী কুলাঙ্গারদের জঘন্য স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাদের কথায় মনে হয় ইসলামপন্থী সকলেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল।
অথচ বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। ইসলামপন্থীদের অনেকেই যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তেমনি অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমর্থনও করেছে। তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশও নিয়েছিল। আর স্বাধীনতাবিরোধীদের যে সবাই দাড়ি টুপিওয়ালা ছিল তা নয়। দাড়ি টুপি ছিল না এমন অনেকেও স্বাধীনতাবিরোধী ছিল।
৯) রাজাকার
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী ছিল তাদেরকেই সাধারণত রাজাকার বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে ঢালাওভাবে সব ইসলামপন্থীকে বিশেষভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় ইসলামবিদ্বেষীরা তাদেরকে রাজাকার বলে গালি দেয়। এমনকি তাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে হলেও রাজাকার বলে গালি দিতে তাদের কোন দ্বিধা নেই। এটা ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ প্রকাশের জঘন্যতম নমুনা। ইসলামে একজনের অপরাধের দায় অন্যের কাধে চাপিয়ে দেয়া কঠিন পাপ। ইসলামপন্থীদের কেউ যদি রাজাকারের ভুমিকায় কোন অন্যায় করে থাকে সেটার দায় সম্পূর্ণ তার নিজের উপর। এর মানে এ নয় যে ইসলামপন্থীরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল।
১০) ধর্ম ব্যবসায়ী: প্রকৃত ধর্ম ব্যবসায়ী হলো যারা ধর্মকে দুনিয়ার স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। এ অর্থে মাজার পুজারী ও বিদআতী লোকজন যারা ধর্মকে বিকৃত করে তাদের দুনিয়াবী উপার্জনের মাধ্যম বানায় তারাই আসল ধর্ম ব্যবসায়ী। কিন্তু ইসলামবিদ্বেষীরা এদের ধর্মপ্রাণ মুসলমান বলে মনে করে। পক্ষান্তরে যেসব ইসলামপ্রেমিক আলেম ইসলামবিদ্বেষীদের ধর্মবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করে এবং ধর্মের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ইসলামবিদ্বেষীরা তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বলে গালিগালাজ করে।
লেখক: তরুণ আলেম, লেখক ও গবেষক।
-এটি