সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


স্মৃতির পাতায় আল্লামা আহমদ শফী রহ. পর্ব-৩: মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাউসার লাবীব: মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বহুগুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের কাছে তিনি একজন প্রিয় অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত। বক্তৃতার ময়দানেও তার রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। আর লেখালেখির জগতে তো মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নেই।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ.কে নিয়ে তার স্মৃতিকথা নিয়মিত প্রচার হবে আপনাদের প্রিয় নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলামে। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব-

উভয় হযরতের রহস্যময় চোখের চাহনি আর মুচকি হাসি দেখে আমার বুঝার বাকি ছিল না যে, আমার ব্যাপারেই আলোচনা চলছে। উভয় হযরতের চোখে-মুখে সেদিন যে ঝিলিক দেখলাম তা সত্যই অপূর্ব! আজ ত্রিশ বছর পর এখনো সেই স্নেহময়ী দৃষ্টির কথা আমার মনে পড়লে আত্নার গভীরে প্রশান্তি অনুভব হয়।

আমি হযরতের কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথেই বড় হযরত ছোট হযরতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চাটগাঁইয়্যা ভাষায় যা বললেন তার অর্থ হলো– "ওর খানা স্থগিত করে লাভ কি হলো‽ গতকাল দুপুরে সে তোমার মেহমান হয়েছে আর রাতে আমার মেহমান সুতরাং আজ দুপুর থেকে তার খানা চালু করে দিলে ভাল হবে" এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার খানা চালু হয়ে গেল। আমি উভয় হযরতের আচরণে অভিভূত হলাম।

প্রিয় পাঠক! তোমার মুখে কি হাসি?! আমার চোখে তো পানি! তুমি কি উস্তায আর ছাত্রের সম্পর্ক কতটুকু ছিল, চিন্তা করেছ?!

তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বেশি বেশি লেখার কথা বলতেন কিন্তু তিনি নিজে কেন লিখতেন না, এই প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকার আরো একটি কারণ রয়েছে।

একবার তাঁকে কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- হযরত! হাটহাজারী মাদরাসা মাকবুল একটি মাদরাসা, এই মাদরাসায় লক্ষ লক্ষ টাকা আমদানি ও রপ্তানি, আমার জানামত আয়-ব্যয়ের হিসাবের পর বছরে কিছু টাকা জমাও থাকে। রাত জাগা কঠিন সাধনা ও পরিশ্রমের কাজ। তাহলে গেইটে পাহারাদারীর জন্য ছাত্রদের স্থলে দু'জন দারোয়ান নিয়োগ দিলে ভাল হতো না?!

হাটহাজারী মাদরাসার ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে হযরতের কাছে জিজ্ঞাসা করলে হযরত সুন্দরভাবে উত্তর দিতেন। একবার প্রশ্ন করেছিলাম হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পদ্ধতি কী বা শিক্ষক কিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়?

এরকম আরো অনেক প্রশ্ন কিন্তু দারোয়ানের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে হযরত (রাহ.) খুব রেগে যান এবং আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে সোফা থেকে উঠে বলতে থাকেন "তুই এক্কানা বয়, আঁই আইর তোর প্রশ্নের উত্তর দিউম"।

ই কথা বলে হযরত ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করলেন, আমার অশোভন আচরণের শাস্তি দেবেন তিনি। আমি ঘটনা বুঝতে পেরে হযরতের পিছু-পিছু চললাম এবং দেখতে পেলাম- ওমা! তিনি বেত তালাশ করছেন! এই দৃশ্য দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারি?!

উল্কার বেগে দিলাম এক দৌড়, প্রায় বিশ-পঁচিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছি আর ফোঁপাচ্ছি এবং বিস্মৃত চোখে হযরতের কক্ষের দিকে তাকিয়ে দেখছি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, তিনি বেতহাতে বের হয়েছেন আর ডানে-বামে তাকিয়ে আমাকে খোঁজ করছেন। একপর্যায়ে আমার উপর নযর পড়ার পর তিনি বেত দ্বারা ইশারা করে বললেন "এই! এইক্কা আয়, আযিয়া তোরে মারি ফেলাইয়ুম" এ অবস্থায় আমি কি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি?!

দৌড় দিয়ে একেবারে আড়াল হয়ে গেলাম। আজ থেকে প্রায় ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) বছর আগের কথা, আমার মনে হচ্ছে, এইতো কয়েকদিন আগের ঘটনা। আহ্! জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল!। হযরতের হাতে লাঠি, কালো দাঁড়ি আর বাম হাতে ঘড়ি। যেন টগবগে এক যুবক।

আছরের নামাযের পর "নেযামুল আওকাত" তথা নির্ধারিত সময়সূচি মোতাবেক বিভিন্ন আসাতিযার সাথে সাক্ষাৎ করতাম হযরতের কক্ষেও সাপ্তাহে দু'এক দিন যাওয়া হতো আছরের নামাযের পর। খোলামেলা আলাপ-আলোচনা হতো, একসাথে বসে বাদাম খাওয়া ও আখ চিবানোর কথা এখনো আমার মনে পড়ে।

বেত দেখার পর ভয়ে দু'সাপ্তাহ আর হযরতের কক্ষে যাওয়া হয়নি। দু'সাপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেলে, একদিন আছরের নামাযের পর হযরত আমাকে ডেকে পাঠালেন‌। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে ধক-ধক করছে, কারণ আল্লামা আহমদ শফী কোন ছাত্রকে ডেকে পাঠাবেন আর ঐ ছাত্রের কলিজা শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে যাবে না, তা কল্পনাও করা যায় না। আজ আবার বেতহাতে বসে রয়নি তো!

কপাটের বাহির থেকে দেখলাম হযরতের হাতে বেত নেই, সোফায় বসা হাস্যজ্জ্বল চেহারা। সালাম দিয়ে হযরতের সামনে দোজানো হয়ে বসলাম এবং কৌতূহলী দৃষ্টিতে হযরতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হযরত সোফায় বসে চাটগাঁইয়্যা ভাষায় পাঁচ-সাত মিনিট নছীহত করলেন, যার সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তিনি বললেন- "আমরা আমাদের মুরুব্বিদের অনুকরণ-অনুসরণ করতে চাই, মুরুব্বিদের আদর্শ থেকে একচুল পরিমানও লাইনচ্যুত হতে চাই না। হাটহাজারী মাদরাসা মুরুব্বিদের রেখে যাওয়া আমানত।

ছাত্র দ্বারা গেইটের পাহারাদারী অনেক পুরোনো নিয়ম, আবার এই নিয়মের মধ্যে ছাত্রদের আটটি ফায়দা রয়েছে-
১. রাত জেগে কুতুববীনীর অবিজ্ঞতা অর্জন হয়।
২. সীমান্ত পাহারাদারীর সাওয়াব এ পাহারাদারীতেও অর্জিত হয়।
৩. গেইটে পাহারাদারী করার কারণে আমিত্বের বিসর্জন হয়।
৪. ধনী ও দরিদ্রের ছেলে একসাথে বসে পাহারাদারী করার কারণে এক ধরণের সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়।
৫. গেইটে পাহারাদারীর কারণে বিনয় অর্জিত হয়।
৬. কোন কারণে যদি রাত জেগে থাকা লাগে- কিভাবে রাত জাগ্ৰত থাকতে হয়, তার অনুশীলন হয়।

আরো দু'টি উপকারের কথা তিনি- নম্বর এক, নম্বর দুই, নম্বর তিন এভাবে আট পর্যন্ত গুনে গুনে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে আমার স্মৃতির পাতা থেকে আড়াল হয়ে গেছে, কাগজের পাতায়ও লেখা ছিল, তাও কিভাবে হারিয়ে গেছে।
আরবী, ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, ফার্সি পাঁচ ভাষায় হযরতের বরাবরে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক চিঠি-পত্র আসতো বটে কিন্তু তিনি এসব চিঠির উত্তর দিতেন না,বলা ভাল উত্তর দেয়ার সময় পেতেন না অথবা উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না। বেশি জরুরি হলে কারো মাধ্যমে উত্তরপত্র লেখাতেন, নিজে স্বহস্তে কোন চিঠির উত্তরপত্র লিখেছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই।

প্রিয় পাঠক! আপনাদের কারো কাছে হযরতের স্বহস্তে লিখা কোন চিঠি থাকলে আমি অধমকে জানাবেন, আপনাকে কিছু হাদিয়া দিয়ে মূল কপি নয় শুধু ফটোকপি নেবো এবং হযরতের চিঠির মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবো বি-ইযনিল্লাহ। হযরতের স্বহস্তে লিখিত এমন মূল্যবান চিঠির সংখ্যা যদি বেশি হয় "মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম" নামে ছাপানোর ব্যাবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ।

আমার সাথে হযরতের সম্পর্ক ছিল "বাপ-বেটা"র সম্পর্ক, তবে জীবন সায়াহ্নে এসে অদৃশ্য কিছু কারণে এই সম্পর্কে কিছুটা মান-অভিমান হয়। তারপরও কখনো রাগ কখনো অভিমান কখনো হযরতের স্নেহের সুশীতল ছায়াতলে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় আমার কর্মজীবনের ঊনিশ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। জীবনের শেষ দু'তিন বছর…।
থাক। এসব লেখার চেয়ে না লেখাই ভাল।

অনেক সময় লেখার শক্তি থেকে না লেখার শক্তি প্রাধান্য পায়। এটি আমার মায়ের কথা। মা, বরাবরই এসব নিয়ে আমাকে লিখতে নিষেধ করেছেন। মা কথা প্রসঙ্গে বলতেন - "এসব বলার-লেখার কোন প্রয়োজন নেই।" মায়ের কথা মেনে লিখলাম না। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল লেখক এবং পাঠককে মায়ের কথা শোনার ও মানার তৌফিক দান করুন।

আমার যন্ত্রস্থ বই "হেফাজতের চেপে রাখা ইতিহাস"এ হয়ত এসব বিষয় স্থান পাবে ইনশাআল্লাহ!, কারণ ইতিহাস কাউকেই ছাড় দেয় না, ক্ষমা করে না, কলম নিজ গতিতে চলে, নিজ গতিতে চলবেই।
তবে আমাদের দায়িত্ব হলো যা কিছু সুন্দর তা কুড়িয়ে নেয়া আর যা কিছু অসুন্দর তা এড়িয়ে যাওয়া বা আড়ালে রাখা।

কবির ভাষায়:
গোলাবের খোশবু ছড়িয়ে পড়ুক
তোমার গানের সুরে।
কাঁটার আঘাতে রক্ত ঝরা
লুকিয়ে থাকুক তোমার বুকে।

বাপ-বেটার সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে নয়; বাস্তবে। হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস শেষ করার পর হযরতের পরামর্শে যখন ভারতের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাকর দারুল উলূম দেওবন্দের দিকে ইলমী সফরের ইচ্ছা পোষণ করি- হযরত তখন আমার জন্য দারুল উলূম দেওবন্দের তদানীন্তন মুহতামিম হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রাহ.-এর নিকট স্বহস্তে একটি প্রত্যয়ন পত্র লিখেছিলেন এবং প্রত্যয়ন পত্রের এক পর্যায়ে তিনি লিখেন- "ইয়ে মেরা বেটা হ্যায়" এই বাক্যের মর্মার্থ- হযরত কথা ও কাজে প্রমাণ করেছেন আর আমি কথা ও কাজে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি।

উভয় পক্ষের চেষ্টা একসাথে হলে যা হয় তা হয়েছে। হযরতের ইহসানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমাকে স্বীকার করতেই হবে হযরতের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, এমনকি মৃত্যুর পরও।

"ইয়ে মেরা বেটা হ্যায়"- লেখা প্রত্যয়ন পত্রটি বহন করে আমি ১৯৮৯ সনে ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে চলে যাই। দেওবন্দের মাটির সঙ্গে শুরু থেকেই ছিল আমার হৃদয়ের সম্পর্ক।

বিশ্বাস করুন ভাই! দারুল উলূম দেওবন্দে হযরতের স্বহস্তে লিখিত প্রত্যয়ন পত্রটি আমার ধারণার চাইতেও বেশি কাজে এসেছে, যা আমি কল্পনাও করিনি। কারণ ইতিপূর্বে স্বহস্তে লিখিত কোন প্রত্যয়ন পত্র দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিমের নিকট তিনি লিখেছেন বলে আমার জানা নেই।

এই প্রত্যয়ন পত্র ভর্তি সংক্রান্ত ব্যাপার সহ বিভিন্ন কাজে আমার উপকারে এসেছে এবং দীর্ঘ দু'বছর দারুল উলূম দেওবন্দে থাকাবস্থায় পদে পদে আমার সহায় হয়েছে। কিন্তু আফসোস এই মূল্যবান প্রত্যয়ন পত্রটি এখন আমার কাছে সংরক্ষিত নেই। আমার বড় ছেলে সালমান আশরাফ এর সাথে গল্প করতে গিয়ে একসময় আমাকে লজ্জা পেতে হয়েছে তার কাছে, যখন গল্পের ফাঁকে সে প্রশ্ন করে বসে- "আব্বু! তুমিতো সবকিছু সংরক্ষণ করে রাখ, এই মূল্যবান প্রত্যয়ন পত্রটি সংরক্ষণ করে রাখলেনা কেন?"

আমি তার প্রশ্নের জবাবে বললাম, কিভাবে সংরক্ষণ করব! এটি তো দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান সাহেব (রাহ.)- এর নিকট হাতেহাতে হস্তান্তর করে দিয়েছি, তখন সালমান পুনরায় প্রশ্ন করল- "ফটোকপি করার ব্যাবস্থা কি ছিল না?" আমি তখন একেবারে থ' হয়ে যাই।

ও আল্লাহ! তুমি আমার ছেলে সালমান সহ আমার সকল ছাত্রদেরকে আকাবির-আসলাফের অনুসরণ-অনুকরণ করার তাওফীক দান কর! এবং সকল প্রতিকূলতা ও সকল দূর্যোগ থেকে তাদের হেফাজত কর! আমীন। পাঠকদের মধ্যে যারা আমীন বলবেন তাদেরকেও‍!॥ (চলবে)

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ