কাউসার লাবীব: মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বহুগুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের কাছে তিনি একজন প্রিয় অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত। বক্তৃতার ময়দানেও তার রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। আর লেখালেখির জগতে তো মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নেই।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ.কে নিয়ে তার স্মৃতিকথা নিয়মিত প্রচার হবে আপনাদের প্রিয় নিউজ পোর্টাল আওয়ার ইসলামে। আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব-
১৯৮৭ সন, আমি"হেদায়াহ" জামাতের ছাত্র। হযরত শাইখুল ইসলাম রাহ. হাটহাজারী মাদরাসার নতুন মুহতামিম নিযুক্ত হয়েছেন। মুহতামিম নিযুক্ত হওয়ায় পর ৩/৪ বছর ছিল হযরতের জন্য ক্রান্তিকাল। বাহিরে-ভেতরে সামাল দিতে হযরতের খুবই কষ্ট হচ্ছিল, "হেদায়াহ" জামাতের ছাত্র হলেও হযরতের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক হওয়ার কারণে তা আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। সে এক বিশাল প্রেক্ষাপট, ওই প্রেক্ষাপটে পরে আসছি।
দায়িত্ব পাওয়ার পর হযরত রাহ. একদিন জোহরের নামাজের পর সকল ছাত্র-শিক্ষকদের মসজিদে বাইতুল করীমে বসতে বললেন, বসতে বলার ভঙ্গি দেখে এবং গলার উচ্চকন্ঠ শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছিল। বাইতুল করীম মসজিদ কানায় কানায় ভর্তি, সামনের সারিতে জামেয়ার মুহতারাম আসাতিযায়ে কেরাম।
বিশাল মসজিদে এত ছাত্রের মধ্যে এমন নীরবতা আমার চোখে আর পড়েনি, একটি পিঁপড়া চলার শব্দও নেই। হযরত রাহ. দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত খোতবার পর ১০ থেকে ১২ মিনিট পর্যন্ত হৃদয় বিদারক এক ভাষণ প্রদান করলেন। আজ ৩৩ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও হযরতের সেই ভাষণের প্রত্যেকটি বাক্য আমার কানে এখনো বাজে। তখন আমি মনে মনে ভাবছিলাম- মাইক্রোফোনটি কেউ যদি একটু দূরে সরিয়ে দিত অথবা মাইকের আওয়াজ কেউ যদি কমিয়ে দিত!
আমার জানামত দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর লেখার আগ্রহ তিনি হারিয়ে ফেলার কিছু যুক্তিক কারণও আছে। ঐ কারণ সমূহের মধ্যে একটি কারণ- সেই ে দিন হযরতের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে, বক্তব্যের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো -"আমি যিম্মাদারী চাইনি; আমাকে দেয়া হয়েছে হাজী সাহেব হুযুরকে ( তদানীন্তন সময়ে মজলিসে শুরার প্রধান, জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুহতামিম হাজী ইউনূস সাহেব রাহ.) আমি অনুরোধ করেছিলাম আমাকে যেন এ যিম্মাদারী দেয়া না হয়, তার পরও আমাকে জোরপূর্বক যিম্মাদারী দেয়া হয়েছে। এখন কেউ…"।
না থাক। এসব লেখার বিষয় নয়, অতঃপর হযরত রাহ. উর্দু কবিতার একটি পংক্তি আবৃত্তি করলেন "মাঁই আয়া নেহি হোঁ বোলায়া গায়া হোঁ; আমি নিজে আসিনি আমাকে আনা হয়েছে, আমি চাইনি আমাকে দেয়া হয়েছে"। সারগর্ব ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন- "১০/১২ টি কিতাবের পাণ্ডুলিপি আমার রুমে পড়ে আছে, আমি কাজ করার সুযোগ ও সময় পাচ্ছি না, লিখতে বসলে কলম দিয়ে লেখা আসে না, যিম্মাদারীর কারণে আমার অনেক ক্ষতি হচ্ছে…"।
তিনি কেন লিখতেন না আমি কৌতূহলী হয়ে অনেকবার প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, শেষতক প্রশ্ন করা হয়নি, বিষয়টি জানাও যায়নি। কারণ হযরতের সাথে আমার সম্পর্ক শুধু বাপ- বেটার সম্পর্ক নয়, উস্তায ও শাগরিদের সম্পর্ক এবং পীর ও মুরিদের সম্পর্ক। পীর- মুরীদী, তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক শাস্ত্রে কোন প্রশ্ন নেই। পীর সাহেব যা নির্দেশ দেন মুরীদকে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেই হয় (যদি নির্দেশ জায়েয্ কাজের হয়)।
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ
হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই পর্যন্ত একটি সিস্টেম চালু আছে- হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্রদের মাদরাসার গেইটে রাতে দারোয়ানী বা পাহারাদারী করতে হয়। 'শবে আউয়াল', 'শবে আখের' ছাত্রদের মধ্যে প্রসিদ্ধ। শবে আউয়াল অর্থ রাতের প্রথমাংশ আর শবে আখের অর্থ রাতের শেষাংশ।
তবে ফার্সি ভাষার তারকীব অনুযায়ী শবে আউয়াল আর শবে আখের এই দুই বাক্যের অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আমার মতে আউয়ালে শব্ এবং আখেরে শব্ হওয়া চাই। যাক ফার্সি ভাষা নিয়ে এত দেমাগ খরাসির প্রয়োজন নেই। বলছিলাম রাত্রের প্রথমাংশে কতৃপক্ষের নির্দেশ ও তালিকা অনুযায়ী কিছু ছাত্রের পাহারাদারী করতে হয়, আর কিছু ছাত্রের রাতের শেষাংশে পাহারাদারী করতে হয় ।
বর্তমান হাটহাজারী মাদরাসায় আমার মাত্র দু'জন উস্তায বেঁচে আছেন, এক. হযরত মাওলানা মুফতী নূর আহমদ হাফি., দুই. হযরত মাওলানা শায়েখ আহমদ হাফি., বাকি সকল আসাতিযায়ে কেরাম কবরের বাসিন্দা। আমি দু'আ করি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আমার যেসকল উস্তায বেঁচে আছেন সুখের বৃক্ষ থেকে তাদের উপর যেন অসংখ্য ফুল ঝরে আর যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, রাতের আকাশ থেকে তাদের মারক্বাদ মোবারকে যেন শিশির ঝরে, করুণার শিশির।
আমি যখন হাটহাজারী মাদরাসায় মিশকাত জামাতের ছাত্র ছিলাম, পাহারাদারীর এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এক রাতের প্রথমাংশে আমার উপরও অর্পিত হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে যেন এ দায়িত্বের কথা আমাকে জানানো হয়নি বা আমি জানতাম না। পাহারাদারী না করার কারণে মাদরাসার কানুন অনুযায়ী বোডিং থেকে তিন দিনের খানা স্থগিত করা হয়েছিল।
আমি আসামির কাঠগড়ায়। সে এক বিরল ঘটনা, এ ঘটনা থেকে তালিবে ইলমদের অনেক কিছু বুঝার ও শিখার রয়েছে। খানা স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর আমি খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম- কোথায় কীভাবে
للّهم أطعم من أطعمني و اسق من سقاني…
এর আমল করা যায়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্রথম দিন দুপুর বেলা খানা খাওয়ার নিয়তে সময়মত আমার একাদিক কিতাবের উস্তায উস্তাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা শায়খ আহমদ সাহেব (হাফি.)- (বর্তমান শাইখুল হাদীছ দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী) এর কক্ষে প্রবেশ করলাম প্রশ্ন-উত্তরের পর তিনি খানার থালা এগিয়ে দিলেন এবং হুযুরের দস্তারখানে খানা খাওয়ার সুযোগ করে দিলেন।
উল্লেখ্য তিনি তখন নাযেমে মতবখ তথা বোডিং সুপারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দুপুরের খানা এভাবেই শেষ হলো। রাতের খানা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আমার প্রাণপ্রিয় উস্তায ও আধ্যাত্মিক রাহবার শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী (রাহ.)- এর কক্ষে তাঁর দস্তরখানেই কৌশলে সেরে ফেললাম। স্থগিত তিন দিনের মধ্যে একদিন এভাবে কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন সকাল ৯ টায় হযরত শাইখুল ইসলাম (রাহ.)- এর কক্ষে প্রবেশ করে দেখি- হযরত মাওলানা শায়েখ আহমদ সাহেব (হাফি.) এবং আল্লামা আহমদ শফী (রাহ.) একান্তে বসে আলাপচারিতায় আছেন এবং মৃদু মৃদু হাসছেন। সেই হাসির মধ্যেই আমার প্রতি ছিল তাঁদের স্নেহের স্নিগ্ধতা। (চলবে)
-কেএল