মূল: মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি
তরজমা: মওলবি আশরাফ
কোরআনি শিক্ষা এমন— কেবলমাত্র কোরআনের প্রভাবে আরবের মূর্তিপূজক জাহিল মরুবাসীরা অল্পকয়েক বছরে সারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহওয়ালা, সবচেয়ে বেশি সভ্য, সবচেয়ে বেশি সংস্কৃতিবান ও সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিতে রূপ নেন। এই কোরআনি শিক্ষা এতদ্রুত তাদের মধ্যে ‘কামেল’ আখলাক তৈরি করে যে, একদিকে তারা যেমন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর সাম্রাজ্যগুলোকে তাদের সামনে মাথানত করতে বাধ্য করে, অন্যদিকে তারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে সর্বোচ্চ মর্যাদা হাসিল করেন। পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে কাদেসিয়ার ময়দানে যুদ্ধকালে এক পারসিক জেনারেল বলেছিলেন, ‘আমরা এমন লোকদের সাথে মোকাবেলায় পারব না, যারা রাতে ফেরেশতা থাকেন আর দিনে হয়ে যান বাঘ’।
এই কোরআনি শিক্ষা তখনকার আরবদের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটায়, তার সামান্য আঁচ পাওয়া যায় শাহেনশাহ ইয়াজিদগির্দের জবানিতে— কবি ফেরদৌসি যা এভাবে বর্ণনা করেন
زشیر شتر و سوسمار
عرب را بجاۓ رسیداست کار
کہ تخت کیاں را کنند آرزو
تفو بر تو اے چرخ گردوں تفو
‘উটের দুধ আর গুইসাপ খেকো আরবরা এখন সিংহাসন খুঁজছে? লজ্জা লজ্জা, কী গজব কাণ্ড ঘটাইলি তুই ওরে আসমান!’
দুনিয়াতে তারাই রাজত্ব করে যাদের চারিত্রিক বিকাশ ঘটে। কোরআনি শিক্ষা ওই উট চড়ানো আরববাসীকে এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অলঙ্কৃত করেছে যে, পারস্য সাম্রাজ্য কী ছাই, প্রায় গোটা দুনিয়া তারা কব্জা করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার বিধিবিধান বাস্তবায়নে সময় ও ধনসম্পদ তো বটেই, এমনকি হাসিমুখে জীবন দিয়ে দেওয়াকে পর্যন্ত তারা একমাত্র সফলতা জ্ঞান করেছেন। উদাহরণ হিশেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি।
হজরত আনাস রা. বলেন, সত্তরজন সওয়ারির সাথে আমার মামাকে আল্লাহর রসুল সা. হারাম শরিফের উদ্দেশে পাঠান। তাদের দল কাছাকাছি পৌঁছে গেলে মামা বলেন, ‘আমি সবার আগে যাই, যদি তারা আমাকে নিরাপত্তা দেয়, তখন আমি তাদের আল্লাহর রসুলের পয়গাম দিব, তাহলে তো সব ঠিকঠাক, কিন্তু যদি এমন না ঘটে, তোমরা আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে।’
তারপর তিনি যখন শহরে পৌঁছেন, লোকেরা তাকে পুরাপুরি নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু যখন আল্লাহর রসুলের পয়গাম তাদের সামনে হাজির করেন, তখন ওই লোকেরা নিজেদের একজনকে ইশারা দিলে সে একটি বর্শা মেরে মামার বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলে। ওই সময় মামা সজোরে বলেন, ‘কা’বার রবের কসম, আমি তো সফল।’
আরেকটি ঘটনা বলি, হজরত খুবায়ব (রা)এর ঘটনা আলোচনা করতে গিয়ে বুখারি ও আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে— খুবায়বকে যখন হারিস ইবন আমের ইবন নওফেলের ছেলে শহীদ করে, তখন তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করছিলেন,
وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا
عَلَى أي شِقِّ كَانَ لله مَصْرَعِي
وَذَلِكَ في ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ
يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْو مُمَزَّعِ
‘আমাকে কতল করা হচ্ছে আর আমি মুসলমান, কোনো ভয় নেই, কারণ আল্লাহর পথেই আমার রক্ত ঝরবে। আর যিনি আল্লাহর পথের মুসাফির, আল্লাহ চাইলে তার টুকরো টুকরো শরীরও আরও চমকদার (বরকতময়) করে জোড়া লাগাতে পারবেন।’
তখনকার বুদ্ধিমান লোকেরা বাহ্যিক ফলাফলের আড়ালে দেখতে পেয়েছিলেন যে, এই কোরআনি শিক্ষা মানুষের মধ্যে সুনিশ্চিতভাবে এমন কামেল আখলাক তৈরি করে— কেউ অসভ্য কিংবা জাহিল হলেও এর প্রভাব তাকে খুব দ্রুতই দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম ও শক্ত মনোবলের মানুষে পরিবর্তন করে ফেলে।
হেরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ঘটনা:
ষষ্ঠ হিজরিতে যখন চিঠির মাধ্যমে আল্লাহর রসুল (স) রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ঘটনাক্রমে আবু সুফিয়ান তখন রোমে (বাইজেন্টাইন) ছিলেন। হেরাক্লিয়াস তাকে ডেকে আল্লাহর রসুল (স) সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। আবু সুফিয়ানের উত্তর শুনে হেরাক্লিয়াস বলে ওঠেন—
ان يك ما تقول حقا فانه نبي وليبلغن ملكه ما تحت قدمي.
‘তুমি যা বলছ সব যদি সত্য হয়, নিশ্চিত তিনি একজন নবী, এবং তাঁর কর্তৃত্ব আমার পায়ের তলার মাটি পর্যন্ত চলে আসবে।’
হেরাক্লিয়াসের এই মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। এবং সেই শিক্ষা এখনো কোরআনে মওজুদ। কিন্তু আমরা তো বলার মতো পরিস্থিতিতে নাই। সারা দুনিয়ায় মুসলমান আজ চূড়ান্ত অসহায়, আর একেবারেই শক্তিহীন। তাদের আখলাক ও রুহানি শক্তি আরও বেশি পতনোন্মুখ। এ খুবই পেরেশানি ও দুঃখের কথা যে, আমাদের এই সঙ্গীন অবস্থা দেখে লোকজন একথা বলার সুযোগ পাচ্ছে— ‘ধর্মীয় শিক্ষার কারণে তাদের এই অবস্থা।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো এর উল্টো, কারণ কাজ শিক্ষারই ফলাফল। এই বিষয়ে এই শতকের এক মিশরীয় স্কলার বলেন,
‘শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেননা পরিবর্তনের অর্থ কাজেকর্মে পরিবর্তন, আর কাজেকর্মে পরিবর্তন শিক্ষা ও চারিত্রিক বিকাশের ফলে সম্ভব। যখন একজন একজন করে প্রত্যেকেই সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিল, উপকারী ও ক্ষতিকারক, এবং সভ্যতা ও অসভ্যতার জ্ঞান যথাযথভাবে লাভ করবে, আখলাক-চরিত্রকে উত্তম করবে, তখনই কেবল ব্যক্তির সমষ্টি একটি গোটা জাতিকে উন্নত করতে সক্ষম হবে। তাদের ধর্ম ও সভ্যতা উৎকর্ষতা লাভ করবে।
আমাদের শিক্ষানীতি, গত কয়েকশ বছর ধরে যে-নীতি আমরা অনুসরণ করে যাচ্ছি, যদি উপরোক্ত প্রকারের মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হতো, তাহলে মুসলিম জাতি যে গুহায় কয়েকশ বছর ধরে আটকে আছে তার সামনের ভারী পথর সরিয়ে মুক্তির আস্বাদ নিতে পারত। আমরা তখন এই জিল্লতির জীবন থেকে প্রগতিশীল জীবনশৈলীর দিকে যেতে পারতাম। অথচ আমরা এখন প্যারালাইসিস বা কোমায় পড়া রোগীর মতন এক জায়গায় থির হয়ে আছি।’
হ্যাঁ আমরা অসুস্থ, কিন্তু কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন—
وَ نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ
‘আর আমি কোরআনে নাজিল করেছি মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮২) তো আমরা সুস্থ কেন হচ্ছি না? আর কোরআন যখন আছে, আমরা অসুস্থই-বা কেন?
আমাদের ধর্মগ্রন্থ তো এমন যে, বিধর্মীরাও পড়ে এখান থেকে ফায়দা নিতে পারে। যে-কেউ এই কোরআনের প্রভাব গ্রহণ করবে সে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সংস্কৃতিবান, সবচেয়ে সভ্য-ভব্য, সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে শক্তিশালী। খোদ আল্লাহও কোরআনে তা-ই বলেছেন। এমনকি এই সত্য প্রমাণিত হতেও আমরা দেখেছি। সেই একই কোরআনই তো এখনও আমরা পড়ি, তাহলে কেন আমরা অসুস্থ, কেন আমরা পিছিয়ে পড়া, কেন আমরা এত কমজোর?
এ খুবই দুশ্চিন্তা উদ্রেককারী কথা। এই রহস্য আমাদের উদঘাটন করতেই হবে, এ তো আমাদের জীবন-মরণের মামলা। শুধু তা-ই নয়, এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের জাতির প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীর দিনরাত চিন্তা-ফিকির করা জরুরি, তাহলে সঠিকতর কোনো ফলাফলে আমরা পৌঁছুতে পারব। আমি আমার বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী এই প্রশ্ন নিয়ে খুব গভীর চিন্তা করেছি, যে ফলাফল আমার মস্তিষ্কে এসেছে তা-ই আপনাদের সামনে পেশ করছি।
রোগী আছে ওষুধও আছে, কিন্তু অসুস্থতা যাচ্ছে না— এর কারণ কেবল এই-ই হতে পারে যে, হয় ওষুধ ঠিকঠাক মতো সেবন করা হচ্ছে না, নাহয় সেবন করা হচ্ছে ভুল নিয়মে। ওষুধ তো তখনই কার্যকর হয় যখন হুবহু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা হয়। ভুল ব্যবহারে বিষ ছাড়ানোর ওষুধ কিনা উলটো বিষ হয়ে যায়।
যেখানে আল্লাহ কোরআনকে আরোগ্য বলছেন, এবং তার প্রয়োগ কার্যত বাস্তবায়নও হয়েছে, তাও এমন এক জাতির ওপর যারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জাহিল ছিল, সেই একই জিনিস আমাদের আরোগ্য না হওয়ার একটাই কারণ হতে পারে— আমরা সঠিক নিয়মে ওষুধ সেবন করছি না।
চিন্তা-ফিকির করে আমাদের এই সঙ্গীন পরিস্থিতির দুটো কারণ পেয়েছি: (এক) আমাদের একটি দল তো বিলকুল কোরআন পড়ছে না, (দুই) আরেক দল কোরআন পড়ছেন বটে, কিন্তু পড়ছেন ভুল নিয়মে।
যারা কোরআন পড়ে না তাদের পড়তে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া বলার কিছু নাই, আর এক্ষণে আমরা কথা বলতে পারি তাদের নিয়ে যারা কোরআন পড়েও কোরআন থেকে ফায়দা নিতে পারছেন না।
دریا رود از چشم لب ترنشود ہرگز
ایں طرفہ تماشہ بیں لب تشنہ بہ آب اندر
‘চোখের পানি যদি ঠোঁটই স্পর্শ না করে, তাহলে সে কেমন কান্নাভেজা চোখ?’
কোরআন পড়ার যথাযথ নিয়ম:
কোরআন কীভাবে পড়ায় ভুল নিয়মে পড়া হচ্ছে আমরা সেই আলোচনায় না গিয়ে বরং ভালো হয় যদি এই সওয়াল উঠাই— ‘তাহলে কোরআন পড়ে ফায়দা পাওয়ার যথাযথ নিয়ম কী?’
যদি কোনো ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখেন, তাতে ওষুধ সেবনের নিয়মও নিশ্চয় লিখে দেন। কোরআন যেহেতু আল্লাহ নাজিল করেছেন, আল্লাহ নিশ্চয় কোরআন পড়ার যথাযথ নিয়ম তাঁর কালামেই বলে দিয়েছেন। এবিষয়ে কোরআনে চোখ বুলালে আমরা এই আয়াতগুলো পাই :
وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًاؕ আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন পাঠ কর। (সুরা মুজ্জাম্মিল : আয়াত ৪)
اَلَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ یَتْلُوْنَهٗ حَقَّ تِلَاوَتِهٖ١ؕ اُولٰٓئِكَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ١ؕ وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِهٖ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ۠ যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে যথাযথভাবে পাঠ করে। তারা তার ওপর সাচ্চা দিলে ঈমান আনে। আর যারা তা অস্বীকার করে, তারা আসলে ক্ষতিগ্রস্ত। (সুরা বাকারা :আয়াত ১২১)
فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ یَتَفَكَّرُوْنَ তুমি এ কাহিনি তাদেরকে শোনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ফিকির করবে। (সুরা আ’রাফ : আয়াত ১৭৬)
كَذٰلِكَ نُفَصِّلُ الْاٰیٰتِ لِقَوْمٍ یَّتَفَكَّرُوْنَ এভাবে আমি বিশদভাবে নিদর্শনাবলি বর্ণনা করে থাকি তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে। (সুরা ইউনুস : আয়াত ২৪)
وَ قُرْاٰنًا فَرَقْنٰهُ لِتَقْرَاَهٗ عَلَى النَّاسِ عَلٰى مُكْثٍ وَّ نَزَّلْنٰهُ تَنْزِیْلًا আর এ কোরআনকে আমি অল্প অল্প করে নাজিল করেছি, যাতে করে তুমি যথাসময়ে তা লোকদেরকে পড়ে শোনাও এবং (এই কারণেই) তাকে পর্যায়ক্রমে নাজিল করেছি। (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ১০৬)
لَقَدْ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكُمْ كِتٰبًا فِیْهِ ذِكْرُكُمْ١ؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ۠ হে লোকসকল! আমি তোমাদের প্রতি এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যার মধ্যে তোমাদেরই কথা আছে, তোমরা কি তারপরও বুঝো না? (সুরা আম্বিয়া: আয়াত ১০)
وَ لَا تَعْجَلْ بِالْقُرْاٰنِ مِنْ قَبْلِ اَنْ یُّقْضٰۤى اِلَیْكَ وَحْیُهٗ١٘ وَ قُلْ رَّبِّ زِدْنِیْ عِلْمًا আর দেখো, কোরআন পড়ার ব্যাপারে দ্রুততা অবলম্বন কোরো না, যতক্ষণ না তোমার প্রতি তার ওহি পূর্ণ হয়ে যায় এবং দোয়া করো, হে আমার পরওয়ারদিগার, আমাকে আরও জ্ঞান দান করুন। (সুরা ত-হা, আয়াত ১১৪)
وَ لَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِیْ هٰذَا الْقُرْاٰنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ١ؕ আর আমি মানুষদের বােঝানাের জন্যে এ কোরআনে সব ধরনের উদাহরণই পেশ করেছি। (সুরা রূম : আয়াত ৫৮)
وَ لَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ আমি এ কোরআনকে উপদেশ লাভের সহজ উৎস বানিয়ে দিয়েছি। তো উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (সুরা কমার: আয়াত ১৭)
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ١ؕ তারা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে না? (সুরা নিসা : আয়াত ৮২)
وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لَوْ لَا نُزِّلَ عَلَیْهِ الْقُرْاٰنُ جُمْلَةً وَّاحِدَةً١ۛۚ كَذٰلِكَ١ۛۚ لِنُثَبِّتَ بِهٖ فُؤَادَكَ وَ رَتَّلْنٰهُ تَرْتِیْلًا অস্বীকারকারীরা বলে, ‘এ ব্যক্তির কাছে সমগ্র কোরআন একই সাথে নাজিল করা হলো না কেন?’ হ্যাঁ, এমন করা হয়েছে এজন্য, যাতে আমি একে ভালোভাবে তোমার মনে গেঁথে দিতে থাকি এবং (এ উদ্দেশ্যে) একে একটি বিশেষ ক্রমধারা অনুযায়ী আলাদা আলাদা অংশে সাজিয়ে দিয়েছি। (সুরা ফুরকান : আয়াত ৩২)
وَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِّرُوْا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمْ لَمْ یَخِرُّوْا عَلَیْهَا صُمًّا وَّ عُمْیَانًا তাদের যদি তাদের রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেওয়া হয় তাহলে তারা তার প্রতি অন্ধ ও বধির হয়ে থাকে না। (সুরা ফুরকান : আয়াত ৭৩)
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ مُبٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوْۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَكَّرَ اُولُوا الْاَلْبَابِ এটি একটি অত্যন্ত বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার ওপর নাজিল করেছি, যাতে এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা নেয়। (সুরা স-দ : আয়াত ২৯)
اِنَّا جَعَلْنٰهُ قُرْءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَۚ আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় বানিয়েছি যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো। (সুরা যুখরুফ : আয়াত ৩)
فَاِنَّمَا یَسَّرْنٰهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ হে নবী, আমি এই কিতাবকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি যাতে এই লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা দুখান : আয়াত ৫৮)
فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِیْۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ١ۚ اِنَّكَ عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ওহির মাধ্যমে তোমার কাছে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে সর্বাবস্থায় তুমি দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে থাকো নিশ্চয়ই তুমি সোজা পথে আছো। (সুরা যুখরুফ: আয়াত ৪৩)
وَ اِنَّهٗ لَذِكْرٌ لَّكَ وَ لِقَوْمِكَ١ۚ وَ سَوْفَ تُسْئَلُوْنَ প্রকৃত সত্য হলো, এ কিতাব তোমার ও তোমার কর্মের জন্য অনেক বড় একটি মর্যাদা এবং এজন্য অচিরেই তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। (সুরা যুখরুফ: আয়াত ৪৪)
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ اَمْ عَلٰى قُلُوْبٍ اَقْفَالُهَا তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করেনি, নাকি তাদের মনের ওপর তালা লাগানো আছে? (সুরা মুহাম্মদ : আয়াত ২৪)
یُرِیْدُ اللّٰهُ لِیُبَیِّنَ لَكُمْ وَ یَهْدِیَكُمْ سُنَنَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَ یَتُوْبَ عَلَیْكُمْ١ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌ حَكِیْمٌ
তোমাদের আগে যেসব সৎলোক (নবী ও সালেহিন) চলে গেছে, তারা যেসব পদ্ধতির অনুসরণ করত, আল্লাহ তোমাদের সামনে সেই পদ্ধতিগুলো সুস্পষ্ট করে দিতে এবং সেই সব পদ্ধতিতে তোমাদের চালাতে চান। তিনি নিজের রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান। আর তিনি সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানময়। (সুরা নিসা : আয়াত ২৬)
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللّٰهَ وَ الْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللّٰهَ كَثِیْرًاؕ তোমাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিনের আশাবাদী এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে। (সুরা আহযাব : আয়াত ২১)
কোরআন পড়ার নিয়ম ও কোরআন থেকে ফায়দা লাভের উপায় আল্লাহ পাক এই সমস্ত আয়াতে সাফ সাফ বাৎলে দিয়েছেন। মোটাদাগে বললে তিনটি মূলনীতি হয়:
১) কোরআন খুব মনোযোগ ও ধীরেধীরে পড়বে। এবং তা নিয়ে চিন্তা-ফিকির ও প্রায়োগিক গবেষণা করবে।
২) যা পড়বে, ওই অনুযায়ী কাজ করবে। কেননা তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে উত্তম কাজের জন্যে।
اِ۟لَّذِیْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَیٰوةَ لِیَبْلُوَكُمْ اَیُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا١ؕ وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْغَفُوْرُۙ কাজের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। (সুরা মুলক : আয়াত ২)
وَ اللّٰهُ یُرِیْدُ اَنْ یَّتُوْبَ عَلَیْكُمْ١۫ وَ یُرِیْدُ الَّذِیْنَ یَتَّبِعُوْنَ الشَّهَوٰتِ اَنْ تَمِیْلُوْا مَیْلًا عَظِیْمًا হ্যাঁ, আল্লাহ তো রহমত সহকারে তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চান। কিন্তু যারা নিজেদের প্রবৃত্তির লালসার অনুসরণ করছে তারা চায় তোমরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে সরে যাও। (সুরা নিসা : আয়াত ২৭)
৩) এবং কোরআনি শিক্ষা ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের (স) জীবন ও কর্ম অনুসরণ করবে। কোনো শিক্ষা বাস্তবায়ন তখনই খুব সহজ হয় যখন তার কোনো বাস্তব নমুনা থাকে। এর ফলে বিভিন্ন লোকের মতের বিভিন্নতার কারণে অনৈক্য হয় না, এবং বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে নিরাপদ থাকা যায়। কোরআনে আল্লাহ কোরআন শিক্ষার যে নিয়ম বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রসুলও (স) সেই নিয়ম অনুসরণ করেছেন এবং কামিয়াব হয়েছেন।
আল্লাহর রসুল (স) কোরআনের প্রত্যেকটি আয়াত নিয়ে চিন্তা-ফিকির করতেন। একই আয়াত বারবার বারবার পড়তেন। এমনও হয়েছে, একটি আয়াত পড়ছেন তো পড়ছেন, রাত পার হয়ে সকাল হয়ে গেছে।
ইমাম ইবন কাইয়িম তাঁর ‘যাদুল মাআদ’ কিতাবে লিখেন— ‘আল্লাহর রসুল (স) খুব থেমে থেমে সুরা পড়তেন। এমনকি একটি ছোট সুরা পড়তে দীর্ঘ সুরার চেয়ে বেশি সময় লাগাতেন। কখনো কখনো একটি আয়াত বারবার পড়তে পড়তে সকাল বানিয়ে ফেলতেন।’
সাহাবাদের দৃষ্টিতে কোরআন পড়ার নিয়ম:
হজরত ইবন মাসউদ (রা) বলেন, ‘কোরআন আস্তে আস্তে ও চিন্তা-ফিকির করে পড়া, যদিও অল্প পড়া হয় তবু দ্রুত পড়ার চেয়ে উত্তম। কেননা কোরআন পড়ার উদ্দেশ্য তা বোঝা ও কার্যত বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা করা— ওই পড়া ও মুখস্তকরণ যেন অর্থোদ্ধার পর্যন্ত পৌঁছায়। এই জন্যই আমাদের কতক মুরুব্বি বলেন, কোরআন নাজিল হয়েছে কোরআন কার্যত বাস্তবায়নের জন্য, কিন্তু লোকজন কোরআন তেলাওয়াতকে আমল বানিয়ে নিয়েছে। আমাদের অগ্রসূরীদের মধ্যে ‘কোরআনওয়ালা’ তাদের বলা হতো যারা কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন, একই সাথে তা কার্যত বাস্তবায়ন করতেন। যদিও তাদের কারো কারো কোরআন মুখস্ত ছিল না।
যে লোকের কোরআন মুখস্ত আছে কিন্তু সে তার অর্থ বোঝে না এবং কার্যত বাস্তবায়নের উপায়ও জানে না, সে ‘কোরআনওয়ালা’ নয়, যদিও প্রত্যেকটা হরফ সম্পর্কে তার জ্ঞান সোজা তীরের মতো ঠিকঠাক হয়।
সাধারণ তেলাওয়াত, যেখানে কোরআন বোঝা ও চিন্তা-ফিকির করার বিষয়টি অনুপস্থিত থাকে, এমন তেলাওয়াত তো ভালো খারাপ মুমিন মোনাফেক— যে কেউ করতে পারে। আল্লাহর রসুল (স) একারণেই বলেন, যে মোনাফেক কোরআন তেলাওয়াত করে তার উদাহরণ ‘রায়হান’ (নামক) সুগন্ধির মতো, তার ঘ্রাণ খুব সুন্দর কিন্তু স্বাদ তিতকুটে।’
‘শু’বা (র) বলেন, আবু হামজা (র) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন :
ইবন আব্বাসের (রা) কাছে বলেছিলাম আমি খুব দ্রুত কোরআন পড়ে থাকি। কখনো কখনো এক রাত্তিরেই একবার বা দুইবার কোরআন খতম দিয়ে ফেলি। ইবন আব্বাস আমার কথা শুনে বলেন, এই ধরনের কোরআন তেলাওয়াতের (খতম) চেয়ে আমার কাছে একটা সুরা পড়াও বেশি উত্তম মনে হয়। তারপরও তুমি যদি দ্রুত পড়তে চাও, অন্তত এমনভাবে পড় যেন তোমার কান শুনতে পায়, তোমার মন ধরতে পারে।’
‘ইবন মাসউদ (রা) বলেন, আল্লাহর কিতাবের মুগ্ধকর জায়গাগুলোতে থামো, মনের ভেতর তান অনুভব করো, এবং তোমাদের চেষ্টা যেন না হয় সুরার শেষ পর্যন্ত পৌঁছা।’
‘আবদুর রহমান বিন আবি লায়লা (র) বলেন, আমি একবার এক মহিলার সাক্ষাতে গিয়েছিলাম, এবং সুরা হুদ তেলাওয়াত করছিলাম। মহিলা বললেন, আবদুর রহমান, তুমি এভাবে সুরা হুদ পড়ো? খোদার কসম, আমি ছয় মাস ধরে সুরা হুদ পড়ছি এবং এখন পর্যন্ত সুরা শেষ হয়নি।’
সাহাবায়ে কেরাম একদিকে কোরআন পড়তেন, আরেকদিকে কার্যত বাস্তবায়ন করতেন। প্রথমে দশ আয়াত পড়তেন, এবং তা কার্যত বাস্তবায়ন করতেন, তারপর আবার দশ আয়াত পড়তেন, আবার তা কার্যত বাস্তবায়নে লেগে যেতেন, এভাবেই ধারাবাহিক কার্যক্রম বজায় রাখতেন। স্রেফ পড়া আর বোঝাই উদ্দেশ্য বানাননি। ইবন কাসির যেমন তার কিতাবে উল্লেখ করেন, ‘ইবন মাসউদ বর্ণনা করেন, আমাদের মধ্যে কেউ দশ আয়াতের বেশি পড়তেন না, যদ্দিন না ওই আয়াতের অর্থোদ্ধার করতেন এবং তা কার্যত বাস্তবায়নে আনতেন।’
আবদুর রহমান সালমাও (রা) একই নিয়মে কোরআন পড়ার কথা বলেছেন। এর সাথে সাহাবায়ে কেরাম আরও একটি কাজ করতেন— তারা এ-ও চিন্তা করতেন কোরআন শিক্ষার আগে তাদের কী অবস্থা ছিল আর এখন কী কী পরিবর্তন ঘটেছে। নিজের অতীত ও বর্তমানের তফাৎটা বোঝার চেষ্টা করতেন। একারণে হাবশার [১] শাসক নাজ্জাশি [২] যখন হজরত জাফর বিন আবু তালিবের (রা) কাছে ইসলাম বিষয়ে জানতে চান, এবং জিজ্ঞাসা করেন— তুমি আপন ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করলে কেন, তখন আবু তালিবের ছেলে জাফর নির্দ্বিধায় বলেন,
‘মহাশয়, আমরা জাহিল ছিলাম এবং মূর্তিপুজো করতাম। মৃত প্রাণী ভক্ষণ করতাম। বেহায়া-বেলেল্লাপনা করতাম। আত্মীয়তা ছিন্ন করতাম। পাড়া-পড়শীর সাথে দুর্ব্যবহার করতাম। আমাদের শক্তিমানেরা দুর্বলদের শুষে খেত। আমরা এমন নাজুক অবস্থায় ছিলাম, মহান আল্লাহ তখন আমাদের কাছে একজন রসুল পাঠান— যার আমানতদারিতা ও সদাচার সম্পর্কে খুব আগে থেকেই ভালো করে জানতাম। তিনি আমাদের একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দেন, যেন আমরা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করি, এবং আমরা ও আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে পাথরের মূর্তির উপাসনা করত তা যেন ছেড়ে দিই।
তিনি আমাদের সত্য বলতে, আমানত রক্ষা করতে, আত্মীয়তা সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে, প্রতিবেশির সাথে ভালো আচরণ করতে, হারাম কাজ ও খুনখারাবি থেকে বাঁচতে হুকুম করেন, এবং মিথ্যা বলতে, এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে অধিকরণ করতে, সতী নারীকে অপবাদ দিতে নিষেধ করেন। তিনি এক আল্লাহর ইবাদত করতে, তার সাথে কাউকে শরিক না করতে, আমাদের নামাজ রোজা ও জাকাত আদায় করতে নির্দেশ করেন।...’ (সিরাতে ইবন হিশাম, প্রথম খণ্ড)
মুক্তি আল্লাহর বলা নিয়মেই:
কোরআন পড়ার নিয়ম সরাসরি কোরআন, আল্লাহর রসুল ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে একদম রাখঢাক ছাড়া জানতে পারি। এখন আপনিই বলুন, আমরা কি ওই নিয়মে কোরআন পড়ি? যদি কোরআন থেকে আপনি আসলেই উপকৃত হতে চান, আপনাকে ওই নিয়মেই কোরআন পড়তে হবে যে নিয়মে পড়তে বলা হয়েছে। আমাদের মুক্তি ওই পথেই। ইমাম মালেক কতই-না চমৎকার বলেছেন :
لا يصلح آخر هذه الأمة إلا بما صلح أولها. ‘এই উম্মতের সর্বশেষ প্রজন্মের সংশোধন এভাবেই হবে যেভাবে প্রথম প্রজন্মের হয়েছে।’
এক্ষণে আমাদের গভীর চিন্তা করে বের করা প্রয়োজন যে, আমরা ঠিক কোনখান দিয়ে কোরআন যথাযথ নিয়মে পড়ছি না। ওই জায়গাটা স্পষ্ট করতে পারলে আমাদের জন্য সম্ভব পুনরায় গতিশীল হওয়া, এবং এ-ও বোঝা যাবে আমরা কোরআনের সঠিক উদ্দেশ্য থেকে কতখানি দূরে।
একদল কোরআন পড়েই না, তারা তো এই সৌন্দর্যের খবর বিলকুল রাখে না, তাদের নিয়ে কীই-বা বলা যায়। তবে তার চেয়ে বেশি আফসোস করতে হয় দ্বিতীয় দলের জন্য, যারা কোরআন পড়েন, কোরআনের প্রতি ভালোলাগা-ভালোবাসা আছে, অথচ যথাযথ নিয়মে না পড়ার কারণে কোরআনের ফায়দা থেকে দূর বহুদূরে, এবং প্রতিনিয়ত যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছেন। এদের একশ্রেণি তো কোরআন বিন্দুমাত্র বোঝার চেষ্টা করেন না, বরং মন্ত্রের মতো শব্দ আওড়ে যাওয়াকে যথেষ্ট মনে করেন।
আমাদের দেশের প্রায় সবকয়টি মাদরাসার এই-ই রঙ। আরেক শ্রেণির লোক আছেন, যারা কোরআন পড়েন, অর্থ ও উদ্দেশ্য বোঝার কসরতও করেন বটে, কিন্তু বড় আফসোসের বিষয়, তারা ভূমিকাতেই হযবরল করে ফেলেন, ফলে তারা না পারেন কোরআন যথাযথ নিয়মে পড়তে আর না কোরআনকে মিলাতে পারেন সময়ের সাথে। শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (র), যিনি ভারতবর্ষের সব আলেম-উলামার গুরু, তিনি তার দুস্প্রাপ্য বই ‘তাফহিমাতে ইলাহিয়া’তে এই শ্রেণির লোকদের কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা তাদের আলোর পথ পেতে রাহবর হবে।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির (র) দেখানো পথ :
‘তোমরা যারা নিজেদের আলেম বলো, ওরে বেকুবের দল, তোমরা এখনো গ্রিক ধারার জ্ঞানচর্চায় মশগুল হয়ে আছো, এখনো আটকে আছো আরবি ব্যাকরণে, অথচ তোমরা কিনা ভাবছো এটাই প্রকৃত এলেম!’
এরপর এক জায়গায় তিনি বলেন, কোরআন বোঝার জন্য প্রাথমিকভাবে যেসব জ্ঞানের প্রয়োজন, তা প্রাথমিক পর্যায়েই রাখা উচিৎ, আলাদা শাস্ত্রের মর্যাদা দেওয়া উচিৎ নয়।
‘সহায়ক জ্ঞান সহায়ক হিসেবেই রাখবে, তাকে মৌলিক জ্ঞান বানানোর কোনো জরুরত নেই।’
যেহেতু এই শ্রেণি আরবি ব্যাকরণ যুক্তিবিদ্যা কালামশাস্ত্র শব্দশাস্ত্র অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের ওপর সমস্ত সময় ব্যয় করে ফেলে, তাই কোরআনের প্রতি মূল মনোযোগ নিবদ্ধকরণের সময়ই আর পায় না। পুরো শিক্ষাজীবনে তারা যেই অল্পসময় কোরআনি শিক্ষায় খরচ করে, তার পুরোটাই খরচ হয় তফসিরবিদদের হরেক রঙের মতবিরোধের ফান্দে। আমাদের মাদরাসা ও ধর্মশিক্ষা কেন্দ্রগুলোর এই-ই হালচাল। নেহায়েত আফসোসের বিষয়, আজকাল বিশুদ্ধ কোরআনের শিক্ষা কোথাও দেওয়া হয় না। যারা মনে করেন কোরআনের শিক্ষা আছে, প্রকৃতপক্ষে ওটা কোরআনের তফসির শিক্ষা। কোরআনের শিক্ষা ও কোরআনের তফসির সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। কোরআন নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র, এবং সাদাসিধে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ। আল্লাহ নিজে কোরআন সম্পর্কে বলেন :
فَاِنَّمَا یَسَّرْنٰهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ হে নবী, আমি এই কিতাবকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি যাতে এই লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা দুখান : আয়াত ৫৮)
وَ لَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ আমি এ কোরআনকে উপদেশ লাভের সহজ উৎস বানিয়ে দিয়েছি। তো উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (সুরা কমার : আয়াত ১৭)
قُرْاٰنًا عَرَبِیًّا غَیْرَ ذِیْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ یَتَّقُوْنَ এই কোরআন আরবি ভাষায় (অবতীর্ণ), যাতে কোনো প্যাঁচগোছ নেই। যাতে তারা তা বোঝে খোদাভীরু হয়। (সুরা যুমার : আয়াত ২৮)
কোরআন ও তফসির বিষয়ে শাহ ইসমাইল শহীদের (র) অভিমত: ‘আরবি জানেন ও বোঝেন, এবং আল্লাহর রসুলের (স) দেখানো নমুনা সামনে রাখেন (স্বয়ং আল্লাহ যার হুকুম কোরআনে দিয়েছেন)— নির্ভুল বা বিভ্রাটমুক্ত হাদিসে পাকে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট, এসব যার আয়ত্তে আছে তার ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন নেই, তিনি একদম যথাযথ নিয়মে কোরআন বুঝতে ও কার্যত বাস্তবায়ন করতে পারবেন। অন্যদিকে যিনি আরবি জানেন না, তিনি কোরআনের তর্জমা পড়ে আল্লাহর কালাম বোঝে নিবেন। কিন্তু হৃৎপিণ্ড-ফালাফালা-করা দুঃখের কথা কীই-বা বলব— লোকজন ধরেই নিয়েছে আমরা কোরআন বোঝার যোগ্যতা রাখি না। তারা মনে করেন কোরআন বোঝার জন্য বহুরকমের জ্ঞান ও শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ হতে হবে, বড় আলেম হতে হবে।’ [৩] শাহ ইসমাইল শহীদ একথা বলেন।
هُوَ الَّذِیْ بَعَثَ فِی الْاُمِّیّٖنَ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ١ۗ وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍۙ তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি নিরক্ষর সাধারণ জনগােষ্ঠীর মধ্য থেকে তাদেরই একজনকে রসুল বানিয়ে পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের আল্লাহর বাণী ও নিদর্শন (আয়াতসমূহ) পড়ে শােনান, তাদের জীবনকে সাজানো-গোছানো করেন, তাদের আল্লাহর কিতাবের (কথা ও সে অনুযায়ী দুনিয়ায় চলার) শিক্ষা দেন, এবং হেকমত (প্রজ্ঞা) শাণিত করেন, অথচ এ লােকগুলােই (রসুল আসার) আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল। (সুরা জুমআ : আয়াত ২)
কল্পনা করুন এই আয়াত পড়ে কেউ বলল— ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের কথা আলেম ছাড়া কেউ বুঝবে না, আলেম ছাড়া কেউ সঠিক পথে চলতে পারবে না।’ তাদের এমন মত সরাসরি কোরআনকে অস্বীকার করছে না?
ব্যাপারটা অনেকটা এমন— একজন বড় ডাক্তার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। একজন এসে বলল, ‘ভাই তুমি নিজে ডাক্তার হলে কী হবে, এখন তো অসুস্থ, আর অসুস্থের চিকিৎসা তো কেবল সুস্থ মানুষই করতে পারে!’ কোনো বোকার হদ্দও কি তার একথা কানে নিবে? যদি নেয়, তাহলে সে নিজেই নিজের জ্ঞানকে অস্বীকার করল। প্রকৃতপক্ষে যিনি ডাক্তার, যিনি রোগ বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, তিনি নিজের অসুস্থতারও চিকিৎসা করতে পারেন।
বড়ই দুঃখজনক কথা, আমরা মনে করি কোরআন বুঝব না। কোরআনের কত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে, বিভিন্ন তফসিরের কিতাবে কত জটিল জটিল বিষয় লেখা আছে, মুফাসসিরদের গবেষণা ও মতামত পড়লেই কেবল কোরআন বুঝব। কিন্তু এই ‘মনে করা’ বাস্তবিক নয়। এইসব তফসিরগুলো যদি নিখাদ ও কোরআনের হক আদায় করে লেখা হতো তাহলে এই ‘মনে করা’ মেনে নিতে আপত্তি থাকত না। কিন্তু গজব কাণ্ড হলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও মতবাদের প্রভাবে কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরিবর্তন করা হয়েছে, এমনকি এমন অনেক কিছুই যুক্ত করা হয়েছে যেসবের সাথে আল্লাহর বাণীর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই। সাধারণ মানুষ ওই সবকেই কোরআন মনে করে। কোরআনের প্রকৃত শিক্ষার সাথে ওই সব ব্যক্তিগত মতের কোনোপ্রকার লেনাদেনা নাই। আল্লাহ হেফাজত করুন।
টীকা: [১] কিংডম অফ আকসুম— বর্তমান ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, জিবুতি, পূর্ব সুদান ও দক্ষিণ-পূর্ব ইয়েমেন। [২] নাজ্জাশি বা নেগাস হলো উপাধী, মূল নাম আসহামা। শাসনকাল ৬১৪ - ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ। [৩] তাকবিয়াতুল ঈমান, পৃষ্ঠা ৩০
-এটি