মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
সর্বনাশা নেশার চোরাস্রোতে তলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের তরুণ সমাজ। মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা, কিন্তু সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাদক পাচার এবং মাদকাসক্তির হার কমানোর জন্য বৃহৎ আকারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারকে সম্ভাব্য সব রকমের সহায়তা দিচ্ছে বিদেশী সংস্থাগুলো। তবে এ পাপের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য সবার সম্মিলিত উদ্যোগ থাকার পরও কেনো এখন দেশে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ লোক মাদকাসক্ত। ৬৮ হাজার কারাবন্দির মধ্যে ৩৭ হাজারই মাদকাসক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত। এ প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে বিরাজ করছে সচেতন মহলে।
যেখানে সমাজ থেকে মাদকের মূল উৎপাটন অভিযানে একমত সবাই। সবাই বলছে-অভিযানের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। সেখানে কেনো এতো মাদকের ছড়াছড়ি? কেনো এতো মাদকের হাঁট? অথচ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে যথেষ্ট সোচ্চার রয়েছে। এতে করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরো সচেতন, দক্ষ ও উন্নয়নশীল হিসেবে গড়ে উঠা দরকার ছিলো। কিন্তু হচ্ছে না কেনো? কীসের অভাব তাহলে?
মাদক ব্যবসায় নায়িকা-গায়িকা, নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে নানা পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, ছাত্র-ছাত্রীরা জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন কম হয়নি। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে সেলিব্রেটিদের মাধ্যমেও মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করেছে সরকার। একসময় মাদকের বিরুদ্ধে আয়োজন করা হতো কনসার্ট। তবুও মাদকের আসর কমেনি। কমেনি মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা। বরং বেড়েছে বহুগুণ। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনকারী লোকটি মাদক গিলেই সচেতন করতে যাচ্ছে। আবার সচেতন করা শেষেও মাদকই গিলছে। দিনশেষে তারাই বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে মাদকে। এমন প্রতিবেদন বেরিয়ে এসেছে দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে।
সরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা হতো, তারাই এখন মাদকের প্রধান যোগানদাতা। সাম্প্রতিককালের পরিমনি, নজরুল রাজ, চলচ্ছিত্র শিল্পী একাসহ একাধিক সেলিব্রেটিই এখন মাদকের জালে আবদ্ধ। নিজেদের ঘরে পরিচালনা করেতেন মাদকের আসর। এতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন নিজেরা। সঙ্গে নিজেদের পরিবার বন্ধু-বান্ধব এমনকি পাড়াপড়শিদেরও মাদকের জালে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে মাদকের বিরুদ্ধে আগেও সোচ্চার ছিলেন মসজিদের ইমাম-খতীবরা। এখনো সোচ্চার আছেন তারা। দেশের একাধিক মসজিদের খতীবদের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানিয়েছেন তারা। মসজিদের ইমাম-খতিবরা মাদকের বিরুদ্ধে শুধু নিজেরাই সোচ্চার থাকেন তা নয়, বরং মসজিদের মুসুল্লি, এলাকাবাসী, প্রতিবেশিসহ সবাইকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করেন। ইমাম-খতিবরা মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি মাদক থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন সাধারণ জনতাকে। দেশের পাঁচ লক্ষ মসজিদের মিম্বার থেকে প্রতি শুক্রবার মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে।
দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম থেকে উচ্চারিত হয় মাদকের বিরুদ্ধে বক্তব্য। মহাখালীর গাউছুল আজম মসজিদে থেকে উঠে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ। মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর মসজিদের মিম্বার। এছাড়া জেলা শহর, থানা শহরের মসজিদগুলো থেকে সব সময়ই মাদক নির্মূলের শপথ ওঠে। দেশের ইমাম-খতিবরা ইউনিয়ন, গ্রাম এমনকি পাড়া মহল্লার মসজিদেও মাদকের বিরুদ্ধে বয়ান করেন। তাই মাদক নির্মুলে আস্থা এখন ইমাম-খতিবরা। এমনটাই বলছেন দেশের আলেম সমাজ।
তবে এখন আওয়াজ উঠেছে সরকার যাদের নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলত বা মাদকের বিরুদ্ধে প্রচারণা ক্যাম্পেইন করাতো, তারা তাদের উপরে আর আস্থা রাখছে না। সরকারের মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইনের এক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, এ যাবতকালে আমরা যত খরচ করেছি মাদকের বিরুদ্ধে সেলিব্রেটিদের পেছনে। সেটা যদি কোন মসজিদের ইমামের পিছনে করতাম তাহলে সেটা হতো আমাদের জন্য মাইলফলক।
সরকারি এ কর্মকর্তা আরও জানান, এখন সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ভিন্ন কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা আরও বেশি সচেতনতার সাওেথ পদক্ষেপ নিবেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, মসজিদের ইমামরা যে বক্তব্যে সাধারণ মানুষকে পুলকিত করতে পারেন, দেশের ১০ জন সেলিব্রেটি মিলেও সেই অবস্থানে যেতে পারেন না।
‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো: আব্দুস সবুর মন্ডল পিএএ বলেন, ‘আজকে মাদকের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, এতে যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে দেশ ছারখার হয়ে যাবে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। মাদক আমাদের ব্রেনের মধ্যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়। তাই তরুণসমাজের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তানের মধ্যে এমন বীজ মা-বাবাকে বপন করতে হবে, যাতে সে আত্মপ্রত্যয়ী হয়, যাতে সে অশুভকে চিনতে পারে।’
আর এ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক মোঃ মোকাব্বির হোসেন মনে করেন, ‘মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরির কাজটি পরিবারের পাশাপাশি দেশের আলেম সমাজ করে থাকে। পরিবারের সদস্যদের ছোটকাল থেকে বুঝানো না গেলে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত দেশের কোনো আলেমকে আমরা দেখিনি মাদকসক্ত। কোনো ইমাম-খতিবের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাই সমাজের সব ছেলে-মেয়ে মসজিদের ইমাম-খতিবদের থেকে মাদকের বিরুদ্ধে শিক্ষা নিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
এমডব্লিউ/