নুরুদ্দীন তাসলিম।।
মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত আরবি ভাষা ও ইসলামি কিতাবের সর্ববৃহৎ বইমেলায় ‘দার আল-রায়াহীন’ নামে একটি বৈদেশিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পরিবেশিত বইগুলোর বেস্ট সেলার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের গবেষক আলেম মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেকের হাদিস শাস্ত্রের প্রাথমিক বিষয়াদি নিয়ে আরবি ভাষায় রচিত ‘আল মাদখাল ইলা উলূমিল হাদিস’ নামক চমৎকার কিতাবটি।
দেশের বাইরে কিতাবটির এমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের ইলমি গবেষণা ও চর্চাকে নিয়ে গেল এক নতুন উচ্চতায়। দেশের জন্য একে নতুন মাইলফলক বলেও মনে করছেন অনেকেই। এ নিয়ে ইলমি মহলের মানুষজন বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অনলাইন ও অফলাইনে। কিতাবটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৪১৯ হিজরিতে ( ১৯৯৮ ইংরেজি)। চতুর্থ সংস্করণে গিয়ে তা সমাদৃত হল বিশ্ব দরবারে।
দেশের বাইরে কিতাবটির এমন পাঠকপ্রিয়তাকে কিভাবে দেখছেন ইলমি মহলের লোকজন? এ বিষয়ে জানতে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ার শিক্ষক ও মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেকের স্নেহধন্য ছাত্রদের একজন মাওলানা তাহমীদুল মাওলার সঙ্গে। তিনি ‘আল মাদখাল ইলা উলুমিল হাদিসিস শারীফ’-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তায় প্রথমেই আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা আদায় করেছেন। দোয়া করেছেন কিতাবটি যেন আরো বেশি পাঠকপ্রিয়তা পায়।
তবে কিতাবটির এই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তায় তিনি তেমন একটা অবাক হননি। কারন হিসেবে তিনি বলছেন, কিতাবের লেখক মাওলানা আবদুল মালেক নিজেকে গোপন রাখতে চাইলেও উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ আরবের অনেক আলেম-তলাবাদের মাঝে তার গুরুত্ব আগে থেকেই রয়েছে। তাই কিতাবটি আরব দেশগুলো থেকে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে কিতাবটির যে মুদ্রণ ছাপানো হয়েছে ইতোমধ্যেই তা ভারত আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের মাদ্রাসাগুলোতে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর যেসব ছাত্র রয়েছেন মাওলানা আব্দুল মালেকের সমবয়সি তাদের মাঝেও কিতাবটি ব্যাপক পরিচিত তাই কিতাবটির এই জনপ্রিয়তা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন তিনি।
আল মাদখাল-এর লেখক মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক-এর কাছে কিতাবটি সরাসরি পড়ার অনুভূতি সম্পর্কে মাওলানা তাহমিদুল মাওলা বলেন, ‘হযরতের অসাধারন পাঠদান পদ্ধতি সংক্ষেপে বলে শেষ করা সম্ভব নয়, শুধু এতটুকু বলতে পারি, যে বিষয়ে তিনি আলোচনা শুরু করতেন মনে হতো যেন অফুরন্ত সাগর’।
'কিতাবটি শুধুমাত্র উলুমুল হাদিসের শিক্ষার্থী নয় বরং দাওরায়ে হাদিস, কামিল ও বিভিন্ন ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ'-বলেছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, কিতাবের নামের শুরুতে 'মাদখাল' শব্দটি থাকার কারণে অনেকে মনে করতে পারেন এখানে উলুমুল হাদিস বিষয়ে প্রাথমিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়টি এমন নয় উল্লেখ করে তিনি বলছেন, এতে প্রাথমিক ভূমিকার আলোচনার পাশাপাশি ইলমুল হাদীসের মৌলিক এমন সব দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা একসাথে এক কিতাবে পাওয়া বিরল।
উলুমুল হাদিসের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পরামর্শ হিসেবে মাওলানা তাহমিদুল মাওলা বলছেন, ‘এই কিতাবটি পড়ার সময় এতে যেসব দিক-নির্দেশনা রয়েছে তা খেয়াল করে পড়লে একটি কিতাবই এই বিষয়ে বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে’।
'এছাড়া হাদিস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্তমান সময়ে যে বহুমূখী বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তার মোকাবেলায় তালেবে ইলম ও ওলামায়ে কেরামকে প্রস্তুত করতে এর বিকল্প কিতাব চোখে পড়ে না'-বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
মাওলানা তাহমিদুল মাওলার ভাষায়, কিতাবটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার পেছনে ইলমি মহলে মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক-এর ব্যক্তিত্বের গুরুত্বের বিষয়টি যেভাবে কাজ করেছে, এর পাশাপাশি আরো একটি বিষয় হচ্ছে, আরব অনারবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ও উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষক আলেম আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ.- এর ইলমে হাদীসের যোগ্য প্রতিনিধি মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক। তিনি তার এই কিতাবে নিজের দুই শায়েখের ইলমী কারনামা ও আকাবিরে দেওবন্দের জ্ঞানের সারনির্যাস নিপূনভাবে তুলে ধরেছেন, এ বিষয়গুলোই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে ইলমি মহলে কিতাবটি জনপ্রিয় করে তুলেছে বলে মনে করেন তিনি।
কিতাবটির পাঠকপ্রিয়তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইলমি গবেষণা ও চর্চাকে কতটা উচ্চতায় নিয়ে গেল এ বিষয়ে বহির্বিশ্বে যারা যোগাযোগ রাখেন তারাই যথার্থ মূল্যায়ন করবেন উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ভারতের মতো দেশের বড় বড় ইলমী ব্যক্তিত্বকে বলতে শোনা যায় বাংলাদেশে ভালো ভালো ইলমী ইদারা থাকতে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা কেন অন্য দেশে যায়?
এছাড়া পাকিস্তান, আফ্রিকা, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে এসে ইলমে দ্বীন অর্জন করতে চান-এমন খবরও শোনা যায়, এখান থেকেও বাংলাদেশের ইলমি গবেষণা ও চর্চার বিষয়টি অনুমান করে নেওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।
দেশের বাইরে মিশরে আন্তর্জাতিক বই মেলায় মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেকের কিতাবটির জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের জন্য নতুন মাইলফলক কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলছেন, কিতাবটি দেশের বাইরে জনপ্রিয়তা পাওয়ার বিষয়টি সত্যিই আনন্দের। তবে এখানে লক্ষণীয় হল আরব থেকে ছাপা কিতাবটি সেখানে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, যদি আমাদের দেশ থেকে ছাপা কিতাব কায়রোর মেলাতে যেতো এবং জনপ্রিয়তা পেতো তাহলে বিষয়টি আরো বেশি আনন্দের হতো।
কেএল