কাওসার আইয়ুব
এক.
ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘুমে বিভোর। আমি কী যেনো ভেবে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকা দেখি, ঘুমের মাঝেই মিটমিট হাঁসছে। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। অন্য মুজাহিদেরও দৃশ্যটি দেখিয়েছি। সে ঘুম ভেঙ্গে উঠেছে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ক্ষাণিকবাদে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা! তুমি ঘুমের ভেতর হেঁসে ওঠলে যে? ছেলেটি কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে চাইলো। আমরা নাছোর বান্দা, হাঁসির কারণ না শুনে যাবো না। আমাদের এটা জানতেই হবে।
অবশেষে তাকে স্বপ্নের কথা বলতেই হলো।
-দেখি, স্বর্ণ-রোপা খচিত বিশাল অট্টালিকা। মনোরম পরিবেশ। তাকালে চোখ লেগে থাকে। আমি ওদূরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি। তখনি প্রাসাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক দল মেয়ে। বয়সে তরুণ। উজ্জ্বল চেহারা। পরনে সাদা পোশাক। আমাকে দেখে মুচকি হাসছে। কিছুটা আনন্দিত ওরা।
-ঐ মার্জিয়ার স্বামী! মার্জিয়া উপরে আছে। একটি মেয়ে ডেকে বলছে।
আমি ওদের কথা মতো প্রাসাদের উপরে উঠি। তলা বিশিষ্ট প্রাসাদ। হরেক রকম সুভাস মাখা ফুলের ঘ্রাণ। মনোরম পরিবেশ। ফটকের ভেতরে সুসজ্জিত কামরা। খাটের উপর বসে আছে এক তরুণি। মখমলের বিছানায় যেনো চাঁদের টুকরা। জলমলে চেহারা। আমি তার কাছে যেতে চাইলাম। মুসকি হেসে বললো- না, এখনো কাছে আসার সময় হয়নি। ধৈর্য ধরো। আর একটা দিন। কাল দুপরে আমাদের সাক্ষাৎ হবে। এরপরই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
দুই.
আবু কুদামা রাহিমাহুল্লাহ একজন বীর মুজাহিদ। জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছে জিহাদের ময়দানে। রোমানদের বিরুদ্ধে তার বিরত্বগাঁথা যুদ্ধ ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
একবার তিনি মসজিদে নববিতে বসা। বন্ধুদের নিয়ে গল্প করছেন। বন্ধুরা তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললো- তুমিতো সারাটা জীবন জিহাদের ময়দানে কাটিয়ে দিলে। অনেক জিহাদ করেছ জীবনে , আজ আমাদেরকে যুদ্ধের একটি ঘটনা শুনাবে? এমন একটি গল্প শুনাও যা তোমাকে অনেক বেশি বিস্মিত করেছে?
আবু কুদামা বললেন, আচ্ছা! শুনো তাহলে, একবার আমরা রোমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে রওনা করি। ফুরাত নদীর তীর ঘেঁষা ‘দিনা’ বসতির পার দিয়ে যাচ্ছি। মাঝপথে উট ক্রয় করতে অল্প সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি নেই।
আমাদের খবর পেয়ে এক নারী ছুটে আসে। সালাম করে বলে; আমার আদুরে স্বামী ছিলো, ছিলো প্রাণের কয়েকটি ছেলে। জিহাদের ময়দানে শাহিদ হয়ে গেছে সবাই। কয়েকজন ভাইও ছিলো আমার, জিহাদের ময়দানে জান্নাতি যুবকের কাতারে নাম লিখিয়েছে।
এখন আমি দুই ইয়াতিম সন্তানের মা। একটি ছেলে আরেকটি মেয়ে। ছেলেটির বয়স ১৫। আমার কলিজার টুকরো ছেলেটি কোরআনের হাফেজ। হাদিসের ব্যাপারেও ভাল জ্ঞান রাখে। দক্ষ অশ্বারোহী, দেখতেও বেশ সুন্দর। আমার খুব ইচ্ছে ছেলেটিকে জিহাদে পাঠাবো। কিন্তু! সে একাটি কাজে শহরের বাইরে গেছে। এখনো ফিরেনি। অপেক্ষায় আছি সে আসলে আপনাদের সঙ্গে ময়দানে পাঠিয়ে দিতাম। এখন আপনাকে দেয়ার মতো আমার ঘরে কিছুই নেই।
নারীটি আপসোস করে বললো, এত মহান একটি যুদ্ধ হচ্ছে, আমি এর থেকে বঞ্চিত থাকবো এটা কী করে হয়! তখন বিধবা নারীটি ধুলোয় মাখা কয়েকটি চুল দিয়ে বললেন, এই চুলগুলোকে ঘোড়ার লাগাম হিসেবে ব্যবহার করবেন। যাতে এই বরকতময় জিহাদ থেকে আমি একেবারে বঞ্চিত না হই।
আবু কুদামা রহ. বললেন, আমি চুলগুলো নেই। আমাদের কেনাকাটা শেষ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি, সে নারীর ছেলে আসবে বলে। কিন্তু! অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। শেষে আমরা গন্তব্যের দিকে রওয়ানা করি।
অনেক পথ চলেগেছি। পেছন থেকে এক অশ্বারোহী ধুলো উড়িয়ে উধ্বশ্বাসে আমাদের উদ্দেশ্যে আসছে। কাছে এসে বললো-চাচা! আমি ঐ নারীর সন্তান যিনি ঘোড়ার লাগাম বানাতে আপনাকে মাথার চুল দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে যুদ্ধে যেতে এসেছি।
-আমি দেখলাম ছেলেটি একেবারেই ছোট। সবেমাত্র সাবালক হয়েছে। তাই তাকে পিঠে হাত বোলিয়ে বললাম, বাবা! তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এমনিতে তোমার বাবা নেই। তোমার মা একা। তোমার এখনো যুদ্ধে যাওয়ার সময় হয়নি। তুমি তোমার মায়ের খেদমত করো। মায়ের দেখাশুনা করো এটা তোমার জন্য ভালো হবে। বড় হয়ে যুদ্ধো করো।
ছেলেটি বলল, চাচা! আমার মা আমাকে শেষ বিদায় দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি আমাকে আপনার সাথে জিহাদে যেতে বলেছেন। তাছাড়া আমি ভাল ঘোড়া চালাতে পাড়ি। নিশানা স্থির করতেও ভুল করি না। আপনি আমাকে সাহসী যোদ্ধা হিসাবে পাবেন। যুদ্ধ থেকে পলায়নকারীদের মধ্যে আমাকে পাবেন না। আপনি আমাকে সাথে নিয়ে নেন, চাচা!
ছেলেটিকে আর বুঝিয়ে পরিনি। সাথেই নিতে হলো। আমরা কিছু দূর গিয়ে এক জায়গায় তাবু খাটাই। কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। মুজাহিদ সঙ্গিরা সবাই রোজা রেখেছিলেন, তাই সফর করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
আবু কুদামাও মসজিদে বসা বন্ধুদের গল্প শুনাতে নরেচরে বসেন। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। ইফতারির জন্য আগেই কিছু রান্না-বান্না করে রাখতে হবে, আবু কুদামা চিন্তা করছেন।
-চাচা! আমি রান্না করতে পারি। আমাকে রান্নার কাজটা দেন। আপনারা এমনিতেই রোজা রেখেছেন, তারপর সফর, বেশ ক্লান্ত লাগছে আপনাদের, বলে উঠলো ছেলেটি।
ছেলেটির এখলাস ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে হয়। তার চাওয়া ফেলে দেয়ার জু নেই। তাই রান্নার দায়িত্বটা তাকেই দেয়া হয়। সৈনিকেরা ঘুমিয়ে পড়ছেন। রান্না শেষ করে ছেলেটিও ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমে ছেলেটি একটা স্বপ্ন দেখে।
তিন.
-পরদিন আমরা রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে লড়ছি। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দুনো পক্ষের চূড়ান্ত লড়াই।শেষে বিজয়ের পতাকা আমাদের হাতে আসে। রোমান সৈন্যরা পিঠ দেখিয়ে পালায়। আমাদের কিছু সৈন্য আহত হয়ে পড়ে আছে। পড়ে আছে কিছু শহিদের দেহ। বাকি সৈন্যরা আহতদের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও বেশ আঘাত পেয়েছি। তবুও হেঁটে হেঁটে অহতদের খবর নিচ্ছি।
মনে মনে ঐ ছেলেটিকে খুঁজছি। তার মায়ের অসহায়ত্তের কথা মনে করে, ছেলেটির প্রতি বেশ মায়া হচ্ছে। চারোদিকে ঘুরে ছেলেটির কোনো খবর পাচ্ছি না। হঠাৎ চোখ পরলো অদূরে পরে থাকা একটি রক্ত মাখা দেহের দিকে। গোঙ্গানোর শব্দ করে কাতরাচ্ছে। আমি তাড়াহুরো করে পা বাড়িয়ে তার দিকে গেলাম।
কাছে গিয়ে দেখি সেই ছেলেটি। সেও আমাকে চিনে ফেললো। চাচা! আমিতো শহিদ হয়ে যাচ্ছি। আমার রক্ত মাখা জামাটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েন! আর মাকে বলেবেন, আপনার ছেলের দেয়া ওয়াদা পূর্ণ করেছে।
-আমি অবাক হয়ে ছেলেটির কথা শুনছি। তার রক্ত মাখা দেহ, মুখে বিজয়ের হাসি। চোখে বেদনার অশ্রু সব দেখে র্নিবাক হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। বিধবা মায়ের সাহসি ছেলে সে।
-বলবেন, সে লাড়াই করতে করতে বিজয় এনেছে, পিছু হটেনি। এতে করে আমার মা সান্ত্বনা পাবে। আর বাড়িতে আমার ছোট একটা বোন আছে।
বাড়িতে আমাদের আর কেউ নেই বলে ও আমার কাছেই থাকতো। আমিও ওকে অনেক আদর করতাম। ও আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিত না এ জন্য যে, সারাক্ষণ ওর সাথে খেলা করতে হবে। সবসময় ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকতো।
আপনি যখন বাড়িতে যাবেন আমার ছোট বোনটাকে একটু সান্ত্বনা দিবেন। আর আমার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন, আপনার ছেলে শহিদ হয়েছে। আপনি সৌভাগ্যবান, শহিদের মা।
চাচা! আমি যে আপনাকে স্বপ্নের দেখা মার্জিয়ার কথা বলেছিলাম, মার্জিয়া এখন আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কথা বলতে বলতে তার চোখ দু’টি বন্ধ হয়ে আসে। আর আমি অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকি....
-এটি