শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


নবীন ফারেগীন: গায়রে হাফেজরা অশুদ্ধ তেলাওয়াতের জন্য আঁটকে যান!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কওমি মাদরাসায় প্রায় ১০ বছরের সিলেবাস শেষে প্রতি বছরই ফারেগ হন অসংখ্য শিক্ষার্থী। মাওলানা উপাধী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দীনি খেদমতে। তবে নতুন ফারেগীন অনেকেরই কুরআন তেলাওয়াতে অশুদ্ধতা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ যতটা না সাধারণের, তারচে’ বেশি মাদরাসা মুহতামিমদের।

তারা বলেন, আমরা উস্তাদ নিয়োগের ক্ষেত্রে শুদ্ধ তেলাওয়াতকে প্রাধান্য দেই। কিন্তু ইন্টারভিউতে দেখা যায়, অনেক নবীন আলেমদের কুরআন তেলাওয়াতে সমস্যা রয়ে গেছে। দীর্ঘ দশ বছর পড়েও কুরআনুল কারীম শুদ্ধ করে পড়তে পারেন না তারা।

মাদরাসা মুহতামিমদের এমন অভিযোগ কতটা সঠিক? কিংবা আদৌ অভিযোগের সত্যতা আছে কী না? জানতে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে মুখোমুখি হয়েছিলেন বিভিন্ন মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে। তাদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন নুরুদ্দীন তাসলিম।।


 

রাকিবুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। রাজধানীর একটি মাদরাসা শিক্ষার্থী। অভিযোগকে আমলে নিয়ে আওয়ার ইসলামকে তিনি বলেন, আমাদের দেশের হাফেজরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিশ্ব-দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছে, দেশকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনন্য উচ্চতায়। তবে এটাও এক তিক্ত বাস্তবতা যে, জালালাইন, মেশকাত, এমনকি দাওরায় পড়ছেন এমন অনেক গায়রে হাফেজের তেলাওয়াতে অশুদ্ধতা আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দাওরা ফারেগের পরেও অনেকের মাঝে তেলাওয়াতে অশুদ্ধতা থেকে যায়।

তার ভাষায়, বেফাকের বোর্ড পরীক্ষায় শুধু তাইসির জামাতে তেলাওয়াতের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে; এছাড়া অন্যান্য জামাতের পরীক্ষাগুলোতে কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়টি নেই।

তবে তাইসিরের পর অনান্য জামাতে তেলাওয়াতের বিষয়টি সিলেবাসভুক্ত না করার ক্ষেত্রে মাদরাসা ও বোর্ড কর্তৃপক্ষ হয়তো বা ভেবে থাকেন, ‘একজন শিক্ষার্থী কিতাব খানায় পড়াশোনা শুরু করার আগেই নূরানী, নাজেরায় আলাদাভাবে কোরআন তেলাওয়াতে শুদ্ধতার বিষয়টি পড়ে আসেন, তাই শুধুমাত্র তাইসিরে তেলাওয়াতকে পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়,- বলে আমার ধারণা। বলছিলেন, কওমি মাদরাসা শিক্ষাথী রাকিবুল ইসলাম (ছদ্মনাম)।

তার ভাষায়, নুরানী, নাজেরায় পড়ে আসার  পরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেশকাত, জালালাইন পড়ুয়া গায়রে হাফেজদের তেলাওয়াতে অশুদ্ধতার থেকে যায়। একে পুরোপুরি অশুদ্ধতা বলা যায়না, কিছুটা সিফাত ও লাহানে সমস্যা থাকে। তাই এক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান অথবা শিক্ষাবোর্ড আলাদাভাবে বিষয়টি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।

কওমি থেকে ফারেগ হয়েছেন আরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তিনি বলছেন, নূরানী পড়ে যেসব শিক্ষার্থী কিতাবখানায় চলে যান, তারা তাইসির, মিজান, নাহবেমীর মিলিয়ে দুই, তিন জামাতে তেলাওয়াত সম্পর্কিত বিষয়গুলো পড়তে পারেন, তাও এগুলো মাদরাসাগুলোর ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বোর্ডে শুধু তাইসিরেই কোরআন তেলাওয়াতের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর নাহবেমীর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসে তেলাওয়াত সম্পর্কিত যেসব কিতাব অন্তর্ভুক্ত আছে সেগুলোও সিফাত সম্পর্কিত। এখানে সিফাতের বিষয়টিই শুধু পড়ানো হয়, তেলাওয়াতের শুদ্ধতা, অশুদ্ধতার সাথে মিলিয়ে দেখার বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায় না বলে জানালেন এই শিক্ষার্থী।

তবে এই সিফাতের বিষয়গুলোও থাকে নাহবেমীর পর্যন্ত। এরপর হেদায়াতুন্নাহু থেকে শুরু হয়ে যায় কুরআন তরজমা, জালালাইনে গিয়ে পড়ানো হয় কোরআন তাফসির।

জুবায়ের আহমদ নামে আরেকজন জানালেন, নাজেরায় এক বছর পড়ার পর অনেক সময় বয়স বেশি হওয়ার কারণে কোন কোন শিক্ষার্থী কিতাব খানায় ভর্তি হয়ে যায়, কোরাআন শুদ্ধ করার বিষয়টি আসলে এক বছরে পড়েই সম্ভব নয়; তবে এসব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে বয়স ও বিভিন্ন দিক বিবেচনায় কিতাব খানায় নিয়ে নেওয়া হয়। দেখা যায়, এই শিক্ষার্থী কিতাবখানার প্রত্যেকটি সাবজেক্টে মোটামুটি ভালই করছেন, তবে অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনার চাপ, অমনোযোগিতা ও সিলেবাসে তেলাওয়াতে শুদ্ধতার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত না থাকায় তেলাওয়াতের দিকটিতে তার আর গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

কিতাবখানার পুরো সিলেবাসে তেলাওয়াতে শুদ্ধতার বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়াই গায়রে হাফেজদের তেলাওয়াতে  অশুদ্ধতা থেকে যাওয়া একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে হাফিজুর রহমান (ছদ্মনাম) নামে জালালাইন পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলছেন, সামগ্রিক দিক বিবেচনায় দেখা যায়, আমাদের মাদ্রাসাগুলোর কিতাব বিভাগে প্রায় ১০ বছরের সিলেবাস। এই ১০ বছরের সিলেবাসে কিতাবের এবারত ও  আরবি পড়ার যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। এই পুরো সিলেবাসে তেলাওয়াতে শুদ্ধতার বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায় না। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে -কিতাব খানায় আসার আগে প্রায় তিন বছর নূরানী, নাজেরা পড়ে পড়ে আসেন গায়রে হাফেজরা।  কোরআন শরীফ সহি শুদ্ধ করার জন্য যেহেতু নুরানি, নাজরায় আলাদাভাবে পড়াশোনা করানো হয়, তাই কিতাব খানায় আসার পর পুরো সিলেবাসে কোরআন তেলাওয়াতে শুদ্ধ, অশুদ্ধতার বিষয়টি খেয়াল করা হয় না, যেহেতু আগেই একজন শিক্ষার্থী কোরআন শুদ্ধ করার জন্য নূরানী, নাজরায় পড়ে এসেছেন।

তবে নূরানী, নাজেরা পড়ে আসার পরেও যেহেতু গায়রে হাফেজদের তেলাওয়াতে অশুদ্ধতা থেকে যাচ্ছে, তাই কিতাব খানায় ভর্তির শুরুতেই পুরো সিলেবাসে বিষয়টিকে জোর দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ফারেগ হয়ে যাওয়ার পরেও গায়রে হাফেজদের তেলাওয়াতে অশুদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট আযাদ দ্বীনি এদারার মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছির বলেন, হায়াতুল উলিয়া সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পরীক্ষায় কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। অন্যান্য বিষয়ে পাশের পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াতেও ছাত্রদের পাশ করতে হবে।

তিনি বলছেন, ‘এর আগে হয়তো গায়রে হাফেজদের তেলাওয়াতে কিছুটা অশুদ্ধতা ছিল, তবে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষায় অন্তভূক্ত করায় এই সমস্যা থাকবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে’।

গায়রে হাফেজ যেসব শিক্ষার্থীদের তেলাওয়াতে অশুদ্ধতার থেকে যায় তাদের শুদ্ধতার জন্য সিলেবাসে আলাদাভাবে কিছু যোগ করা যায় কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নূরানী, নাজেরা মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা মোটামুটি তিন বছর কোরআন শরীফ তেলাওয়াতে শুদ্ধতার উপর মেহনত করেন, এছাড়া সিলেবাসেও মোটামুটি কিছু কিছু বিষয় যুক্ত করা আছে, এখন আবার নতুন করে হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষায় কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাই সিলেবাসে আলাদাভাবে তেলাওয়াত সম্পর্কিত কিছু যুক্ত করা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না’।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ