।।মাসুম আবদুল্লাহ।।
সরকারী-বেসরকারী সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষাবর্ষ জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর। অপরদিকে বাংলাদেশ ও পাক-ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের প্রায় সকল কওমী মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ শাওয়াল থেকে রজব। বা রমজান। যা হিজরী শিক্ষাবর্ষ নামে পরিচিত। এ হিসেবে ১৪৪২-৪৩ হিজরী শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে গত ২৪ মে ঈদের দিন থেকে। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যতিব্যস্ততা শুরু হয়েছে ১৮/১৯ মে ২০২১ থেকে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে সবকিছু থমকে থাকলেও মাদরাসাগুলোর কার্যক্রম চলছে নিজ গতিতে। স্বাভাবিক গতিতে না হলেও সীমিত পরিসরে। অফলাইন বা অনলাইনে। আমরা এখন নতুন শিক্ষাবর্ষে আছি। নতুন বছরে প্রতিনিয়তই আমরা নতুন কিছুর সঙ্গে পরিচিত হই। নতুন অনেক কিছুই বরণ করে নেই। বিশেষত আমাদের শিক্ষার্থীরা। তাদের জীবনে নতুন বছর মানে জীবনের নতুন অধ্যায়। নয়া ধাপ। নতুন পড়াশোনা। নতুন অনুভূতি। নয়া স্বপ্ন। নতুন শিক্ষক নব আঙ্গিনাসহ নতুনের ছড়াছড়ি।
নতুন বছরে প্রতিজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরই কম-বেশি নতুন প্ল্যান ও কর্মসূচি থাকে। যেগুলোর কোনোটি ঠিক। আবার কোনোটি হয়ত বেঠিক। কোনোটি বিবেচ্য। আবার কোনোটি অবিবেচ্য। হয়তবা পুনঃবিবেচ্য। নতুন বছরে একজন আদর্শ ছাত্রের কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ? সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার করণীয়-বর্জনীয় কি? সার্বিক বিবেচনায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? এ সংক্রান্ত দু’চারটি কথা ক্ষুদ্র পরিসরে আরজ করছি।
নিজেকে চিনুন-জানুন
আমাদের সমাজে প্রত্যেক মানুষ তার কাজ ও পেশা দিয়ে পরিচিত হয়ে থাকেন। তার কাজ-পেশার দ্বারাই তিনি সম্মানিত বা অবহেলিত হয়ে থাকেন। যে কৃষি কাজ করে তিনি কৃষক বা কৃষাণ। যে মজুরি নিয়ে কাজ করে তিনি দিন মজুর। আর যে শ্রম দেয়—তাকে আমরা শ্রমিক বলি। যে ব্যবসা করে তাকে আমরা ব্যবসায়ী নামে ডাকি। যে আইন নিয়ে আছেন তিনি আইনজীবি। যিনি গবেষণা করেন তাঁকে আমরা গবেষক বলি। সুতরাং যারা একাজগুলো করেন না, তাদের নাম ভিন্ন কিছু। একাজগুলো করলেই কেবল তাদের নাম এগুলো। এ নামেই তারা পরিচিত। নতুবা তাদের নাম অন্য কিছু। যে যে কাজ করে সে অনুযায়ী তাকে নাম দেয়া হয়। বা তার নাম পড়ে যায়। সে অনুপাতে তার মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করা হয়। তদ্রুপ, যে ইলমে ওয়াহী তথা দীনি জ্ঞান অর্জন করেন তাকে আমরা তালিবুল ইলম বা ছাত্র-শিক্ষার্থী বলি।
আপনার পরিচয় তখনই তালিবুল ইলম হবে—যখন আপনি ইলম তলব করবেন। দীনি জ্ঞান শিখবেন। চর্চা করবেন। শুধু মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার দ্বারা বাহ্যত হয়ত আপনার এ নাম দেয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আপনি তালিবুল ইলম বা মুতাআল্লিম নন। সেই সঙ্গে তালিবুল ইলমের যত মর্যাদা ও সম্মান কুরআন-হাদীসে বর্ণিত তা আপনার বেলায় প্রযোজ্য নয়—যদি আপনার ভেতরে এ পরিচয় ও এ পরিচয়ের কাজ না থাকে। আর যদি আপনার ভেতরে তা পাওয়া যায় তবে নিঃসন্দেহে আপনি তালিবুল ইলম। আর আপনি তালিবুল ইলমের মর্যাদায় সমাসীন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন—আর যাদেরকে ইলম দেয়া হয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে অনেক অনেক মর্যাদা। [সুরা: মুজাদালাহ, আয়াত: ১১]
হাদীস শরীফে আছে—আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকেই দীনের বুঝ ও জ্ঞান দান করেন। [বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭১]
অপর এক হাদীস শরীফে আছে—যে ব্যক্তি দীন শেখার কোনো পথে পা বাড়ালো, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ করে দেন। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৬৪৬]এ ছাড়াও অসংখ্য আয়াত ও হাদীস শরীফ রয়েছে—যা একজন তালিবুল ইলম তথা দীনি ইলমের শিক্ষার্থীদের মান-মর্যাদা সুস্পষ্ট করে।
আপনি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্বাচিত। আপনি নবীজির ওয়ারিশ। আপনার সম্মানে ফেরেশতাগণ তাদের ডানা বিছিয়ে দেয়। আপনার জন্য সৃষ্টিকুল আল্লাহর দরবারে দোয়া করে। আপনি একজন জান্নাতের পথের অভিযাত্রী। আপনার উপর আল্লাহর খাছ রহমত ও দৃষ্টি রয়েছে।
হযরত ওমর রা. বলেন—তোমরা ইলম অর্জন করো। পাশাপাশি সহনশীলতা ও গাম্ভির্যতা অবলম্বন করো। যার থেকে ইলম শিখেছো—তার প্রতি বিনয়ী হও। [মাজমাউয যাওয়ায়েদ] ইমাম আবু হানিফা রহ. তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন—তোমরা তোমাদের পাগড়ি বড় করবে। জামার আস্তিনকে বিস্তৃত করবে। [তালিমুল মুতাআল্লিম-এর সূত্রে, পৃষ্ঠা: ২৯] তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে এ উপদেশ দিতেন—যাতে তাদের বাহ্যিক অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ আলেম ও ইলমের প্রতি স-শ্রদ্ধ হয়। ইলম ও আলেম-ওলামাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে না দেখতে পারে।
অতএব—আপনি আপনাকে চিনুন। আপনার পরিচয় ও কাজ বুঝুন। আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হোন। আপনি আপনার মর্যাদা বুঝুন। আপনার পোশাক-পরিচ্ছদ, লেবাস-সুরত, আমল-আখলাক ও চলাবলা—সে মাপের কিনা মিলিয়ে নিন। নিজের মাঝে আমূল পরিবর্তন আনুন। ভেতরে-বাইরে পরিবর্তন আনুন। আপনি জাহের ও বাহিরকে ঠিক করে নিন। আল্লাহ তায়ালা তার নিজ দয়ায় ভেতরাত্মাকে শোধরে দেবেন— ইনশাআল্লাহ!
নিজেকে বিশুদ্ধ করুন
আপনি আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত। আপনি আল্লাহর নবীর গর্বিত ওয়ারিশ। আপনি তার নায়েব। তাই আপনার বাহিরকে পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি আপানার ভেতরকেও আপনি বিশুদ্ধ করে নিন। আপনার দাড়ি-টুপি, জামাকাপড়, চলা-বলা, লেনদেন সুন্নত মোতাবেক করার পাশাপাশি আপনি আপনার মনকে ঠিক করুন। বাহ্যিক-আত্মিক সব গোনাহ পরিহার করুন। আত্মাকে সব ধরনের আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখুন। অহংকার, লোভ-হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, পরনিন্দা-সহ সব দোষ থেকে
নিজেকে মুক্ত করে ফেলুন।
অন্তত বছরের শুরুতেই আপনি আপনার নিয়ত ঠিক করে নিন। মাদরাসায় কেনো পড়ছেন? নিশ্চয়ই ইলম শিখতে। আমল শিখতে। আল্লাহকে খুশি করতে। পার্থিব কোনো স্বার্থে ইলম শিখছেন না—অন্তত এইটুকু ঠিক করে নেন। বাকিটা না হয় ধীরে ধীরে করুন। কোনো পীর-বুযুর্গের সোহবতে গিয়ে শিখুন। সময় নিয়ে আস্তে আস্তে অর্জন করুন। যে-করেই হোক নিজেকে বিশুদ্ধ করুন। নিজের ভেতর-বাহির শোধরে নিন। সর্বান্তকরণে হয়ে ওঠুন পরিশুদ্ধের মাপকাঠি।
বদলে ফেলুন নিজেকে
মানুষ মাত্রই অপূর্ণ। নানা গুণের ভিড়েও হাজার দোষে দোষী। মানুষের নানা অভাব ও ত্রুটি থাকা অনিবার্য। তবে আমাদেরকে ধরে ধরে ধীরে ধীরে সে-সব অপূর্ণতাকে দূর করেতে হবে। অযোগ্যতাগুলোকে একে একে যোগ্যতায় রূপান্তরিত করতে হবে। এক লাফে তো আর গাছের আগায় ওঠা যায় না। তাই অল্প অল্প করে আমাদের দোষ-ত্রুটি ও অপূর্ণতাগুলোকে দূর করতে হবে।
ধরুন! আপনি বিশুদ্ধ বাংলা লিখতে-বলতে পারেন না। আপনার তেলাওয়াত সুন্দর না। আন্তর্জাতিক মানের না। অনুরূপভাবে আপনি আরবী বলতে ও লিখতে পারেন না। আরবী ইবারত বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারেন না। নাহু-সরফ ও গ্রামার আপনি বুঝেন না। আপনার মাথায় ঢুকে না। আপনার আরবী-বাংলা ও উর্দু বা ইংরেজী হাতের লেখা সুন্দর না। আরো নানা ত্রুটি আপনার থাকতে পারে। আপনি অনেক কিছুই পারেন না। আপনি একদম ভাববেন না! কোনো অসুবিধা নেই! আপনার দুয়ারে নতুন বছর এসেছে নতুন বার্তা নিয়ে। নতুন সুযোগ নিয়ে। নতুন পথ নিয়ে। আপনি বছরের শুরুতেই টার্গেট নির্ধারণ করুন। টার্গেট পূরণে স্বপ্ন দেখুন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে পরিকল্পনা করুন। পরিকল্পনার জন্য মুরব্বীর সঙ্গে পরামর্শ করুন। উস্তাদের শরণাপন্ন হোন। সঠিক
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। সঠিক নিয়ম মেনে চলুন। অল্প অল্প করে পথ চলুন। ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হোন। মেহনতে অভ্যস্থ হোন। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহর জাতের উপর পূর্ণ আস্থা রাখুন। দেখবেন— আপনার সব অপূর্ণতা একসময় পূর্ণতায় রূপ নিয়েছে। আপনার অযোগ্যতাগুলো একে একে যোগ্যতার রূপ নিয়েছে—ইনশাআল্লাহ!ৎ
হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. সম্ভবত হায়াতুল মুসলিমীন কিতাবের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন—মানুষ চাইলেই যে-কোনো নেকি অর্জন করতে পারে। চাইলেই সে যে-কোনো গুনাহ ছাড়তে পারে। প্রয়োজন শুধু তার ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্পের। মানুষ নিজে থেকে চাইলে সব করতে পারে। চাওয়ার মতো চাইলে মানুষ সব করতে পারে। ধরতে পারে। ছাড়তেও পারে। ভাঙতে পারে। আবার গড়তেও পারে। উম্মাহের দরদী কাণ্ডারী উস্তাদে মুহতারাম আল্লামা নুর হুসাইন কাসেমী রহ. বলতেন, ছাত্র যদি সিদ্ধান্ত নেয়— আমি পড়বো। আমি আমাকে গড়বো। তবে পৃথিবীর কেউ তার উন্নতি ঠেকাতে পারবে না। এর বিপরীতে ছাত্র
যদি সিদ্ধান্ত নেয়—আমি পড়বো না। আমি আমাকে যোগ্য বানাবো না। আমাকে আমি প্রতিষ্ঠিত করবো না। তবে পুরো দুনিয়া মিলেও তাকে পড়াতে পারবে না। তাকে গড়তে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন—‘আল্লাহ কোনো গোষ্ঠীকে ততক্ষণ বদলান না, যতক্ষণ না তারা নিজেদেরকে বদলায়।
[সুরা: রা’দ, আয়াত: ১১]
অতএব, আসুন! আমরা আমাদেরকে বদলে ফেলি। আসুন! নিজেকে যোগ্য করে গড়ার নির্দিষ্ট পথে পা রাখি। নিজেদের যোগ্যতা ঝালাই করে নিই। সমূহ অপূর্ণতাকে পরিকল্পনা করে উস্তাদের দিক-নির্দেশনায় নিজেকে একদম বদলে ফেলি। ভেতরে-বাইরে যোগ্য হই। গেলো বছরের তুলনায় এ বছর আরেকটু যোগ্য হই। আরও একটু সবল হই। আল্লাহ আমাদের বদলাতে সাহায্য করবেন—ইনশাআল্লাহ!
লক্ষ্য স্থির করুন
একজন ছাত্রের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো নিজ জীবনের লক্ষ্য স্থির করা। আপন জীবনের টার্গেট ও গন্তব্য ঠিক করা। অন্তত লক্ষ্যটা এতো স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়—যাতে তার লক্ষ্য তার চোখের সামনে ভাসে। তার হৃদয় পটে ছবির মতো সদা ভেসে থাকে। জীবনের লক্ষ্য তার মননে সবসময় এতটা জাগরুক হয়ে থাকে—যা তাকে তার গন্তব্যের পথে হাঁটতে বাধ্য করে। বরং হাত ধরে ধরে তাকে তার স্বপ্ন সাধনে রাহবরি করে। কম বয়সি বা বেবুঝ ছাত্ররা তো তার পড়াশোনার কোনো লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। সম্ভবও না। কিন্তু বুঝমান ছাত্রদের অপরিহার্য কর্তব্য হলো—নিজ জীবনের লক্ষ্য স্থির করা। এবং এ লক্ষ্য পূরণে পরিকল্পনা তৈরি করা। হতে পারে এ পরিকল্পনা দীর্ঘ মেয়াদী। বা স্বল্প মেয়াদী। অন্তত প্রতি বছরের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য বছরের শুরুতেই
স্থির করা উচিৎ।
একজন ছাত্রের প্রথম কাজ—লক্ষ্য স্থির করা। প্রতিটা কিতাবের প্রতিটি শব্দ-লাইন সঠিকভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে পড়তে পারা এবং তার যথাযথ অর্থ-মর্ম উদঘাটন করাই একজন ছাত্রের প্রথম টার্গেট। যোগ্য আমলওয়ালা আলেম হওয়াই একজন ছাত্রের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মেহনতের ছক আঁটা উচিৎ বছরের শুরু থেকেই। স্বপ্ন দেখুন—স্বপ্নকে ধাওয়া করুনএপিজি আবদুল কালাম বলেছেন—‘সেটা স্বপ্ন নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে। স্বপ্ন সেটা যেটা মানুষকে ঘুমাতে
দেয় না’। একজন মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে কেবল তখনই সে স্বপ্নের পেছনে ছুটে। আর যখন কেউ স্বপ্নপূরণে স্বপ্ন ধাওয়া করে। তার জীবনে আসে নতুন গতি। কাজে আসে নতুন উদ্যোমতা। জীবনে থাকে আকুলতা ও ব্যাকুলতা। নানা ছোটাছুটি ও চাঞ্চল্যতা।
পক্ষান্তরে কারও সামনে যদি স্বপ্ন না থাকে তবে তার মন জমে যায়। স্থবিরতা তাকে অক্টোপাসের মতো জাড়িয়ে নেয়। যার পরিণতি অলসতা ও অকর্মন্যতা। একটি পশুর কোনো স্বপ্ন নেই। তাই তার একমাত্র কাজ—খাওয়া-হাগা। ঘুমাতে ঘুমাতে সে এ কাজ দু’টোই করে। আবার ঘুম থেকে ওঠতে ওঠতেও একাজই করে। কিন্তু মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে
থাকে।
পশু-মানুষের ব্যবধান এখানেই। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। স্বপ্নের জন্য জীবন দেয়। মরার ভয় ত্যাগ করে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলে। দুঃখ-যাতনা মাড়িয়ে চলে। হাজার কষ্ট-যন্ত্রণা সয়ে বেড়ায় শুধু স্বপ্ন পূরণে। নিবাস-প্রবাসের সব নিঠুর হাড়ভাঙ্গা-মনভাঙ্গা খাটুনি বরণ করে শুধু এ স্বপ্নের তাড়নায়। তাই খেয়ে না খেয়ে সে তার স্বপ্ন সাধন করে। ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে সে তার স্বপ্ন পূরণে কসরত করে। একজন ছাত্রের জীবনে সফলতা কেবল তখনই ধরা দেবে, যখন সে স্বপ্ন দেখবে। স্বপ্নপূরণের অনুকূলে চেষ্টা করবে। তা না হলে জীবন পার হবে। খাওয়া-নাওয়া হবে। কিন্তু কোনো সাধন হবে না। এক পর্যায়ে হতাশা আর আক্ষেপ নিয়েই শিক্ষা জীবন শেষ হবে। অযোগ্যতা আর নানা অপূর্ণতা নিয়ে মাদরাসা থেকে বের হতে হবে। যার পরিণতি কম-বেশি সবারই জানা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন!
স্বপ্ন সাধনে নিখুত পরিকল্পনা করুন
আপনার জীবন আপনার। আপনার অর্জন আপনার। আপনার জীবন রাঙ্গাতে যেমন আপনার লক্ষ্য স্থির করা জরুরি। ঠিক আপনার লক্ষ্য ও স্বপ্ন পূরণে সঠিক পরিকল্পনাও জরুরি। বরং অত্যাবশ্যক। আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণের পথ নির্দিষ্ট করুন। ছক আঁকুন। পরিকল্পনা করুন। নিখুত পরিকল্পনা আপনার স্বপ্ন সাধনে সহযোগিতা করবে। আপনার স্বপ্ন আপনার মুঠোয় পুরে দেবে—ইনশাআল্লাহ। প্ল্যান ছাড়া বিল্ডিং নির্মান করা যায় না। রেলপথ ছাড়া রেলগাড়ি চলে না। নিদৃষ্ট আকাশপথ ছাড়া বিমান চলা দুরূহ। তদ্রƒপ সুসংহত সুশৃঙ্খলিত ও সুপরিকল্পনা ছাড়া উন্নত স্বপ্ন বাস্তবায়ন দুরূহ বরং অসম্ভব। পরিকল্পনা যত নিখুত ও নির্ভুল হবে, স্বপ্ন পূরণও তত নিশ্চিত ও অবধারিত হবে। আর পরিকল্পনার ভুল-বিচ্যুতি স্বপ্ন সাধনকে করবে ব্যহত ও দুর্লভ।
চাই মুরব্বীর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ন
একটি সঠিক সিদ্ধান্ত একজন ছাত্রকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। এর বিপরীতে একটি ভুল সিদ্ধান্ত একজন ছাত্রকে অবনতির আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে। তাই যথাসময়ে যথাযথ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারাটা—ছাত্র কেনো—যে কারো জীবন রাঙাবার মহা নিয়ামক। আর এ মহা দায়িত্ব একজন ছাত্রের নিজের কাঁধে রাখাটা বিপজ্জনক। কারণ, ছাত্র বা শিক্ষার্থীর বোধ চেতনা খুবই সীমিত। তার জানার পরিধিও অল্প। একান্ত আপন লোকজনের পরিসরও ছোট্ট। সর্বপরি সব বিষয়ে সে অপরিপক্ক। অনভিজ্ঞ ও অপরিনামদর্শী। অথচ জীবনের নানা বাঁকে তাদেরকেও থামতে হয়। নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় নিজের অজান্তেই। আর
এসব থমকে যাওয়া মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয় খুবই সতর্কতার সাথে।
সুতরাং এমন সিদ্ধান্তটা যদি ছাত্র নিজে না নিয়ে তার কোনো প্রাজ্ঞ-অভিজ্ঞ গুরু নিয়ে দেয়—তবেই তো ভালো। বরং নিরাপদ। একটি গাড়ি যেমন ড্রাইবার বা নিয়ন্ত্রণকারী ছাড়া চলতে পারে না। সে যত উন্নত গাড়িই হোক। একটি নাও- নৌকা যেমন মাঝি-মাল্লা ছাড়া চলতে পারে না। যত আধুনিক ও উন্নত হোক। যত সুন্দর ও শক্তই হোক না কেনো—সঠিকভাবে চলতে পারে না। ঠিক একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা-তরীও একজন অভিজ্ঞ নাবিক ছাড়া চলতে পারে না। একজন ছাত্রের শিক্ষাজীবনে সফল হতে বা সফল ছাত্র জীবন পার করতে একজন মুরব্বীর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ছোট শিক্ষার্থীদের মুরব্বি তো তাদের মা-বাবা বা ভাই কিংবা তার উস্তাদ। কিন্তু যারা বড় শিক্ষার্থী বা যারা বুঝমান তাদের উচিৎ নিজের একজন তালিমি মুরব্বি ঠিক করে নেয়া। যার তত্ত্বাবধানে থেকে একজন ছাত্র তার জীবনের লক্ষ্য ছুবে। তার স্বপ্ন পূরণ করবে। তার জীবনের সব পরিকল্পনা করবে। জীবনের সব সিদ্ধান্ত তাঁর পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় সম্পন্ন করবে। নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনসাধনায় এমন একজন মুরব্বীর প্রয়োজনীয়তা সর্বস্বীকৃত। এ মুরব্বী যে কেউকে বানানো যেতে পারে। দূরের-কাছের যে-কোনো উস্তাদকে বানানো যায়। উস্তাদের বাইরেও কাউকে বানানো যায়। কেবল দু’টো গুণ থাকা লাগবে। ক. ইস্তে’দাদ ও যোগ্যতা। খ. শফকত ও দরদ। যোগ্যতাসম্পন্ন দরদী যে কাউকে নিজের জীবনের মুরব্বী বানানো যেতে পারে।
শুধু দরদী বা শুধু যোগ্য এমন কাউকে মুরব্বী নির্বাচন করা হলে কাঙ্খিত ফল অর্জন করা সম্ভব হবে না। যোগ্যতার পাশাপাশি যদি দরদী কাউকে পাওয়া যায় তাকেই মুরব্বী নির্বাচন করা হবে। তিনি দূরে থাকেন বা কাছে। নিজ মাদরাসার বা ভিন্ন মাদরাসার—তাতে কোনো অসুবিধা নেই। যোগ্যতার কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আর দরদী হওয়ার কারণে সিদ্ধান্তে খেয়ানত করবেন না। তাই এই দুই গুণের অধিকারী যে কাউকে মুরব্বী নির্বাচন করে নিজের জীবনের লাগাম তার হাতে দিয়ে দিতে হবে। এবং শতভাগ তাঁকে জানিয়ে সবধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
তবেই আশা করা যায়—একজন ছাত্রের পড়াশোনায় বিচ্যুতি ঘটবে না। খুব দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। তরতর করে সে তার গন্তব্যে ছুটবে। স্বপ্নের যাত্রাপথে বেগবান হবে। সর্বপরি ঝুট-ঝামেলা ও জটিলতা মুক্ত নিরাপদ জীবন লাভ করবে—ইনশাআল্লাহ!
লেখক- মুহাদ্দিস, দারুল উলুম বনশ্রী, ঢাকা।
-কেএল