আবদুর রশীদ
মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানব জাতির জন্য যখন কোনো কিছু হালাল করেছেন, তখন তা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন৷ অর্থাৎ- আনলিমিটেড৷ আর যখন কোনো কিছু হারাম করেছেন, তখন একটা একটা নাম ধরে নির্দিষ্ট করে হারাম করেছেন৷ অর্থাৎ- লিমিটেড৷ আর যখন আল্লাহ তা'য়ালা কোনো একটা হারাম করেছেন, সাথে সাথে এর বিকল্পে অন্য কিছু সেট করেছেন৷ উদাহরণস্বরূপ- যিনা বা ব্যভিচার করা হারাম; এর বিকল্পে বিবাহ হালাল ইত্যাদি৷ অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'য়ালা সুদ করেছেন হারাম; এর বিকল্পে ব্যবসা করেছেন হালাল৷
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন৷ (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত-২৭৫)
সুতরাং, যখন আল্লাহ তা'য়ালা কোনো কিছুকে হালাল সাব্যস্ত করেন; কারো সাধ্য নেই তা হারাম করার৷ আর যা হারাম করেছেন; কারো সাধ্য নেই তা হালাল করার৷ অতএব, মানুষ ব্যবসা করতে গিয়ে যদি তাতে হারামের মিশ্রণ ঘটায় তাহলে ব্যবসা হালাল হলেও তা হারামে রূপ নেই৷ আর যে ব্যক্তিই এমনটা করবে আল্লাহ তা'য়ালা তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের ভয়াবহতা৷
মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায় । আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত-২৭৫)
বর্তমান ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভেজাল সংযুক্তকরণ, প্রতারণা ও মিথ্যা শপথের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় ৷ ব্যবসার বিভিন্ন সেক্টর রেয়েছে আর প্রতিটি সেক্টরে সাধারণ পদ্ধতিতে কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হারামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাপাক অর্থ উপার্জনে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খুব বেশি তৎপর ৷
প্রিয় ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, আপনারা হয়তো ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন৷ সারাদিন পরিশ্রম করেন অর্থের তাগিদে৷ পরিশ্রমটা যদি বিফলে যায় তাহলে এর মূল্য কিইবা আছে!
ধরুন, মাসিক বেতনে একটি চাকরি করেন এবং মাস শেষে উক্ত চাকরির বেতন থেকে কোনো ফল্টের দরুন বহিষ্কৃত হলেন, তাহলে আপনার অবস্থানটা কোন পর্যায়ে দাঁড়াবে? তদ্রুপ হালাল উপার্জনের তাগিদে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন এবং পরিশ্রম শেষে অর্থ ও খাদ্য নিয়ে বাড়িতে ফিরেন৷ কিন্তু, পরিশ্রমের টাকা হারাম উপায়ে অর্জিত হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ অর্থ ও খাদ্যগুলো কোনো হালাল কাজের পরিচয় বহন না করে হারাম কাজের পরিচয় বহন করে থাকে৷ পরকালে যখন উপস্থিত হবেন তখন দেখবেন যে, সব উপার্জনই ছিল হারাম, যে উপার্জন ছিল পরিশ্রমের কষ্টিপাথরে গড়া এবং আমলনামার খাতায় সাওয়াবের পরিবর্তে হারাম লিখা থাকার মুহূর্ত বড়ই বিষাদের হবে সেদিন! আর ঐ মুহূর্তে দুঃখ এবং আপসোস করেও কোনো কাজে আসবে না।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত: নবী (সা:) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে। (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০৫৯)
তাই আসুন, ইসলাম আমাদের এই সম্পর্কে কী তথ্য পরিবেশন করেছেন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন বিষয়ের প্রতি সঠিক জ্ঞান রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করার ফলাফল জানার চেষ্টা করি৷ এই পর্যায়ে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীদের বৈশিষ্ট্যের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি যে ব্যবসায়ীদের ফলে উক্ত ব্যবসা হালাল থেকে হারামে রূপ নিচ্ছে৷
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত- ১-৩)
উপরোক্ত আয়েতের শিক্ষা হলো "ওজনে কম না দেয়া৷ এই আয়াতে হুশিয়ারির মাধ্যমে আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের সতর্ক করেছেন যেন আমরা মাপে কম না দেয় ৷ যখন ব্যবসায়ীগণ নিজেরা পণ্য ক্রয় করেন তখন পূর্ণ মাত্রায় তা ওজন করে নেন৷ কিন্তু অন্যকে বিক্রির সময় ওজন কমিয়ে দেন৷ এটা চরম প্রতারণা এবং হক্ব নষ্ট৷ বর্তমান এই রোগটা এত বেশি প্রচলিত যার থেকে রেহায় পাওয়ার সম্ভাবনা দুরূহ৷ আপনি যখন কোনো ক্রেতাকে পণ্য বিক্রি করেন, তখন ওজনের সময় একটি চাউলের দানা পরিমাণও যদি কম দেন তা আপনার ওপর ততক্ষন পর্যন্ত হক্ব থেকে যাবে যতক্ষন না তাকে তার হক্ব পূর্ণ করে দেন কিংবা সে আপনাকে ক্ষমা করে দেন৷ অন্যথায়, কিয়ামতের দিন তার হক্ব পরিশোধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে নিশ্চিত৷ আর তা কখনো পণ্যের মাধ্যমে হবে না; বরং আপনার আমলের বিনিময়ে পরিশোধ করা হবে৷ কেননা সেখানে কোনো পণ্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে না৷
ব্যবসায় লেনদেন করার ক্ষেত্রে ওজনে কম দেওয়া এবং ঠকানোর মাধ্যমে একজন ক্রেতার হক্ব নষ্ট করা হয় যা তার অধিকার এবং সেটা তার সম্পদ৷ ক্রয়কৃত প্রতিটি দানা ক্রেতার সম্পদ৷ একটা দানার মাধ্যমেও প্রতারণা করা হলে তা অবশ্যই তার সম্পদ নষ্ট করা হবে৷
এই জন্য আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। (সূরা আন-নিসা, আয়াত-২৯)
অন্যত্রে বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন। (সুরা নাহল, আয়াত-৯০)
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
কিছু ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্য একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ৷ আর তা হলো জুলুম করা ৷ অর্থাৎ- একটা পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে সেটা বিক্রি করার সময় ৩/৪ গুণ দামে বিক্রি করা ৷ নিশ্চিত একজন ক্রেতার ওপর এটা বড় জুলুম ৷ জুলুমের হাজার প্রকার-পদ্ধতি থাকতে পারে ৷ মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জুলুমের শিকার হতে পারে ৷ কিন্তু, জুলুম শুধু জুলুমই হয়ে থাকে ৷
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না ।’ (সুরা আনআম, আয়াত-৫৭)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে ।’ (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত-২২৭)
হাদীসে এসেছে, আবু জার গিফারি (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা:) তাঁর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন । আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা ! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি । অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৭৩৭)
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে পণ্য বিক্রি করা একটা অন্যতম জঘন্য প্রতারণা ৷ বিশেষত, এই প্রতারণা করার টেকনিক হলো- ১০টা ভালোর মধ্যে ১/২টা ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেওয়া যা সাধারণত আলাদা করে বিক্রি করা সম্ভব না ৷ এই ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ ৷
হাদীসে এসেছে, নবী (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে । (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং- ২২৪৭)
এ ছাড়াও পণ্যের ত্রুটি গোপন করার মধ্য দিয়েও ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত কমে যায় ৷ হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, হাকীম ইবনু হিযাম (রা:) থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রসূল (সা:) বলেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের ইখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা) । যদি তারা সত্য বলে এবং অবস্থা ব্যক্ত করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয় । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০৭৯, ২০৮২)
একজন সৎ ব্যবসায়ীর আদর্শ কেমন হওয়া উচিত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ঈমাম আবু হানীফা(রহ.)-এর একটি ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব ৷
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন অতি উঁচু আদর্শ ধারণকারী একজন ব্যবসায়ী । একবার তিনি তাঁর ব্যবসার সহযোগীকে কিছু পণ্য বিক্রির জন্য এই মর্মে নির্দেশনা দিয়ে পাঠান যে, এর মধ্যে যেসব পণ্য ত্রুটিপূর্ণ তা যেন ক্রেতাদের দৃষ্টিগোচরে এনে বিক্রি করা হয় । ব্যবসার সহযোগী এই নির্দেশনা ভুলে গিয়ে সমস্ত পণ্যই বিক্রি করে ফিরে আসেন । ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এই পণ্যসমূহের বিক্রিলব্ধ অর্থ গ্রহণ না করে সমুদয় অর্থ (৩৫০০০ দিরহাম) দান করে দেন । তাঁর কাছে কোনো বিক্রেতা অজ্ঞতাবশত বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে কোনো পণ্য বিক্রি করতে আসলে তিনি তাদেরকে সঠিক মূল্য অবহিত করে সেই মূল্যেই সেগুলো খরিদ করতেন ৷
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
মিথ্যা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা ৷ এই জুয়াচুরি বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করা যায় কাপড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করে যখন রমজান মাস উপস্থিত হয় ৷ ঈদের কেনা-কাটা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, তারা এর সুযোগ ব্যবহার করে বেশি অর্থ আয়ের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকেন ৷ ভিন্ন ভিন্ন কথার কারিশমা দিয়ে বলে যে, ভাই, ওয়াল্লাহ ! আমার এই জিনিসটার ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; না হয় আমাদের লস হবে ৷ অথবা বলে যে, আপনাকে একেবারে কেনা দরে দিয়ে দিচ্ছি ইত্যাদি আজব কথাবার্তা ও মিথ্যা শপথের মাধ্যমে ব্যবসা করা সম্পূর্ণ প্রতারণা এবং তা জঘন্য পাপ ৷ এই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের প্রচণ্ড ভয়াবহ ৷
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবু জার (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (সা:) বলেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি । তারা কারা, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী । (মুসলিম, হাদিস নং-৩০৬)
অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনু আবূ ‘আওফা (রা:) থেকে বর্ণিত: এক ব্যক্তি বাজারে পণ্য আমদানী করে আল্লাহর নামে কসম খেল যে, এর এত দাম বলা হয়েছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কেউ বলেনি। এতে তার উদ্দেশ্য সে যেন কোন মুসলিমকে পণ্যের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে পারে । এ প্রসঙ্গে আয়াত অবতীর্ণ হয়, “যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে”- (সূরা আল-‘ইমরান, আয়াত- ৭৭) । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০৮৮)
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য:
ধোঁকাবাজির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা ৷ গ্রাম্য ভাষায় একটা কথা প্রচলন আছে, "উপরে ফিটফাট, ভেতরে সতর ঘাট" ৷ বাজারে এমন এমন পণ্য বিক্রি করে থাকেন যেগুলো সাধারণত দেখতে ভালো মানের মনে হলেও; তা মূলত নকল ৷ নকল পণ্য বিক্রি করে আসল পণ্যের দর হাতিয়ে নেওয়ার মত ধোঁকাবাজির কোনো অভাব নেই ৷ দেখতে একই ব্রান্ডের মোবাইল, একই ধরনের ঔষধ, একই ডিজাইনের কাপড় ইত্যাদি ৷ এছাড়াও ভালো পণ্যের সাথে ত্রুটিযুক্ত পণ্য মিশ্রিত করে চালিয়ে দেন ৷ কেইবা ভালো চেনেন ও জানেন? অধিকাংশই ধোঁকাবাজির গর্তের শিকারে পরিণত হয় ৷ এমন ধোঁকাবাজির ব্যাপারে হাদীসে এসেছে-
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল (সা:) খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন । তিনি স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল । তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক! একি ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে । তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপর রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত । যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার দলভুক্ত নয় । (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২৯৫)
ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য:
ইহতিকার করা একটা ব্যবসার অন্যতম খারাপ বৈশিষ্ট্য৷ হাদিস ও ফিকহের ভাষায় মজুদদারিকে ‘ইহতিকার’ বলা হয়। আর মজুদদারকে বা ব্যক্তিকে বলা হয় ‘মুহতাকির’।
পারিভাষিক বিশ্লেষণ:
ফকিহগণের বিশ্লেষণ মতে মজুদদারি হচ্ছে কোন সংকট বা দুর্ভিক্ষের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করা এবং যোগান-চাহিদা ব্যহত করা । অত:পর অতিরিক্ত মুনাফায় তা বিক্রি করে দেওয়া ।
ফিকহে হানাফির বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিদায়া’ প্রণেতার ভাষায়-মজুদদারি হচ্ছে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে মূল্য বৃদ্ধির আশায় তা গুদামজাত করে রাখা ।
আধুনিক যুগের ভাষায় বলতে গেলে, মজুদদারি হচ্ছে-নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির যোগান-চাহিদার স্বাভাবিক গতি ব্যহত করা ।
বিশেষ করে এ জঘন্য চালাকির বেশী দেখা মিলেছে গত বছর করোনা চলাকালিন অভাবের সময় ৷ পূর্বে স্বল্পমূল্যে ক্রয় করা পণ্য ৩/৪ গুণ বেশি মূল্যে বিক্রির প্রবনতা সেই দূর্দিনের সময় আরো বেশি অস্তিত্ব লাভ করেছিল ৷ এমনকি সাধারণ মাস্ক পর্যন্ত যাদের গুদামজাত করা ছিল তারাও কিন্তু পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটি মাস্ক ৫-৭ গুণ মূল্য বৃদ্ধি করে অর্থ উপার্জন করেছিল ৷ এমন নোংরা মন-মানসিকতা আর লোভ-লালসা কর্তৃক ব্যবসার মধ্যে মানুষের প্রতিযোগিতার ছাপ লক্ষ্য করা যায় যা একেবারে নিষিদ্ধ ৷ এছাড়াও খাদ্যশস্য আটকানোর মাধ্যমে খাদ্য সংকট তৈরি করার পরিণামও কিন্তু ভয়াবহ ৷
হাদীসে এসেছে, সাহাবী সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব(রা:) থেকে বর্ণিত- নবী কারীম(স:) ইরশাদ করেছেন- গোনাহগার ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখেনা । (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১২৮৫)
অন্য বর্ণনায়, সাহাবী উমর রা: থেকে বর্ণিত- নবী কারীম(স:) ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাবার (দাম বৃদ্ধির আশায়) মজুদ করে রাখে-আল্লাহ তায়ালা তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি (মহামারি)ও দারিদ্রতা দিয়ে শাস্তি দিবেন । (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২১৫৫)
অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে, সাহাবী উমর (রা:) থেকে বর্ণিত-বাজারে পণ্য আমদানিকারী রিযিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদারি অভিশপ্ত হয় । (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ২০০০)
সপ্তম বৈশিষ্ট্য:
হারাম বস্তু বিক্রি করা কিংবা হারামের প্রসার ঘটিয়ে ব্যবসা করা ৷ দেশের মধ্যে কত হাজার ধরনের প্রকাশ্য হারাম ব্যবসার ঘাটি রয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই ৷ বডিং-এর নামে দেহ ব্যবসা যা প্রকাশ্য যিনা, মদের ব্যবসা, ইয়াবার ব্যবসা, জুয়ার ব্যবসা ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেনের নামে অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি ৷ মদ হারাম; তাই মদের ব্যবসা করাও হারাম, যিনা হারাম; তাই দেহ ব্যবসা হারাম, সুদ হারাম; তাই ব্যবসার নামে সুদভিত্তিক কারবার করাও হারাম ৷ অর্থাৎ- যে জিনিস হারাম তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করাও হারাম ৷
হাদীসে এসেছে, আবু মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী (সা:) কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারের বিনিময়, গণকের বকশিশ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২১২২; মুসলিম, হাদীস নং-৪০৯২)
এক নজরে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১) ওজনে কম দেয়া ২) ক্রেতার প্রতি জুলুম করা ৩) পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করা ৪) মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা ৫) ধোঁকাবাজির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা ৬) ইহতিকার করা ৭) হারাম বস্তু বিক্রি কিংবা হারাম প্রসারের মাধ্যমে ব্যবসা করা
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ও উপদেশবাণী:
হাদীসে আরো কতগুলো গুণাগুনের কথা এসেছে ৷ সেগুলো জানার জন্য নিম্নোক্ত হাদীসগুলো লক্ষ্য করি। হাদীসে বলা হয়েছে, রাসুল (সা:) গবাদি পশুর গর্ভস্থ বাচ্চা প্রসবের আগে, পশুর স্তনের দুধ পরিমাপ না করে, পলাতক দাস, গনিমতের মাল বণ্টনের আগে, দান-খয়রাত হাতে আসার আগে এবং ডুবুরির বাজির (ডুব দিয়ে যা পাবে) ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন । (ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২১৯৬)
অন্যত্রে এসেছে, ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা:) থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রসূল(সা:) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয় না করে । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২১৬৫, ৫১৫২, মুসলিম: ১৬/৫, হা: ১৪১২, আহমাদ: ৪৭২২) (আ. প্র. ১৯৯১, ই. ফা. ২০০৬)
অপর বর্ণনায় এসেছে, মিকদাম ইবনু মা’দীকারিব (রা:) সূত্রে নবী (সা:) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের খাদ্য মেপে নিবে, তাতে তোমাদের জন্য বরকত হবে । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২১২৮)
নবী (সা:) আরো বলেন, কোনো ব্যক্তি খাদ্যশস্য ক্রয় করলে সে যেন তা হস্তগত করার আগে বিক্রয় না করে । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০২৯)
সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা:
যে ব্যক্তি সৎ ব্যবসা করে এবং হালাল অর্থ উপার্জন করে আল্লাহ তা'য়ালা তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেন৷ সৎ ব্যবসার মাধ্যমে শুধু নিজেই ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকে না; বরং নিজ পরিবার-পরিজনরাও হারাম খাদ্য ও বস্তু থেকে মুক্তি পায়।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, সৎ ব্যবসায়ীর শান-মর্যাদা বর্ণনা করে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা:) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে নবীগণ সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের দলে থাকবেন।’ (জামে তিরমিজি, হাদীস নং-১২০৯) অন্যত্রে হাদীসে এসেছে, হযরত জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রসূল (সা:) বলেছেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন যে নম্রতার সাথে ক্রয়-বিক্রয় করে ও পাওনা ফিরিয়ে চায়। (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০৭৬)
হালাল উপার্জন ও উৎকৃষ্ট হতে ব্যয়: এই ধরায় জীবন ধারনের জন্য অর্থের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে খাদ্যের অভাব দূর করা হয় ৷ জীবনের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ নানান প্রকার কর্মের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৷ যদি উপার্জনটা হয় নিজ হাতের, তাহলে এর প্রতি একটু বেশিই যত্ন থাকে এবং উত্তম খাদ্য খাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি মন-মানসিকতা কাজ করে ৷ তাই, পরের ওপর নির্ভর না হয়ে নিজ কর্মের ওপর দৃঢ় থেকে আল্লাহর রিজিক সন্ধান করা সবচেয়ে উত্তম ৷ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মিকদাম (রা:) সূত্রে নবী (সা:) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না । আল্লাহর নবী দাঊদ (আ:) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন । (সহীহ বুখারি, হাদীস নং-২০৭২)
প্রিয় ব্যবসায়ী ভাইগণ, হালাল উপার্জন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷ আর যা উপার্জন করবেন তার উৎকৃষ্ট হতে ব্যয় করুন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং দরিদ্র মানুষের জন্য৷
মহান আল্লাহর বাণী- তোমরা যা উপার্জন কর তার উৎকৃষ্ট হতে ব্যয় কর। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৬৭) হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। (সূরা তাহরীম, আয়াত-০৬)
আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদের সঠিক আখলাক দান করুক এবং সঠিকভাবে হালাল উপার্জন করার তৌফিক দান করুক, আমিন৷৷
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম।
-এটি